bibidho-sharat-tomar

শরৎ তোমার একটি শিশিরবিন্দু
ফিচার
অমর মিত্র


মহালয়া অমাবস্যার দিন। ভাদ্রের অমাবস্যা কেন না এই কৃষ্ণপক্ষ শুরু হয়েছিল ভাদ্র মাসে। শেষ হলো আশ্বিনে। এই অমাবস্যার আগের এক গোধুলি বেলার কথা বলি যার সঙ্গে এ জীবন সংপৃক্ত হয়ে আছে। সেদিন ছিল চতুর্দশী কিংবা অমাবস্যা। কখন যে এক তিথি শেষ হয়ে অন্য তিথির আবির্ভাব হয়, তা পঞ্জিকাকাররা বলতে পারেন। বলতে পারেন মহাকাশের গ্রহ নক্ষত্র চেনা মানুষজন। জ্যোতির্বিদরা। সেদিন ছিল পিতৃপক্ষের শেষের আগের দিন। পরের দিন অমাবস্যা, কৃষ্ণপক্ষ শেষ হবে। তার পরের দিন থেকে আশ্বিনের শুক্লপক্ষ, দেবীপক্ষ আরম্ভ। আমার বাবা ভাদ্রমাসের পূর্ণিমার পর কৃষ্ণপক্ষ শুরু হলে পিতৃতর্পণ আরম্ভ করতেন। অমাবস্যার দিনে, মহালয়ার দিনে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে সেই তর্পণ শেষ হতো। মহালয়ার সঙ্গে আমাদের পরিবারের একটি সম্পর্ক রয়েছে। দেশভাগের পর এপারে এসে আমাদের পরিবার যে প্রথম মৃত্যুকে দ্যাখে, তা এই অমাবস্যা কিংবা চতুর্দশী ও অমাবস্যার সন্ধিক্ষণে। সেই রাত্রি ফুরোলে আমরা এরিয়াল লাগানো জি,ই,সি, রেডিওতে শুনব বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডী পাঠ এবং মহিষাসুর মর্দিনী কথিকা। দুর্গাপুজো যেন ঐদিন আরম্ভ হয়ে যেত। ভুবনে আনন্দের জোয়ার আসবে। সেই চতুর্দশী ও অমাবস্যার সন্ধিক্ষণে, দিবাবসানের সময়, গোধুলী বেলায় আমাদের পিতামহ অন্নদাচরণের জীবনদীপ নিবার্পিত হয়। তখন আমি খুব ছোট, বছর সাত-আট হবে বয়স। আমরা সকলে ঘিরে বসেছিলাম পিতামহকে। তাঁর দশটি নাতি, দশটি নাতনি। সকলে ছিল না। কনিষ্ঠ পুত্র চিকিৎসক তারাপদ তখনো ধূলিহর গ্রামে, পূর্ব পাকিস্তানে। আমি দেখেছিলাম কীভাবে প্রাণবায়ু অনন্তে মিশে যায়। শ্বাস নিতে নিতে আর পারলেন না তিনি। মুখে ফোঁটা ফোঁটা জল দিচ্ছেন দুই পুত্র, আমিও দিয়েছিলাম কি না মনে নেই। দিয়েছিলাম মনে হয়। নাতি-নাতনি যারা ছিল সকলেই চামচে করে এক দুই বিন্দু জল। জল গড়িয়ে পড়ল দু’ঠোঁটের কোণ দিয়ে। বুকের ওঠা নামা বন্ধ হলো। কব্জিতে হাত রেখে নাড়ি ধরে ছিলেন বাবা। বললেন, ‘বাবা নেই।’ চোখের কোন দিয়ে অশ্রু বিন্দু গড়িয়ে পড়ল। কান্নার রোল উঠল।

তারপর তাঁর মৃত দেহ ভিতরের উঠনে নামানো হয়েছিল। একটি ছোট গহ্বরে জল ভরে তাঁর পা সেখানে রাখা হয়েছিল। সেই জায়গায় পরে একটি তুলসী মঞ্চ করা হয়েছিল। সেই মঞ্চে প্রদীপ দেওয়া হত সন্ধ্যায়। মা কাকিরা দিতেন। শঙ্খধ্বনি করে খবর দিতেন ধূলিহরের অন্নদাচরণ নেই। দণ্ডীরহাট থেকে কুড়ি-পঁচিশ মাইল গেলে সাতক্ষীরে শহরের লাগোয়া আমাদের গ্রাম ধূলিহর। খুব কাছেই সেই দেশ, অন্যদেশ। বাবারা দাহ করে ফিরেছিলেন ভোরবেলায়। তখন রেডিও থেকে বীরেন ভদ্র মশায়ের মেঘমন্দ্র কন্ঠধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে ভোরের বাতাসে। পিতৃহারা দুই পুত্র এসে বসলেন বারান্দায়। অন্য পুত্রটি তখন অন্য দেশে, জানেও না মহাগুরু পতন হয়ে গেছে তার অজান্তে। ২০২০ সালে মহালয়া হলো ভাদ্র সংক্রান্তির দিনে। ভাদ্র মাসের শেষ দিনে অমাবস্যা। ১৭-ই সেপ্টেম্বর। আমার বাবা, অন্নদাচরণের জ্যেষ্ঠ পুত্র অশোককুমার মারা যান ২০০২ সালের ভাদ্র সংক্রান্তির আগের দিনে। ২০২০ সালে সেই দিন ছিল মহালয়ার আগের দিন। পিতা পুত্রের মৃত্যুদিন এক হয়ে গেছিল। আমার বাবা চলে যান রাত্রিকালে। আমি নার্সিংহোমে তাঁর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে সেই মৃত্যু দেখেছিলাম। শান্ত মৃত্যু, ধীরে ধীরে শ্বাস নেওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মনিটরে তাঁর হৃদস্পন্দনের কম্পনের ঢেউ ক্রমশ অনুভূমিক রেখা হয়ে গেল। গান থেমে গেল। বাঁশির সুর থেমে গেল।

আজও মহালয়া এলে সেই মৃত্যুর কথা মনে পড়ে আমার। সেই ভোর। গুরুদশা, হাতে কঞ্চি ও কম্বলের আসন, দুই ভাই। অশোক ও তারাপদ বসে আছে বারান্দায়। গ্রামের অনেক মানুষজন বসে আছে হেথাহোথা। মহালয়া এলে একটু মন খারাপ হয় সত্য। বাবা কাকারা কেউ নেই এখন। তাঁদের তর্পণ করা হয় এইদিন। আমি ভোরে বিছানায় শুয়ে সেই গোধুলীবেলার কথা ভাবি। বাবার সঙ্গে আমি কয়েকবার গঙ্গায় গিয়েছি। শেষে বাবা আর গঙ্গায় যেতেন না, বাড়িতে করতেন পিতৃপুরুষ স্মরণ। নিজে চণ্ডীপাঠ করতেন বাড়িতে বসে। বামুন পুরুতে তাঁর কোনো আস্থা ছিল না। তাবিজ আংটি কোনোদিন ধারণ করেননি। কিন্তু এইসব আচারে যে দার্শনিকতা তা তাঁকে আকৃষ্ট করত। তাঁর ইচ্ছে ছিল দর্শন নিয়ে পড়বেন। দারিদ্রের কারণে হয়নি। কিন্তু জ্যেষ্ট পুত্রকে দর্শন পড়িয়ে তৃপ্ত হয়েছিলেন। বাবা নাটক, নভেল পছন্দ করতেন না। কিন্তু বাধাও সেভাবে দিতে পারেননি। দাদার একটিও নাটক দ্যাখেননি। ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন বড় মামা। সে এক কাহিনি। শালা ভগ্নিপতি উত্তেজিত মিনার সিনেমা হলে বসে। বড় মামা খুব কথা বলছেন। পিছনের দর্শক রাগত স্বরে বলছেন, মশায় থামবেন। বিরতির সময় বড় মামা বিনয়কৃষ্ণ বসু দাঁড়িয়ে পড়েছেন, আরে মশায়, আমার ভাগ্নে, বড় ভাগ্নে, এত বুড়ো সে নয়, ইয়াং ম্যান, কলেজে পড়ায়…, হ্যাঁ, আমার নিজের ভাগ্নে। এই যে আমার ভগ্নিপতি…। বাবা টেনে বসিয়ে দেন বড় মামাকে। কী বিপদ বিনয়বাবু আপনাকে নিয়ে।

বাবার প্রয়াণের পর আমরা তিন ভাই একসঙ্গে তর্পণ করেছি দু’বছর। হ্যাঁ, সল্টলেকে দাদার বাড়িতে। গঙ্গায় সেদিন বড় কলরব, হৈ হৈ। তার ভিতরে পিতৃপুরুষ স্মরণ হয় না। বাড়ি অনেক শান্ত। মৃত্যুর তিন বছরের মাথায় মহালয়ার আগের দিনে আমি ছিলাম সিউড়িতে এক সাহিত্যের অনুষ্ঠানে। অমর দে এবং তাঁর গল্প সরণি পত্রিকা ছিল তার আয়োজক। লেখক রমানাথ রায়, জয়ন্ত দে, অরিন্দম বসু ছিলেন। পরদিন ভোরে আমরা চললাম ময়ুরাক্ষী ব্যারেজে। ময়ুরাক্ষীতে পিতৃ-মাতৃ তর্পণ করব। ব্যারেজে যা হয়, একদিকে জল টলটল করছে, অন্যদিকে ধুধু বালুচর। কী অপরিসীম শূন্যতা! সেই ভোরে সেখানে মানুষজনও বিশেষ ছিল না। হয়তো নদীর অন্য কোথাও হয় তর্পণ। নিঃঝুম প্রকৃতিতে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছিলাম প্রিয়জন না থাকার বেদনাটি। বাবার আগে তাঁর দুই ভাই চলে গিয়েছিলেন। সকলের কথা মনে পড়ছিল আমার। খা খা বালুচরে দাঁড়িয়ে তৃষ্ণার্ত পিতৃকুল, মাতৃকুল যেন জল চাইছিলেন। ধোঁয়া ধোঁয়া তাঁদের দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। আমরা সকলেই ব্যারেজের জলের কাছে গিয়ে সেই জল হাতে ছুঁয়ে স্মরণ করেছিলাম পরলোকবাসী আত্মজনদের। প্রয়াত বান্ধব, অবান্ধবদের। চেনা অচেনাদের। আমাদের শাস্ত্র বলি দর্শন বলি তা কবি-কল্পনায় পরিপূর্ণ। বিশ্বাস এই যে মহালয়ার দিনে প্রয়াত সকল মানুষের জীবাত্মা মর্ত্যে আসে তৃষিত হয়ে। তাদের জলদান করতে হয়। শুধু আত্মজন নন তাঁরা, অনাত্মীয়, অচেনা, অবান্ধব, সন্তানহীন আত্মারা আসেন জল গ্রহন করতে। ময়ুরাক্ষী ব্যারেজের যেদিকে জল, সেইদিকে গভীরতা অনেক বেশি। বিপজ্জনকও। স্নান করা হয়নি। কিন্তু জল দিয়েছিলাম তাঁদের। তাঁরা তা নিয়েছিলেনও জানি। আমি ফিরে আসতে আসতে দেখেছিলাম ধু ধু বালুচরে দাঁড়িয়ে আছেন, পিতা, পিতৃব্য, পিতামহ, পিতামহী, মাতা, মাতামহ, মাতামহী, প্রপিতামহ…। এখন আর তর্পণ করা হয় না। ভোরে এমনিতেই ঘুম ভাঙে, ফ্ল্যাটবাড়ির নানা জানালা দিয়ে মহিষাসুর মর্দিনী কথিকার গান, চণ্ডীপাঠ ভেসে আসে। তাই কানে যতটুকু আসে।

# #

মহালয়ার পরদিন থেকে শুক্লপক্ষের শুরু। মহালয়ার ভোরে বানীকুমার প্রযোজিত আকাশবানীর ওই অনুষ্ঠান পুজোর অঙ্গ হয়ে গেছে বুঝি এখন। ঐ কন্ঠই যেন ঘোষণা করে শারদোৎসব সমাগত। কতকাল ধরে, সেই বাল্যকাল থেকে শুনছি, কিন্তু এখনো যেন নতুন হয়েই আসে তা বৎসরান্তে। সুপ্রীতি ঘোষের কন্ঠে সেই গান, “বাজলো তোমার আলোর বেনু, মাতলোরে ভুবন” ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। তারপর বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কন্ঠে মহিষাসুর মর্দিনী। ঘুম আর তন্দ্রার ভিতরে কানে আসে সেই অমৃতবানী। হ্যাঁ, আকাশবানীর এখানে জিত। টেলিভিশন কিছুই করতে পারেনি মহিষাসুরমর্দিনী সাজিয়েগুজিয়ে দেখিয়ে। এখানে যে কল্পনা আছে, টেলিভিশনে তা নেই। মুক্তা ফলের মতো হিম নীলাভ ঊষাকালে সেই কল্পনাকে আর কিছুই ছাপিয়ে যেতে পারে না।

মহালয়ার দিন থেকে আর মন থাকত না কাজে। আর তো কয়েকটা দিন। মহালয়ার আর এক স্মৃতি আছে, সেবার পিতামহের অসুখের চিকিৎসার জন্য বাবার হাত একেবারে খালি। পুজোর জামা প্যান্ট হয়নি। কাঁদছি। বায়না করছি। না মামারা, না কাকারা, সকলের হাত বাড়ন্ত। কেউ কিছুই দেয়নি। নতুন জামা প্যান্ট হয়নি। বাবা আমার বড় মামিমার হাতে দশটি টাকা দিয়ে বললেন, শ্যামবাজারে গিয়ে কিনে দাও যা হয়। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে চেপে শ্যামবাজার গিয়ে ফুটপাথের হকারের কাছ থেকে দশ টাকার ভিতরেই জামা, প্যান্ট, এবং অলিম্পিক হাওয়াই চটি হলো খুব দরাদরি করে…। আহা কী আনন্দ। সেই আনন্দ টিকিয়ে রেখেছি এখনো। মহালয়ার দিনে সেই সন্ধ্যার কথাও মনে পড়ে খুব। এ মহামারি মুক্ত পৃথিবীতে উৎসবের সুর লেগেছে।

চারদিকে অভাব অভাব। মহামারীর ছায়া বিলীন হতে লেগেছে, কিন্তু তার দাগ রেখে গেছে পৃথিবীর গায়ে। এবার যে শরৎ এসেছে, তার গায়ে আতঙ্ক আর মৃত্যুর ছায়া নেই, কিন্তু অভাব অনটনের ছায়া ঘনিয়েই আছে। হাজার হাজার ম্লান মুখ চারপাশে। কত মানুষের চাকরি নেই।

চাকরির জন্য পথে বসে আছে তরুণ সমাজ। এর ভিতরেই উৎসব হবে। ধর্ম হবে। এক পরিচিত ব্যক্তির চাকরি গেছে, তাঁর নবম শ্রেণিতে পড়া কন্যার ইস্কুল বন্ধ হয়েছে। তিনি লোকের বাড়ির বাজার করে দিয়ে দু’পয়সা উপার্জনের চেষ্টা করছেন। আবার কোটি কোটি টাকা উদ্ধার হয়েই যাচ্ছে। কারোর কিছু নেই, কেউ খাটের নিচে টাকার বান্ডিল রেখেছে। এমন কত বৈপরীত্য চতুর্দিকে। কত কত। ভাবলে চোখের কোলে কি ফোটে না দু’এক বিন্দু অশ্রু?

শরতের একটি শিশিরবিন্দু।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *