রম্যরচনা
উল্লাস মল্লিক

একটা সময় ছিল, যখন, ক্যামেরাম্যান দেখলে পাড়াগেঁয়ে লোকজন হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। স্টুডিও ছাড়া গ্রাম মফস্বলে গুটিকতক মানুষের থাকত ব্যক্তিগত ক্যামেরা। তাদের বেশিরভাগই সম্পন্ন পরিবারের। এবং শখদার। বাড়িতে বন্দুক থাকলে পাড়া-প্রতিবেশী যেমন সম্ভ্রমের চোখে তাকাত, ক্যামেরার বেলাতেও তাই। কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে বেরোলে মানুষজন এমনভাবে তাকাত যেন দেবদূত।
আমার বন্ধু বঙ্কু। বঙ্কুর ছোটকাকা কল্যাণ। কল্যাণকাকা কোলকাতার অফিসে ভাল চাকরি করত। একটা ক্যামেরা ছিল তার। পাড়ায় যেহেতু কল্যাণ নামে আর একজন ছিল তাই বঙ্কুর কাকার নাম হয়ে গিয়েছিল ক্যামেরা কল্যাণ। কল্যাণকাকা ছিল সৌখিন মানুষ। সবসময় ইস্ত্রি করা জামাপ্যান্ট, পালিশ করা জুতো, চকচকে কামানো গাল, সরু গোঁফ।
এই পোষাকেই মাঝে মাঝে ক্যামেরা নিয়ে বেরোত। হাঁ করে তাকিয়ে থাকত লোকজন। মনে হত, মানুষটি এই ধুলো-ধোঁয়া, মশা-আবর্জনা, ম্যালেরিয়া-কলেরা কবলিত দুনিয়ার মানুষই নয়। ওপর থেকে নেমে এসেছে, টুক করে কিছু দুর্লভ মুহূর্তকে ওই বিস্ময়কর যন্ত্রটার মধ্যে বন্দি করে আবার চলে যাবে।
বঙ্কুর সঙ্গে বন্ধুতা পাতিয়েছিলাম স্রেফ ওর কনিষ্ঠ খুল্লতাতর কারনে। আরও নিখুঁত করে বললে ওই আশ্চর্য যন্ত্রটার জন্যে। ওর চিরকুমার কাকার ঘরে আলমারি–বন্দি থাকত ক্যামেরাটা। আলমারির পাল্লা ছিল কাচের। কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখতাম। দেখার শখ ছিল খুব। কিন্তু মাঝে মাঝে কেমন যেন গা ছমছম করে উঠত। মনে হত সামনের ওই লেন্স আমার ভেতরের যত সব বজ্জাতি দেখে ফেলছে।
যাই হোক, কিছুদিনের মধ্যেই আমার এই আসক্তির কথা বুঝে গেল বঙ্কু। একদিন গেছি ওদের বাড়ি, যথারীতি ক্যামেরা দেখার লোভে, ও আমাকে ফিসফিস করে বলল, জানিস তো, কাকার ঘরে যে আমরা ঢুকি সেটা কাকার পছন্দ নয়। তাই দরজায় তালা দিয়ে গেছে।
শুনে বেশ ভেঙে পড়লাম। দেখলাম, সত্যিই দরজায় তালা।
ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসছি, পিছন থেকে ডাকল বঙ্কু। একটা সেটিং–এর প্রস্তাব দিল। মোদ্দা কথা এই যে, চাবি কোথায় আছে সে জানে, এক প্লেট আলুকাবলি খাওয়ালে, ক্যামেরা দেখার ব্যবস্থা করতে পারে। রাজি হয়ে গেলাম।
সেটাই বহাল হয়ে গেল। মাগনাতে ক্যামেরা দেখা বন্ধ। যাই হোক, বেশ চলছিল, আলুকাবলির বিনিময়ে ক্যামেরা। ক্যামেরা দেখতাম আর ভাবতাম, আমারও দু’দুটো কাকা। এক জনেরও কি ক্যামেরা থাকতে নেই! কিন্তু দুজনেই বেকার। বেকার লোকের কি ক্যামেরা থাকে! কিন্তু বেকারই বা হয়ে আছে কেন! একটা চাকরি বাকরি তো করতেই পারে। দাদু তো মাঝে মাঝেই বলেন, ওরে তোরা একটু উঠে লাগ, বয়েস বয়ে যাচ্ছে, এরপর আর চাকরি বাকরি পাবি না। সেইজন্যেই আমি ঠিক করেছি, পড়াশোনা শেষ করে একদিনও বেকার থাকব না। আর বেতন পেয়ে প্রথমেই একটা ক্যামেরা কিনে নেব। সেই সময় একটা গুপ্ত আশা মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করত, আমি আমার দুটো কাকাকে ক্যামেরা সমেত বঙ্কুর একটা কাকার সঙ্গে বদলা বদলি করতে রাজি। কিন্তু যে কোনও কারনেই বঙ্কুকে এই এক্সচেঞ্জ অফারটা দেওয়া হয়নি।
সেই সময় অবিবাহিত মেয়েরা স্টুডিওয় যেত ছবি তোলাতে। বলাবাহুল্য, সে ছবি বিয়ের জন্যে তোলা। দেখাশোনার প্রথম পর্বে ছবি আদান প্রদান। ছবি দেখে পছন্দ হলে তবেই পাত্রপক্ষ যেত মেয়ের বাড়ি ইন্টারভিউ নিতে। সেদিন মেয়েরা বেশ চাপে থাকত। ছবি উতরে গেছে। কিন্তু সে তো একটা মাত্র লেন্স একটা অ্যাঙ্গল থেকে দেখেছে তখন। কিন্তু আজ চার পাঁচ জোড়া লেন্স, যেগুলো নাকি অনেক বেশি শক্তিশালী ক্যামেরার লেন্সের থেকে, পর্যবেক্ষণ করবে তাকে। তারপর ধেয়ে আসবে চোখা চোখা প্রশ্ন।
অনেক সময় মেয়েদের একাধিকবার স্টুডিওয় যেতে হত। স্টুডিওগুলোর নাম হত আলেখ্য, মোনালিসা, প্রতিচ্ছবি, নান্দনিক– এই জাতীয়। ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল মোটামুটি বাঁধাধরা। হয় পাহাড়, নয় ঝরনা কিংবা দিঘি। কখনও আবার ফুলের বাগান। একই ছবি বারবার প্রত্যাখ্যাত হলে পাত্রীপক্ষ ভেবে নিত ছবিটা ঠিক জুতের ওঠেনি। অগত্যা নতুন ছবি। ব্যাকগ্রাউন্ডে পাহাড়টা ফুলের বাগান হয়ে যেত অথবা সমুদ্র সৈকত। কখনও আবার স্টুডিও-ও বদলাত। ওই স্টুডিওটা ঠিক পয়া নয়। ওখান থেকে এতবার তোলা হচ্ছে, একজনেরও পছন্দ হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে স্টুডিও বদল।
ময়নাদির কথা মনে পড়ে গেল। ময়নাদিকে দেখতে মোটামুটি। রঙ একটু চাপা। তার চাইতেও বড় অপরাধ তারা গরীব। বাবা একটা মুদির দোকানে মাল ওজন করে। নগন্য বেতন। ছবি দেখে অনেকে পছন্দ করত। দেখতে আসত। মিষ্টিমুখ করত। কিন্তু ওই পর্যন্তই। যাবার সময় বলে যেত, পরে খবর দেব। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন পাত্রপক্ষের এই “পরে খবর দেব” প্রতিশ্রুতিটা ভারি গোলমেলে। অনেকটা আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিশ্রুতির মতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরে আর কোনও খবর আসে না। ময়নাদির বেলায় ঠিক এমনটাই হচ্ছিল। বার বার সেজেগুজে বসা, পাত্রপক্ষকে মিষ্টি-আপ্যায়ন, তারপর সেই গোলমেলে প্রতিশ্রুতি। মিষ্টির জন্যে খরচ আর ময়নাদির বয়েস বেড়ে যাওয়া ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হচ্ছিল না।
তখন ময়নাদি একটা বৈপ্লবিক কান্ড করে বসল। স্টুডিওয় গিয়ে নতুন একটা ছবি তোলাল। খুব একটু অন্যরকম ছবি। ময়নাদি একপ্লেট মিষ্টি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর থেকে কেউ ছবি চাইলে, এই ছবিটা দিয়ে ময়নাদি বলত, পাত্রপক্ষকে বলবেন, মেয়ে দেখার সঙ্গে মিষ্টি খাওয়াটাও সেরে নিতে। চা-টা বাকি থাকল, বাড়িতে যদি আসেন, চা পাবেন।
বিয়ের যেটুকু আশা ছিল, এরপর, বলাবাহুল্য, সেটাও গেল। তাতে এতটুকু বিচলিত হল না ময়নাদি। নিজের উদ্যোমে হাতে তৈরি বড়ি আর আচারের ব্যবসা শুরু করল। সেই ব্যবসা বাড়ল দিনে দিনে। এখন অনেকগুলো মেয়ে ময়নাদির আন্ডারে কাজ করে। খুব সুন্দর দোতলা বাড়ি করেছে সে। বাবাকে আর কাজে যেতে দেয় না। সাদা কালো সেই মিষ্টি হাতে ছবি বড় করে বাঁধিয়েছে ময়নাদি। ময়নাদির শোবার ঘরের দেওয়ালে সদর্প অবস্থান তার। ঢুকলেই আগে চোখে পড়ে।
একসময় বিয়ে বা কোনও অনুষ্ঠানে ফটোগ্রাফাররা ভি.আই.পি মর্যাদা পেত। বিশেষ করে ইয়াং জেনারেশনের কাছে। তারপর ক্যামেরাম্যান যদি স্মার্ট আর নজরধরা হত তাহলে তো ঘুঘনির ওপর ধনেপাতা। ক্যামেরা হাতে মানুষটার দিকে সবার বিস্ময় দৃষ্টি। তখন ডিজিটাল যুগের অনেক দেরি। ক্যামেরায় রিল ভরে ছবি তুলতে হত। গোনাগুনতি ব্যাপার। যতদূর মনে পড়ে, রিল প্রতি বত্রিশ থেকে চৌত্রিশটা ছবি উঠত। তার মধ্যে সুন্দরীদের আব্দার। আব্দার মেটাতে গিয়ে প্রেম টেমও হয়ে যেত কখনও।
যেমন, শুভময়দা। একটা বিয়েবাড়িতে ছবি তুলতে গিয়ে শিপ্রাদির সঙ্গে পরিচয়। শিপ্রাদির কতগুলো একক ছবি তুলে দিয়েছিল শুভময়দা। শিপ্রাদিও দুর্দান্ত সব পোজ দিচ্ছিল। ক’দিন পর ছবি আনতে শুভময়দার স্টুডিওয় গেল শিপ্রাদি। কিছুতেই টাকা নিল না শুভময়দা। শিপ্রাদি কিন্তু অনেকবার অনুরোধ করেছিল। শুভময়দার একটাই কথা, আরে, ছাড়ুন না, সামান্য তো দুটো ছবি: আমাদের মাঝে মধ্যেই অমন তুলতে হয়। নিরুপায় শিপ্রাদি বড়সড় একটা ধন্যবাদ জানিয়ে চলে আসছিল। কথিত আছে, সেই সময় শুভময়দা গেয়ে উঠেছিল– তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা….!
এমত অবস্থায় শুধু জ্যান্ত মানুষ কেন, পটে লেখা ছবিও টাল খেয়ে যাবে। শিপ্রাদিও গেল। তারপর শুভ লগ্ন দেখে ….
বিয়ের পর শিপ্রাদি একটা কঠিন ফতোয়া চালু করল। আসলে সেদিন স্টুডিওতে কথা বলার সময় শুভময়দার একটা মন্তব্য কানে লাগে শিপ্রাদির। ‘আমাদের তো মাঝে মধ্যেই অমন তুলতে হয়।’ ফুলশয্যার দিন রাতেই শিপ্রাদি সোজা জানিয়ে দিল, শোন, বাড়তি ছবি যা তোলার তুলেছ; আর একটাও বাড়তি ছবি নয়। আমি কিন্তু রিল চেক করব।
তবে সব ফটোগ্রাফারদের কপালে এমন শুভযোগ নাও ঘটতে পারে। যেমন হয়েছিল আমাদের বিপুলের বেলায়। বিপুলের বাবার একটা স্টুডিও ছিল। নামটি চমৎকার। অপ্সরা। একদিন একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে ছবি তোলার কথা ছিল বিপুলের বাবার। কিন্তু সেদিন দুপুরবেলা বাথরুমে পিছলে পড়ে পা মচকাল তাঁর। ক্যামেরার হাত মন্দ ছিল না বিপুলের। অগত্যা তাকেই যেতে হল। কিন্তু সেখানে মেয়ের বাবা প্রথমেই বলে দিলেন, দেখ ভাইপো, বয়েসটা তোমার নেহাতই কম; যাকে বলে একেবারে কাঁচা বয়েস। মেয়েরা কিন্তু ছিনে জোঁকের মতো ধরবে তোমাকে। তুমি যেন গলে গিয়ে খচাখচ ছবি তুলে দিও না। যে ছবিই তোল না কেন, সেখানে যেন বর কনে থাকে। তার বাইরে একটা ছবিরও পয়সা পাবে না।
ফলে বেশ কিছু মেয়ে ঘুরঘুর করলেও কিছু করার ছিল না বিপুলের। হতাশ সুন্দরীর দল শেষ পর্যন্ত ঠাট্টা করতে লাগল বিপুলকে লক্ষ্য করে। কেউ বলল, ক্যামেরাম্যানের রিল শেষ, কেউ বলল, আমরা যা সুন্দরী; ক্যামেরাম্যানের চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। মুখ বুজে সব সহ্য করে যাচ্ছে বিপুল। রাত বাড়ছে, খিদে পেয়েছে, কেউ খেতেও বলছে না। আমন্ত্রিতরা বিদায় নিচ্ছে। বিপুলের আশঙ্কা হচ্ছে, ভাঁড়ারে বুঝি কিছু অবশিষ্ট নেই। এই সময় মেয়ের বাবা হাঁক দিল, ভ্যানওলা রিক্সাওলা জেনারেটরওলা ফটোওলা সবাই এবার বসে যাও।
তারপর থেকে আর কখনও কোনও বিয়েবাড়িতে ছবি তুলতে যায়নি বিপুল। বাবাকে স্ট্রেট বলে দিয়েছিল, এরপর তোমার হাত পা মাথা যাই ভাঁঙুক না কেন, তুমি অন্য ব্যবস্থা করবে; আমি আর ওসবে নেই।
এবার প্রতিমা জেঠিমার কথা। জেঠিমা ছবি তুলতেন না। আরও পরিষ্কার করে বললে, তুলতে দিতেন না। শত অনুরোধেও রাজি করানো যায়নি তাঁকে। মন্টুজেঠুর সঙ্গে জেঠিমার বিয়ে হয়েছিল বহু বছর আগে। বিয়ের মাসছয়েক পরেই অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান জেঠু। জেঠিমা ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী। শোনা যায়, জেঠিমার বাপের বাড়ির লোকজন জেঠিমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। জেঠিমা রাজি হননি। বিয়ের কোনও ছবি ছিল না জেঠিমার। তখন বিয়েবাড়িতে ছবি তোলার এত রেওয়াজও ছিল না। বিয়ের মাস দু’য়েক পর নান্দনিক স্টুডিওয় গিয়ে দুজনে ছবি তুলেছিলেন একটা। সাদা কালো ছবি। জেঠিমার সিঁথিতে কুমকুম দিয়ে আঁকা লাল সিঁদুর। কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটা দেওয়ালে ঝোলাননি জেঠিমা। একটা টেবিলের ওপর রেখে দিয়েছিলেন। রোজ পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছতেন। আর কেউ ছবি তোলার কথা বললে বলতেন, ছবি তো জীবনে একবারই একজনের সঙ্গে তুলেছিলাম আমি। সেই প্রথম, সেই শেষ। তাকে ছাড়া আমি আর ছবি তুলতে পারব না।