bibidho-sundori-corona

সুন্দরী করোনা
চুমকি চট্টোপাধ্যায়



শুভর সঙ্গে কথা হচ্ছিল ওয়াটস্যাপে। এটা সেটার পরেই এসে পড়ল করোনার কথা। এতদিন করুণা ছিল, করিনা ছিল কিন্তু মাস দুই হল এদের সবাইকে হটিয়ে দিয়ে টপ লিস্টে করোনা। নভেল করোনা ভাইরাস বা covid 19.
বিশ্ববাসীকে চীনের উপহার। বহুদিন আমরা ‘চীনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান’-এ অভ্যস্ত ছিলাম। তাহলে এখন কেন বুক বাজিয়ে বলতে পারছি না ‘চীনের করোনা, আমাদের করোনা’? না পারার কারণ আমরা সবাই জানি, আমার জ্ঞান দেবার কোনই প্রয়োজন নেই। যে ‘ক’ জানেনা, এখন সেও করোনা জানে।
করোনার কারণে এই যে লকডাউন চলছে দেশ জুড়ে, বাড়ি-বন্দী হয়ে নির্ভেজাল ছুটি কাটাচ্ছি, সত্যি কি উপভোগ করছি এই সময়টা? খুব মজায় আছি? ভালো আছি? আর এমন একটা ভয়ঙ্কর ভাইরাস, যা লক্ষ মানুষের প্রাণ নিয়ে নিয়েছে ইতিমধ্যে, তাকে আমি সুন্দরী বলছি? আমার মানসিক ভারসাম্যে সন্দেহ করতেই পারেন আপনারা ।
আসলে আমি আমার মনে নিরন্তর বয়ে চলা পরস্পরবিরোধী কিছু চিন্তাভাবনার কথা জানাচ্ছি মাত্র। এক্কেবারে সত্যি কথা বলছি কিন্তু(ট্যাব ছুঁয়ে বলছি। আপাতত এটাই আছে হাতের কাছে)। সারাদিন ধরে স্ক্রিনে, টিভি হোক বা সোশাল মিডিয়া, করোনা ভাইরাসের ছবি দেখে দেখে ওর প্রেমে পড়ে গেছি। কেমন নিটোল গোল, তার ওপর আবার সারা গায়ে যেন কলকে ফুল লাগানো। ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর শিকার পেলেই টুক করে ঢুকে পড়ে শ্বাসযন্ত্র পেরিয়ে ফুসফুসে বাসা বাঁধছে। এবার আপনার ফুসফুস কত জোরদার তার ওপর নির্ভর করছে এই অনাহূত অতিথি থাকবে না যাবে।
ভাবনাতে এর পরের যে ঢেউটা এল, তাতে চীন দেশটার ওপর প্রবল বিতৃষ্ণা বয়ে আনল। মনে হল, বোম মেরে উড়িয়ে দেওয়া উচিত দেশটাকে। ব্যাটারা মশা থেকে শুরু করে ডাইনোসর অবধি খেয়ে ফেলে(থাকলে অবশ্যই খেত)। রোগটা শোনা যাচ্ছে জুনটিক। অর্থাৎ, প্রাণী থেকে উৎপন্ন। যদিও এখন নানা রকমের কথাও শোনা যাচ্ছে। সে যেভাবেই আসুক, এসেছে তো চীন থেকে। ভবিষ্যতে যে করোণার ভাই-বোনেরা আসবেনা, তারও কোনো গ্যারান্টি নেই। অতয়েব, উড়িয়ে দাও। না রহেগা বাঁন্স, না বজেগী বাঁন্সুরি।
এম্মা, কীসব ভাবছি আমি! ছিছি! কিছু মানুষের অসতর্কতার কারণে একটা গোটা দেশের মানুষের মৃত্যু কামনা করছি! আমি তো এরকম ছিলাম না! মাথাটা গেছে একেবারে। আমাদের ভারতবর্ষে ডেঙ্গুতে বছরে কত লোক মারা যায়, ম্যালেরিয়াতে, টিবিতে কত লোক মারা যায়, তার খবর কি আমরা রাখি? লক্ষাধিক লোক মারা যায় এসব রোগে কিন্তু, আমরা মাথাও ঘামাই না। তাহলে করোনা নিয়ে এত ভীত সন্ত্রস্ত কেন? কারণ, রোগটা নতুন, অসম্ভব ছোঁয়াচে এবং এখনো পর্যন্ত এর কোনো ওষুধ বা প্রতিষেধক নেই বলে।
বাড়ির সব মেম্বাররা সারাক্ষণ বাড়িতে থাকলে খুঁতগুলো প্রকট হয়ে পড়ে। আমি আবার একটু খুঁতখুঁতে। জায়গার জিনিস জায়গায় না থাকলে মাথাটা গরম হয়। আর বাকিদের বক্তব্য, এই এমার্জেন্সিতে ঘর গোছানো বন্ধ রাখো দয়া করে। আরো বেদনাদায়ক, দু-চার কথাও শুনিয়ে দিচ্ছে। সেই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে, ‘ইস্, আমাকে করোনা ধরলে বেশ হত। মরে যেতাম, বুঝত তখন!’ পর মুহূর্তেই ক্ষমা চাইছি ঈশ্বরের কাছে, ‘ক্ষমা করো প্রভু, বোকা মানুষ, কি বলতে কি বলে ফেলেছি। ফিরিয়ে নিলাম আমার প্রার্থনা।’ কেন ফেরালাম? কারণ, করোনা শুধুমাত্র আমাকে মারবে না, শেষ করে দেবে আমার পরিবারকে, আমার কাছাকাছি থাকা আরো অনেককে। আমি হত্যাকারী হতে চাই না। থাক বাবা, সাবধানে থাকি সকলে মিলে। বাঁচুক আমার পরিবার, পাড়া পড়শী, শহর, রাজ্য, দেশ।
আমি একটু হালকা চরিত্রের মানুষ। বেশিক্ষণ গম্ভীর চিন্তা করতে পারিনা। তাই এরপরেই মাথায় এল, একদিকে ভালোই হয়েছে, কত বছর পর পুরো পরিবার একসঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছি, নেটফ্লিক্স, হইচই ইত্যাদিতে মুড়িমাখা খেতে খেতে সিনেমা দেখছি। এতো ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল এযাবতকাল। বেশ লাগছে কিন্তু।
কত পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে কথা বলছি, কাজের চাপে যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করাই হয়ে উঠত না। আমাকেও অনেকে ফোন করছে, খুব ভালো লাগছে। পাশের ভাঙা বাড়িটায় গজানো অশ্বত্থ গাছে বসে কোকিল ডাকছে, দুটো বুলবুলি তুমুল খেলা করছে। ওরা হয়তো আগেও ডেকেছে, খেলা করেছে, আমিই সময় পাইনি শোনার বা দেখার। তক্ষুণি মনে হল, তাহলে কি ধরিত্রী-মা একটু গা ঝাড়া দিলেন!
প্রকৃতিকে যাচ্ছেতাই ভাবে ব্যবহার করা– গাছ কেটে, জলাভূমি বুজিয়ে, কংক্রিটের জঙ্গল বানিয়ে, যত্রতত্র জঞ্জাল জ্বালিয়ে, ধোঁয়া-ধুলোয় মিলিয়ে কী ভীষণ অত্যাচার চালাচ্ছি আমরা। প্রকৃতি তার শোধ নিচ্ছে বোধহয়, শুদ্ধিকরণ করছে নিজের। বাঁচা এবার নিজেদের, দেখি কত দম!
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে হয় আমি নির্বোধ, নয় নিষ্ঠুর। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো কী খাচ্ছে, কীভাবে আছে তার কোনো ভাবনা নেই? কেবল আমি ভালো থাকলেই হয়ে গেল?
ভেবে আমি সত্যিই কিছু করতে পারিনি জানেন। ভরসা রেখেছি সরকারি এমার্জেন্সি রিলিফ ফান্ড-এর ওপর। তাই ঘোষণা হবার সঙ্গে সঙ্গেই নিজের সাধ্যমতো কিছু টাকা দিয়েছি সেই ফান্ডে। অনেক মানুষ, প্রতিষ্ঠান, ক্লাব টাকা দিয়েছে। আশা করছি, গরিব মানুষগুলোর একটু সুরাহা হবে।
আর একটা কথাও ভেসে এল ভাবনার ঢেউয়ে– তপন কাকার মেয়ে পিঙ্কির এবার মনে হয় বিয়ে হয়ে যাবে। সেলসের কাজে বড্ড রোদে রোদে ঘুরতে হয় মেয়েটাকে। ময়লা মেয়ে রোদে পুড়ে ঝামাবর্ণ হয়ে যাওয়াতে পাত্রপক্ষ বাতিল করেছিল আগের বার। একুশদিন বাড়িতে থাকলে পোড়া ভাবটা অবশ্যই কেটে যাবে।
ওগো সুন্দরী করোনা, তুমি মোটেই অত খারাপ নও, আমি ঠিক বুঝেছি। এবার তোমার পালা সেটা প্রমাণ করার। শীতল হও, ফিরে যাও তোমার ঘরে, তোমার দেশে। স্বস্তিতে বাঁচুক মানুষ। বিপদমুক্ত হোক আমার ভালোবাসার পৃথিবী।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন

1 thought on “bibidho-sundori-corona

  1. চুমকি-ম্যাডামের “করোনা” নিয়ে এত সুন্দর লেখা… এত সাবলীল এবং স্বল্পকথায় সমস্ত প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোর উল্লেখ… আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি! মুগ্ধ হওয়ার কারণ অবশ্যই হালকা চালে এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-কে অভিনব দৃষ্টিভঙ্গিতে চুমকি ম্যাডামের এমন অনন্য পরিবেশন…কোথাও যেন সূক্ষ্ম satire-ও মেশানো আছে! এমন একটি লেখা উপহার দেওয়ার জন্যে চুমকি-ম্যাডামকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

Leave a Reply to দেবব্রত দাশ, লেখক। Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *