মুক্তি যুদ্ধ ও আমার পরিবার

মুক্তি যুদ্ধ ও আমার পরিবার
মাহাবুবা লাকি


একটি সভ্য জাতির কাছে স্বাধীনতার চেয়ে প্রিয় আর কিছু নেই। মুক্তি যুদ্ধ শুধু একখন্ড ভূমির অধিকার পাবার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটা ছিল পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি দেওয়ার পাশাপাশি একটি জাতিকে এই সংগ্রাম অন্য জাতির সাংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে সমগ্র ভূখন্ডকে বাঁচানোর যুদ্ধ, যা পরবর্তীতে দেশ ও জাতিগঠনের দ্বার খুলে দিয়েছিল। রক্তাক্ত ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় আমরা পেয়েছি যে স্বাধীন বাংলাদেশ, যে লালসবুজ পতাকা ও মানচিত্রে মাথা উঁচু করা এক জাতির সম্ভ্রম ও গৌরব। সেই স্বাধীন দেশের গৌরব আমার কপালে ও এঁকে দিয়েছে লালসবুজ টিপ।

আমার পরিবার শুরু থেকে শেষ অব্দি এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সাথে লড়েছিল এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ও দেশ ও জাতির পাশে আজীবন থেকেছিল। আমি মনে করি প্রত্যেকটি জীবনের ভেতর একটি উপন্যাসের উপাদান থাকে। আর একেকটি পরিবারে ভেতর থাকে হাসিকান্না আনন্দ ও বীরত্বের ইতিহাস। অনেকে সেসব লিখতে পারে, অনেকেই পারে না। ছোট বেলা থেকে এসব যুদ্ধ জয়ের গল্প শুনে শুনে মনে হত রূপকথা। কিন্তু বড় হতে হতে সে সব অনুধাবন করি মুক্তি যুদ্ধ ও আমার পরিবার কিভাবে অঙ্গাগীভাবে জড়িত ছিল। যখন যুদ্ধের উপর কোন কবিতা গান, গল্প, নিবন্ধ, উপন্যাস লিখি, গর্বে মাথা উঁচু হয়ে যায়। তখন একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলে নিজেকে মনে হয় আমিও একজন যোদ্ধা।

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঘোষিত হয়েছিল স্বাধীনতা। বাঙালিদের সেই স্বাধীনতা ভোগ করতে না দিয়ে সামরিক জান্তারা আকস্মিকভাবে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের জাল ফেলে যুদ্ধ অনিবার্য করে তোলে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে শুরু হয় স্বাধীকার আন্দোলন। এই আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বই ছিল ২৬শে মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকেই বাঙালীদের জ্বলে ওঠা। এরপর একে একে ১৯৬২ এর ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৭এর গণ অভ্যুত্থান, ১৯৬৬ সালের স্বাধীকারের ছয় দফা ও ১৯৭০ থেকে ১৯৭১ এর মধ্যে নির্বাচন। আওয়ামী লীগ ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭তে জয়লাভ করলে ওরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতুবি ঘোষণা করে। সেদিনই বাঙালি বুঝে ফেলে স্বাধীনতার আন্দোলন ছাড়া নিজেদের অধিকার রক্ষার আর কোন পথ নেই। মায়ের ভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতির জন্য হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতিকে নানাভাবে আন্দোলন ও সংগ্রাম করে ছিনিয়ে আনতে হয়েছে। মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি আমার পরিবারটির ও মমত্ববোধ ছিল প্রবল। বিংশ শতাব্দীতে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন হল বুকের তাজা রক্ত দিয়ে মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষার অধিকার ও লাখো লাখো শহীদের আত্মদানের মাধ্যমে হানাদার পাকিস্তান বাহিনী ও বাঙালি নামক কুলাঙ্গার রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের পরাস্থ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলো। এই লড়াইয়ের মাধ্যমে পৃথিবীতে বাঙালিরা শ্রেষ্ঠতম স্থান দখল করে নেয়। সেই ইতিহাসে আমার পরিবারের নাম ও লেখা হয়ে যায়। যার প্রমান “৭১এর বাগেরহাট” বইটি। মুক্তিযুদ্ধে এই পরিবারের অবদানের কথা ২০০৬ সালে সাহিত্য বিলাস থেকে প্রকাশিত “৭১এর বাগেরহাট” বইয়ে সবিস্তারে বর্নিত হয়েছে।

বাবা মা ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান অবরুদ্ধ দেশে বসে কান পেতে শুনতেন। কেননা ছোট চাচা যুদ্ধে গিয়েছে। তার দল ও সে কেমন আছে, কোথায় যুদ্ধ করছে, কত মানুষ মরছে, বাঙালীরা কোথায় কোথায় নিহত ও জয়লাভ করছে সব জানার জন্য। সেই সময়ে বেতার কেন্দ্র উৎকন্ঠা, উদ্বেগ ও মুক্তি যোদ্ধাদের ক্যাম্পে আশা নিরাশার কথা “চরমপত্র” নামের অনুষ্ঠানটি তুলে ধরতো। বাবা এই অনুষ্ঠানটির কথা অন্যদের মাঝে তুলে ধরতেন এবং অপেক্ষাকৃত যারা তরুন ছিল তাদেরকে উৎসাহ দিতেন তার ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা শরীফ আবুতালেবের মত তোমরা ও যুদ্ধে যাও। বাবা বলতেন শত্রুদের ঘৃণা কর আর যুদ্ধে যাবার জন্য আত্মশক্তি যোগাও দেহ আর মনে। সেই থেকেই শুরু আমার পরিবারের যুদ্ধ ভরা কাহিনী।
কতটুকু বয়স ছিল আর, সাল তারিখ কত এর কিছুই মনে নেই। বিকেল হলেই আমার ছোট কাকু মানে কমান্ডার শরীফ আবুতালেব –বাহির বাড়ির কাঁচারি ঘরের সিঁড়িতে বসে সব ভাইবোনদের বলতো, আয় তোদের ইতিহাস শোনাব। এই দেশ, এই মাটি, এই ভাষা কি করে এলো, আমরা কি করে পেলাম। রাজনৈতিক নেতা হবার কারনে কাকু প্রায়ই ঢাকা অবস্থান করতেন আর বাবা যশোরে চাকরি করতেন। দুইভাই যতবার ই বাড়িতে আসত, আমরা সবাই মিলে যুদ্ধ যুদ্ধ গল্প বলতে বলতাম। তারা যখন থাকত না, ঘুমানোর আগে মাকে ধরতাম তুমি বল। সবাই ঘুমাত রূপকথার পরীর গল্প শুনে শুনে আর আমরা ঘুমাতাম দেশের জন্য বাবা কাকা কি ভাবে লড়েছেন আর মা তাদের পাশে থেকে সাহস ও উদ্দীপনা দিয়ে কি ভাবে মনোবল জুগাতেন তার জমানো টাকা ও সব স্বর্ণ বিক্রি করে।



গল্পের শুরুটা ছিল এমন! তিনি একদিন এভাবেই বলতে থাকেন। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। একই মাসের ২৩ তারিখে অর্থাৎ ২৩শে মার্চ সমগ্র বাংলায় স্বাধীন পতাকা উত্তোলন করা হয়। আমি তখন (বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শরীফ আবুতালেব) দৌলতপুর সরকারি মহাবিদ্যালয়ের স্নাতক শ্রেণীর শেষ বর্ষের ছাত্র। স্বাধীনতা চাই, স্বাধীন পতাকার মান স্থায়ী হোক এই নেশায় নিজেকে প্রস্তুত করে ফেলছিলাম। সংগ্রাম পরিষদের প্রধান হিসেবে নিজ হাতে লাল সবুজ পতাকা উত্তোলন করলাম। পত পত করে উড়তে লাগল স্বাধীন পতাকা। পাকিস্তানিদের মুখে চুন কালি পড়ল। বর্বর ইয়াহিয়া পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের এর নির্দেশ ক্রমে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে গোটা জাতির উপর নির্যাতন ও গণহত্যার ঝড় তুলতে লাগলো। মা বলতেন, তোদের বাবা (বিশিষ্ট মুক্তি যোদ্ধা শরীফ মোসলেম আহমেদ) চাকরি জীবি মানুষ। তার কাছে নিজের জীবনের চেয়ে আমার জীবনের মূল্য অনেক বেশি ছিল এটা মনে প্রানে ভাবতো। দুই ভাই চরম এই বিপদের কথা মাথায় নিয়ে শেলি, কনক ও আশা সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে যশোরের বাড়ি তালতলা ত্যাগ করে দেশের বাড়ি মোল্লাহাটে আশ্রয় নিলাম। তোর দাদীমা সবাইকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেললো। ঠিক এর দুদিন পর জানতে পারলাম তোর বাবার বাসা লুট করেছে এবং স্থানীয় রাজাকারেরা ও পাকিস্তানি বাহিনী মিলে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। তোদের মা কান্নায় ভেঙে পড়ে নিজের হাতে সাজানো সংসার ছাঁই হয়েছে শুনে। কিন্তু সেদিন তোদের দাদীমা বলেছিল সব জ্বলে পুড়ে ছাঁই হয়ে যাক, তোরা তো জীবন নিয়ে ফিরে এসেছিস।

মধুমতী নদীর পশ্চিম তীরে মোল্লাহাটের অবস্থান। অপর তীরেই টুঙ্গিপাড়া জাতির জনকের বাড়ি। ১৮২০ সালে যশোরের কালেক্টর “এস ভি রোজারিও “, এখানে পরিদর্শনে এলে জনগনের চাহিদার ভিত্তিতে স্থানীয় তমিজউদদীন হাটে মোল্লাহাটে একটি অস্থায়ী ফাঁড়ির অনুমোদন দেন। পরবর্তীতে যা মোল্লাহাট পূর্ণাঙ্গ থানা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই থানারই কুলিয়া উইনিয়ানের (নরসিংহপুর) গ্রামে সবুজ শ্যামলিমায় এক সম্ভ্রান্ত শরীফ বংশে খ্যাতি মান এই দুই ভাই এর জন্ম।

বাড়িতে এসে এক রাত ও ঘুমাইনি। সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অবস্থানে থেকে কি ভাবে দেশকে রক্ষা করা যায় তা আশেপাশের এলাকার সকলকে সংঘটিত করে দুই ভাই এ ব্যাপারে মত বিনিময় করেন। তাদেরকে বর্তমান দেশের পরিস্থিতি ও এদেশে পাকিস্তানি ও তাদের দোসরা মিলে যে নৃশংস বর্বতা চালাচ্ছে তা তুলে ধরেন। সবাইকে বলেন এ মত অবস্থায় বসে থাকলে চলবে না। আমাদের কিছু করতে হবে। সেই লক্ষে দুই ভাই একটি বাহিনী গড়তে শুরু করেন এবং তাদেরকে ট্রেনিং নিতে ভারতে যাবার প্রস্তুতি নিতে বলেন। ইতিমধ্যে শহীদ এবি এম জাহিদুল ইসলাম হাবিব(জালাল) বজলার রহমান সহ বেশ কিছু তরুন দেখা করে এবং নির্দেশ চায় ভারত যাবে ট্রেনিং নিতে। যে কথা সেই কাজ, তড়িঘড়ি করে সেই একদল যুবক সহ গভীর রাতে অস্ত্র সংগ্রহ ও ট্রেনিং নিতে ভারত যাত্রা শুরু করবো এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।

সেদিন তাদের সবাইকে গাইড করেছিলাম যাত্রাকালে কেও কারো আপনজনের সাথে দেখা করতে পারবে না। আমার সাথীরা সে দাবী মেনে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের একটা দাবী ছিল আমার সহোদর ভ্রাতা(তোদের বাবা) তার সাথে দেখা করবে ও দোয়া নেবে। সেদিন তাদের সেই দাবী আমি উপেক্ষা করতে পারি নাই। রাত দুইটার সময় তোদের বাবাকে জানানো হল আমাদের উদ্দেশ্যের কথা। তিনি প্রথমে চমকে উঠলেন। সেই গভীর রাতে আমার কপালে একটা চুম্বন দিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে আমাদের বিদায় জানালেন। সময়টা ছিল জুনের মাঝামাঝি।

আমার সাথীদের নিয়ে দুর্গম বিপদ জনক পথ যাত্রার মধ্য দিয়ে পশ্চিম বাংলায় পৌছালাম। সেখানে সাতক্ষিরার (মরহুম) এম পি গফুর সাহেবের চরম সহানুভূতিতে পিপা ক্যাম্পে সাথীদের নিয়ে অবস্থান করলাম। ইন্ডিয়ান সিক ক্যাপ্টেন দুদিনের ভেতর আমাকে বন্ধুর মত ভাবতে শুরু করলো ও আমার সাথীদেরকেও। তবে সেখানে খাওয়া দাওয়ার কোন নিয়ম ছিল না। ওই ক্যাম্পের তেরশত ছেলে হতাশা গ্রস্থ হয়ে পড়েছিল। তারা কেও কেও বলে ও ফেলছিল এমন হলে আমরা পালাবো। চিন্তায় পড়ে গেলাম, তবে অনুমান হচ্ছিল ক্যাম্পের রেশন চুরি হচ্ছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ওরা পালালে, আর দেশে গিয়ে যদি এই কথা বলে, তাহলে মুক্তিকামী মানুষেরা ভয় পেয়ে যাবে। তারা ভারতে ট্রেনিং নিতে আসবে না। তাতে আমাদের সংগ্রাম দূর্বল হয়ে যাবে। হঠাৎ বুদ্ধি করে সাথীদের বল্লাম আজ যদি সকালের নাস্তা দুপুর বারটায় দেয় আমি স্ট্রাইক ঘোষণা করে দেব। সেদিন ছিল ৮ই আগাস্ট। তোরা ভয় পাস না। সাথীরা উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং ভরসা পায়, ট্রেনিং এ মনোনিবেশ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে।



সেই সময় নোয়াখালীর এক সুবেদার মেজর খাবার বিতরনের তদারকিতে এসেছিলেন। আমি দৃঢ় কন্ঠে বল্লাম, আমরা মরতে আসিনি। খাবার না পেলে কি করে ট্রেনিং করব। আমরা শেষ হয়ে যাব। এমন অবস্থা হলে শত্রুর সাথে লড়তে পারব না। ক্যাম্পের সবাই আমাকে সমর্থন জানাল। একই দিনে ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল ক্যাম্প পরিদর্শনে এলেন। নোয়াখালীর ভদ্রলোক বাঙালি হলে ও আমার বিরুদ্ধে মেজর জলিলের কাছে নালিশ দিলেন। আমি নাকি বিদ্রোহ করছি ক্যাম্পে। সেদিন সেক্টর কমান্ডার আমায় ডেকে বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে বলিষ্ঠ কন্ঠে বলেছিলেন, আমি তোমাকে গুলি করতে পারি, জান! ততক্ষণে ক্যাম্পের ছেলেরা আমার চারপাশে জড়ো হয়ে গিয়েছিল। প্রতিউত্তরে আমি ও বলিষ্ঠ কন্ঠে বলেছিলাম নাহ! তা আপনি পারেন না। সেক্টর কমান্ডার বলেন, কেন পারিনা। উত্তরে বলেছিলাম আগে আপনাকে শুনতে হবে কেন এটা আমি করেছি। তখন সবিস্তারে ক্যাম্পের সব অনিয়ম তাকে খুলে বল্লাম। এসব কথা শুনে তিনি ওদের উপর রেগে গিয়ে ডেকে পাঠালেন এবং তিরস্কার করলেন। এরপর আমায় কাছে ডেকে হাতে একটি কার্ড দিয়ে বল্লেন, আগামীকাল থেকে খাবারের কোন অনিয়ম হলে তুমি কলকাতা গিয়ে আমায় সব জানাবে। সৌভাগ্যক্রমে আর কোন অনিয়ম হয়নি। সমস্ত ক্যাম্পের ছেলেদের কাছে আমি “তালেব ভাই ” নামে পরিচিত হয়ে গেলাম।

অতঃপর চরম সৌভাগ্য, ১৯৭১ এর ১৪ই অগাস্ট সেক্টর কমান্ডার ও ক্যাপ্টেন সিপা আমার সাথীদের সহ বিহারের (চাকুলিয়ায়) ট্রেনিং এর জন্য প্রেরণ করলেন। সেদিন ছিল স্মরণীয় দিন। অস্ত্র হাতে এসে গেছে, শত্রুর বিরুদ্ধে এবার লড়ব, দালালদের খতম করে মা, মাটিকে মুক্ত করবোই। পরেরদিন অস্ত্র হাতে পেলাম। শুরু হল চরম কঠিন দিন। আমি ও আমার সাথীরা পিষে যেতে থাকলাম। কারন ছয়মাসের ট্রেনিং এক মাসেই নিতে হবে। আমি ইউ, ও, টি,সি ক্যাডেট ছিলাম। সাথীদের কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছিলাম, তারা এত কষ্ট পারবে কি না। কয়েকদিন যেতে না যেতে কয়েকজনের হাসপাতালে স্থান হল। আমি প্রথমে প্লাটুন কমান্ডার ছিলাম। ইন্সট্রাক্টর বাঙালি বিদ্বেষী ছিল। গাদ্দার, গান্ধা আদমি এই ছিল তার ভাষা। বিহারের সেই শক্ত কুঞ্চি ট্রেনিং গ্রাউন্ডের প্রশিক্ষণ আমার সাথীদের পিঠে পড়তে লাগল সপাসপ।

হঠাৎ একদিন আমায় ডেকে বলে লেডার, শুনিয়ে বাদ,——। বল্লাম ঠিক হে ওস্তাদ! “তোমরা বাদ মেরা ছেরমে রাখে গা” বলতেই আমায় প্রচন্ড ঘুষি মারতে থাকে। আমি দুর্বল হয়ে যেতে থাকলাম। ইতিমধ্যে ইউ পির এক ইন্সট্রাক্টর ষাঁড়ধারী ব্যাটাকে বলে, “শালা তোমরা গোস্তি হোয়া”। এ আদমি তো কলিফাইড নওজোয়ান হায়। এতো তোমার ওস্তাদ হায়, তোমার বাপকা ওস্তাদ হায়। এ কথায় সে আরো রেগে গিয়ে চরম ভাবে মারতে থাকে। আমার সাথীরা কান্নায় ভেঙে পড়ল। ক্যাম্পে ফিরে দেখি দুপুরে কেও খাবার খায় নাই। সবার চোখে অশ্রু। ছুটে গেলাম চাকুলিয়া ট্রেনিং ক্যাম্পের চেয়ারম্যানের কাছে। চরম এই দুর্ব্যবহারের কথা তাকে জানালাম।।
সব শুনে তিনি বল্লেন, কি করলে তুমি খুশি হও। বল্লাম, ওই বেটা যেন বাংলাদেশ হতে আগত মুক্তিযোদ্ধাদের ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কাজ না পায়। তাই ই হল, ওই দিন নতুন ইন্সট্রাক্টর আসলেন।



রাত তখন দুইটা বাজে। ওরা গোয়েন্দা মারফত খবর নিয়ে এম্বুসে আমাদের ঘিরে ফেলে। রাজাকার ও পাকসেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধের মোকাবেলা করতে হয়। পাশের থানা হলেও এটা আমাদের অপরিচিত এলাকা ছিল। তাছাড়া আমার সব সাথীদের অধিকাংশ ই স্কুল, কলেজের ছাত্র ছিল। দুই ঘন্টা কাল তুমুল যুদ্ধ হয়। শত্রুরা বৃষ্টির মত গুলি বর্ষন করে আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কে কোথায় পড়ল বুঝে উঠতে পারলাম না। আমার দুজন সাথী আবুল কালাম আজাদ ও সবুর গুলিবিদ্ধ হয় ও আমি মারাত্মক আহত হই। দেখি ওরা সেই অবস্থায় আমাকে নিয়ে টানা
হেঁচড়া করছে। ওদের রক্তের স্রোত দেখে নিজেকে শক্ত করলাম এবং গামছা দিয়ে ওদের ক্ষত স্থান বাঁধতে বল্লাম। এই সময় সামচু ভাই সহ আরো তিনজনকে পেলাম। মোট ২৬ জন সাথীকে পেলাম। নির্দেশ করলাম অস্ত্র ছাড়া আর কিছু বহন কর না। সাথে থাকা থালা, প্লেট, গ্লাস ও কাপড় সব ফেলে দিতে বল্লাম। শত্রুরা আমাদের চারিদিক থেকে অবরোধ করেছে, তবে রাতে বাগানে ঢুকবে না। আরো ১৫ মিনিট অন্য সাথী দের জন্য অপেক্ষা করলাম এবং বাকিদের বল্লাম যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দক্ষিন দিকে সরে যেতে হবে। যেতে যেতে অন্য সাথীদের আওয়াজ পাবার চেষ্টা করছিলাম। না পেয়ে মন খারাপ ছিল। ৪ মাইল অতিক্রম করার পর আজানের শব্দ শুনলাম। তাড়াতাড়ি এক পুরানো ভিটার আনারস বাগানে আশ্রয় নিলাম। সাথীদের বল্লাম আমরা আক্রান্ত, কেও আর বাঁচব না। তবে সবাই মন খুলে শোন, মৃত্যুর আগ মুহুর্ত অব্দি সবাই প্রাণপণ লড়ে যাব। তবে গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম কেউ ভঙ্গ করব না। সেদিন বাকি ৩৩ জনকে রাজাকাররা ঘিরে ফেলে। সারারাত গুলি বিনিময় হয়। রাজাকারদের পরিচিত এলাকা হওয়ায় ওরা মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ করে গুলি করে। গুলিতে ৭ জন ওখানে নিহত হয়। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মুক্তি যোদ্ধারা অসহায় হয়ে পড়ে। অসংখ্য রাজাকাররা বাগানটি ঘিরে ফেলে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বাগানের দিকে আগায়। সেই মুহুর্তে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা পালাতে পারলে ও বাকি ৯ জন রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে। অমানুষিক নির্যাতন করে তাদের খুলনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এখান থেকে দুজনকে জেলে পাঠায় ও বাকিদের বদ্ধভূমিতে নিয়ে হত্যা করে। ফকিরহাটের পিলজঙে এভাবে ১৪ জন মুক্তি যোদ্ধা শহীদ হন।

৫ই অক্টোবর রাত ৮টার সময় ফকির হাটের দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে মোল্লাহাট থানাধীন চাঁন্দেরহাটে পৌছালাম। আবুল কালাম আজাদের গুলিবিদ্ধ স্থান হতে পঁচা গন্ধ বের হচ্ছিল। সে কান্নায় ভেঙে পড়ল, বলে তালেব ভাই আমি বাঁচব না। সাহস দিয়ে বল্লাম, নিজের এলাকায় এসেছি, তোর কিছু হবে না। তাছাড়া নিহত সাথীদের বদলা না নিয়ে আমরা কেও মরব না। সাথীরা মনোবল ফিরে পেল। সেদিন ৬ই অক্টোবর চাঁন্দের হাট বাসিরা আমাদের প্রচুর খাবার এনে দিল। কেও খেতে পারলাম না। একাধারে ৪ দিন অনাহার ও সাথীদের করুণ পরিণতি আমাদের মর্মাহত করে।

পরের দিন বড় গাওলায় পৌছে গেলাম। ওখানে কেশব বাবুর সাথে দেখা হল। দেখা হল দেশপ্রেমিক জয়নাল আবেদীন এর সাথে, তিনি আমার এক সাথীর বাবা। জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেন, আবুতালেব তোমাদের জন্য মোল্লাহাট বাসী পাগল হয়ে আছেন। তোমরা ফিরে আসবা ভাবতে পারি নাই। সেদিন ফেলে আসা সাথীদের কথা তাকে জানাতে পারলাম না। নগরকান্দি, ঘোষগাতি সহ পশ্চিম মোল্লাহাটের শত শত মানুষ দেখতে এসেছিল আমাদের।


সংবাদ হয়েছিল আমি বেঁচে নেই –এটা শুনে তোদের বাবা শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিল। লোকমুখে সংবাদ পেয়ে সে ও ছুটে এসেছে। দেখা মাত্র বুকে জড়িয়ে কপালে চুম্বন দিতে লাগল। ফেলে আসা সাথীদের কথা মনে করে চোখ দিয়ে পানি এসে গেল। ভাবলাম আজ ওরা ফিরলে আপন জনেরা এভাবে আদর করতো। রাতে বসে ঠিক করলাম, কিভাবে আগাবো, কি করবো এবং সাথীদের নিয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম, এই প্রতিশোধ আমরা নিবোই এবং মা মাটি দেশকে স্বাধীন করবোই।

সেদিন ভোর রাতে ৭ই অক্টোবর মোল্লা আশরাফ ও সেখ আবুল মিয়া আমার সাথে দেখা করে এবং তারা জানায় আজ পাকসেনা ও রাজাকাররা চরকুলিয়া আক্রমণ করবে। তারা এও সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে সব জ্বালিয়ে দেবে। এই সংবাদটি পাওয়া মাত্র ডাঃ লতিফ ফরাজি ও বিজয় বাবুর তত্বাবধানে গুলিবিদ্ধ সাথী আবুল কালামের চিকিৎসার জন্য অনুরোধ করলাম এবং ডাঃ মমোতাজ উদ্দিনের নিকট যিনি শহীদ মহিদুল হাবিবের পিতা তার নিকট গুলিবিদ্ধ সবুরকে প্রদান করলাম।


ক্রমশঃ………

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *