bibidho-sonay-sohaga

সোনায় সোহাগা
রম্যরচনা
চুমকি চট্টোপাধ্যায়


রেবন্ত শাসমল মানুষ খারাপ নন। নিজের মতো থাকেন, কারুর পেছনে লাগেন না, কোনো প্যাঁচ পয়জারে জড়ান না। তাও কি লোকের কথার হাত থেকে নিস্তার আছে! পাড়ার লোক, বিশেষ করে ছেলেপুলেরা বলে, ‘ রেবন্ত না বাড়ন্ত ‘।

হ্যাঁ, তা বলতে গেলে মানুষটা একটু মিতব্যয়ী। বুঝেশুনে খরচ করেন। তা, সে তো কিছু দোষের কথা নয় রে বাবা! আমি ইলিশ খাব না কাচকি খাব, আপেল খাব না কলা খাব, সে আমার ইচ্ছে। তাতে কারুর তো পাকা ধানে মই পড়ছে না! মানুষজন তাও টিটকিরি মারে।

রেবন্তবাবুর এখন বয়েস ৪৫ বছর। ছোটখাট মানুষ, মাথার চুল হালকা। মেল প্যাটার্ন অ্যালোপেশিয়ার শিকার। সরকারের ক্ষুদ্র শিল্প দপ্তরে চাকরি করেন। অত্যন্ত সাদামাটা লোক। এই মুহূর্ত পর্যন্ত কুমার আছেন।

অনেকেই অবাক হয়ে জিগ্যেস করেন, ‘ সরকারি চাকুরে, উত্তর দক্ষিণ পূব পশ্চিম — কোনো দিকেই কেউ নেই, মেয়ের বাবারা তো এইরকম পাত্রই খোঁজে। ইনি পড়ে আছেন কেন?

কারণ ছাড়া তো ঘটনা হয় না। রেবন্তবাবু এখনও অবিবাহিত থাকার প্রথম কারণ হল, ওঁর জন্য সম্বন্ধ দেখার কেউ নেই, নিজে পছন্দ করে বিয়ে করবেন সে এলেমও ওনার নেই। দ্বিতীয় কারণটি হল, খরচ করে বিয়ে করার পরিপন্থী উনি। শুধুমাত্র মালা বদল করে কোনো মহিলা যদি ওনার ঘরে আসতে চায়, তবেই তিনি সম্মত হবেন। পুরুত থেকে নিমন্ত্রিত — কারুর পেছনে খরচ করতে রাজি নন রেবন্তবাবু। ওসব নাকি বর্বরস্য ধনক্ষয়।

তেমন কন্যে অবশ্য জুটেও গেল রেবন্তবাবুর কপালে। মামণি সমাদ্দার। বচন অতি মিষ্ট, একটু নাকি। বয়েস ৪৩। রঙ একটু চাপার দিকে। স্বাস্থ্য ভালো। চোখ দুখানা ঠিকই আছে তবে চোখের মণি দুটো অবাধ্য। স্বাভাবিকভাবে যার যখন যেদিকে যাবার কথা, সেদিকে যায় না। ডান-মণি বাঁ দিকে গেলে বাঁ- মণিও বাঁ দিকে আসে। মণিযুগলের এই অবাধ্যতার কারণেই হয়তো বা মামণি অনূঢ়া থেকে গেছেন এতদিন। বা, অপেক্ষা করেছেন রেবন্তর জন্য।

সম্বন্ধটা দিয়েছিলেন অফিসেরই এক কলিগ বিকাশ কোলে। ভদ্রলোকের পাড়াতেই বাড়ি মামণিদের। বিকাশবাবুর কথায় এক বিকেলে একা একাই পাত্রীর বাড়ি গেলেন রেবন্ত শাসমল।

মামণির মা যত্ন করে বসালেন রেবন্তবাবুকে। খুবই সাধারণ অবস্থা। তাতে অবশ্য রেবন্তবাবুর কিছু যায় আসে না। বরং স্বচ্ছল হলেই বিপদ হতো, চাহিদা বেশি হতো। এই ভালো। টাকার মূল্য বুঝবে আশা করা যায়।

একটু পরেই হাতে খাবারের প্লেট আর জলের গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকল মামণি। সামনের ছোট টুলে সেসব নামিয়ে রেখে হাত জোড় করে বলল, ‘নমস্কার। আমি মামণি সমাদ্দার। খেয়ে নিন।’

জীবনে এই প্রথম কোনো মেয়ের মুখোমুখি হয়েছেন রেবন্তবাবু। অবস্থা বেশ ঢিলে। যেন বোবা হয়ে গেছেন। জলের গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে জল খেয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘আমি রেবন্ত শাসমল। আপনাকে কটা কথা বলার ছিল।’

‘সে বলুন, তার আগে খেয়ে নিন।’

রেবন্তবাবু দেখলেন প্লেটে লুচি ঘুগনি আর দু রকম মিষ্টি রয়েছে। মামণির কথাকে আদেশ মেনে গপাগপ খেয়ে নিলেন সব কিছু। ততক্ষণে মামনি গ্লাসে আবার জল ঢেলে দিয়েছে। জল খেয়ে, রুমালে মুখ মুছে শুরু করলেন তিনি ।

‘দেখুন, আমি সরকারি চাকরি করি ঠিকই তবে খুবই ছোটখাটো পোস্টে। একা থাকি, ভবিষ্যতের কথা ভেবে একটু বুঝেই চলি। বয়েস বাড়ছে, কখন কী রোগে ধরে তার তো কোনো ঠিক নেই, তাই চিকিৎসার খরচ জোগাড় রাখা খুবই জরুরি বলে আমি মনে করি। এই কারণে অনেকেই আমাকে কৃপণ বলে।

আপনাকে খোলাখুলি বললাম। আপনার শখ সৌখিনতা হয়তো তেমন ভাবে আমি মেটাতে পারব না। আপনি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেবেন।’

মামণি হেসে বলল, ‘আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই।’ রেবন্তবাবু আবারও বললেন, ‘বিয়েতেও আমি কোনোরকম খরচের পক্ষে নই। লোকজন গান্ডেপিন্ডে খাবে আবার নিন্দেও করবে। রেজিস্ট্রি করাটাই যথেষ্ট বলে আমার মনে হয়। আপনার যদি কিছু বক্তব্য থাকে তো বলতে পারেন।’

এবারও সলজ্জ হেসে মামণি বলল, ‘আমার কোনো আপত্তি নেই।’ কেবল রেবন্তবাবু বুঝতে পারলেন না কথাটা মামণি কার দিকে তাকিয়ে বলল। সে হোক, এমন বশংবদ মহিলা আজকালকার দিনে পাওয়াই ভার। অতয়েব বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেল। পরের শুক্রবার ভালো দিন আছে। ওইদিন রেজিস্ট্রি হবে।

রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে বিয়ে সেরে ফেললেন রেবন্তবাবু আর মামণিদেবী। সাক্ষী হিসেবে মামণির তরফ থেকে ওর মা আর রেবন্তবাবুর তরফে বিকাশবাবু গেছিলেন। বিকাশবাবু দুজনার ফর্মেই সই করলেন।

রেজিস্ট্রি পর্ব মেটার পর চক্ষুলজ্জার খাতিরে নতুন শাশুড়ি আর বিকাশবাবুকে নিয়ে রাস্তার উল্টোদিকে ‘আবার খাব’ হোটেলে নিয়ে গেলেন রেবন্তবাবু। সেখানে কচুরি আলুর তরকারি আর দরবেশ খাইয়ে মামণিকে নিয়ে নিজের বাড়ি চলে এলেন তিনি। বেশ একটু আনন্দ হল আবার একটু ভয়ও লাগতে লাগল।

এইবার তো মামণির হাতে সংসার। যেভাবে উনি এতদিন চালিয়েছেন, এ কী সেভাবে পারবে? তারপর ভাবলেন, সংসারে একজন মানুষ বাড়লে তো খরচও বাড়বে, এটুকু মানিয়ে নিতেই হবে।

মজার ব্যাপার হল, বিয়ের দশ দিন পরেই রেবন্তবাবুর জন্মদিন পড়েছে। সেদিন রবিবার। ছুটি। উনি ভাবলেন, জন্মদিনে কিছু স্পেশাল খাওয়াদাওয়া করা মনে হয় উচিত। খরচে অতিরিক্ত টাইট দিলে নতুন বউয়ের বাজে ধারণা হবে স্বামী সম্পর্কে। শনিবারই অফিস ফেরত বিরিয়ানি কিনে নিয়ে আসবেন ঠিক করলেন।

শনিবার অফিস ফেরত ‘লাজবাব বিরিয়ানি শপ’ থেকে ৩০০ টাকা দিয়ে দু প্যাকেট বিরিয়ানি কিনলেন রেবন্তবাবু। কড়কড়ে ৩০০ টাকা বের করতে বুকে একটু ব্যথা করলেও, নতুন বউয়ের কথা ভেবে সহ্য করলেন।

মামণির হাতে প্যাকেট দুটো দিয়ে বললেন, ‘কালকের কথা ভেবে এনেছি।’ মামণি বলল, ‘এক প্যাকেট আনলেই তো পারতে। ভাগ করে খেতাম।’ বউয়ের কথা শুনে ভেতরে লাড্ডু ফুটলেও মুখে বললেন, ‘ওমা, তা হয় নাকি? এক পিস মাংস ভাগ করলে আর কী থাকে!’ সঙ্গে সঙ্গে মামণি বলল, ‘না না, স্পেশাল নিলে একটা প্যাকেটেই দু পিস মাংস দিত।’ রেবন্তবাবু জানতেন না বিষয়টা। আলোচনা সেখানেই ইতি হয়ে গেল।

রবিবার সকালে ঘুম থেকে উঠতেই মামণি ‘হ্যাপি বাড্ডে’ বলে শুভেচ্ছা জানালো রেবন্তবাবুকে। পুলকে ভরে গেল রেবন্তবাবুর মন। জীবনের এই এতখানি পার করে আজ সক্কাল সক্কাল জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো কেউ।

জলখাবার সাধারণত দুধ মুড়ি বা চিড়ে কলা দিয়েই এতদিন সেরেছেন রেবন্তবাবু। আজ একেবারে পায়েস এনে হাজির করল মামণি। রেবন্তবাবু যারপরনাই আহ্লাদিত। মুচকি হেসে মামণি বলল, ‘জন্মদিনে পায়েস মুখে দিতে হয়।’ রুটি আলুর তরকারি আর পায়েস দিয়ে জম্পেশ করে জলখাবার খেলেন তিনি।

মামণি রান্নাঘরে মন দিল। রেবন্তবাবু মোবাইলে ‘ভব সাগর তারণ কারণ হে’ গানটি চালিয়ে চোখ বন্ধ করে খাটে আধশোয়া হয়ে আয়েশ করতে লাগলেন। এই গানটি ছাড়া অন্য কোনো গান ওনার মনে ধরে না।

খানিক বাদে মামণি ঘরে এলে জীবনের নানান সুখ দুঃখের গল্প বলতে লাগলেন তিনি। মামণি এক চোখ স্বামীর দিকে আর এক চোখ দেওয়াল ঘড়ির দিকে রেখে মন দিয়ে শুনতে লাগলেন স্বামী-কাহিনী।

‘আজ দুপুরের রান্নার চিন্তা নেই, তাই তো। বিরিয়ানি আছে। রাতেও বেশি কিছু কোরো না। একবেলা ভারী খেলে অন্য বেলা পেটকে বিশ্রাম দেওয়াই ভালো, কী বলো।’ রেবন্তবাবু সাবধানী গলায় বললেন। কে জানে, স্বামীর জন্মদিনে তাকে খুশি করতে অতিরিক্ত রান্নাবান্না না করে বসে গিন্নি। তেলের যা দাম!

দুপুরে খেতে বসলেন রেবন্তবাবু। থালা এনে সামনে রাখল মামণি। থালায় বিরিয়ানির ভাত। পাশে তিনখানা বাটিও চলে এলো। একটা কষা আলুর দম। অন্যটায় চিকেনের মাখা মাখা ঝোল। অবাক হয়ে গেলেন তিনি।

‘এত সব পেলে কোথায়? আমি তো কেবল…।’

‘তুমিই তো এনেছ গো। বিরিয়ানির ভাতটা পেঁয়াজ কুচি রসুন কুচি দিয়ে ভাজা ভাজা করেছি। ভেতরে যে আলু ছিল, সেদুটো বের করে দমকষা করেছি। আর চিকেনের পিসদুটো বড্ড শুকনো ছিল, তাই একটু মাখোমাখো ঝোল করেছি। খেয়ে দেখো ঠিক আছে কি না। পাশের বাড়ির কাকিমা দুটো পেঁপে দিয়েছিল না, তার একটা দিয়ে প্লাস্টিক চাটনি করেছি। আমার মা খান কয়েক রসগোল্লা দিয়েছিল যে, সেই রস দিয়েই করেছি। ‘

বিস্মিত রেবন্তবাবু খাওয়া শুরু করলেন। দিব্বি হয়েছে পদগুলো। হঠাৎ মনে হলো, বিরিয়ানির মধ্যে তো ডিম থাকার কথা। একটু ঘুরিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘ব্যাটারা প্যাকেটে ডিম দেয়নি নাকি গো?’

‘হ্যাঁ দিয়েছে তো। ডিমদুটোর ডালনা করে রেখেছি রাতের জন্য। চারটে পরোটা করে নেব, তাহলেই হয়ে যাবে। ‘

রেবন্তবাবু তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন। তিনি বুঝে গেছেন, মামণিই তার যোগ্য স্ত্রী। সোনায় সোহাগা পড়েছে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

3 thoughts on “bibidho-sonay-sohaga

  1. চুমকি চ্যাটার্জির লেখা মানেই রসদ। সে রসদ মজার হতে পারে, জীবনের হতে পারে আবার গাছ, ক্রাইম রাজনীতি — বিষয়ের অভাব নেই লেখিকার ঝুলিতে। আজকের লেখা অনবদ্য। জীবন থেকে ক্রমশঃ ফুরিয়ে যাচ্ছে হাসি। সে হাসি ফিরিয়ে আনছে চুমকি।

  2. একেই বলে বিরিয়ানির তেলে বিরিয়ানি ভাজা।এক বিরিয়ানি থেকে কিভাবে চার রকমের পদ করে ফেলা যায় তার জম্পেশ কাহিনী অনবদ্য।

  3. রেবন্ত শাসমলের মুকুটে যথাযথ মণি জুটেছে।
    খুব ভালো লাগল!
    ধন্যবাদ, চুমকিদি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *