binodan-aadda-rudranil

সোজাসাপটা রুদ্রনীল
কথা বললেন স্বাতী চ্যাটার্জী ভৌমিক

ছবি: গার্গী মজুমদার

বর্তমান সময়ের অন্যতম শক্তিশালী অভিনেতা, যিনি বরাবরই থেকেছেন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে, সুদর্শন না হয়েও যিনি ছবির মুখ্য চরিত্রে সকলকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিতে পারেন। তিনি রুদ্রনীল ঘোষ। শুরু থেকেই তাঁর কেরিয়ারগ্রাফ প্রায় একইরকম ঊর্ধ্বমুখী। কোন বিতর্কের আঁচ কখনো তিনি তাঁর অভিনয়ের গায়ে লাগতে দেন না। ২০০৫ থেকে শুরু করে ক্রমশ ‘চলো লেটস গো’, ‘তিন ইয়ারি কথা’, ‘কালের রাখাল’, ‘চ্যাপলিন’, ‘অ্যাকসিডেন্ট’, ‘হাওয়া বদল’, ‘ভিঞ্চিদা’ দিয়ে একটু একটু করে বাংলা ছবির তারকা অভিনেতাদের দলে নাম লিখিয়েছেন তিনি। সামনাসামনি সেই মানুষটা কিন্তু আর পাঁচটা সাধারণ বাঙালীর মতোই। এক শীতের সকালে আড্ডার মেজাজে পাওয়া গেল তাঁকে, প্রায় ঘন্টাখানেক নানা বিষয়ে জমিয়ে গল্প করলেন বাংলা ছবির প্রথম ‘চ্যাপলিন’ রুদ্রনীল।

প্রশ্ন: ২০২০ সালটা আমাদের সকলেরই দুঃস্বপ্নের মতো কেটেছে। তোমার মতো তারকা যারা তাদের জীবন তো আমাদের মতো নয়। তোমার কেমন কেটেছে বছরটা? লকডাউন কতটা প্রভাব ফেলেছে তোমার জীবনে?
রুদ্রনীল: সকলের মতোই আমারও রোজগার বন্ধ হয়েছিল। তবে কাজ বন্ধ হয়নি। ছোটবেলা থেকেই আমি নানারকম সোশ্যাল ওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত থাকি। সেই সময় একদিকে যেমন গ্রামে গ্রামে আমফানের ত্রাণের কাজ করেছি আবার শহরেও মেডিকেল কিট দিয়েছি লোকজনকে। তাই কাজ সেই অর্থে না থাকলেও একেবারে বাড়ি বসে যে কাটিয়েছি তা নয়। এছাড়া বাড়িতে থাকলে সকলে যা করে আমিও তাই করেছি। রান্নাবান্না করেছি, আবার লেখালেখিও করেছি। আর লকডাউনের প্রভাব হিসেবে বলবো যার যেমন আয় তার তেমন জীবনধারণ। অর্থাৎ আমাদের আয় দেখেই আমরা ঠিক করি কিভাবে জীবন কাটাবো। তাই কাজ বন্ধ থাকা মানে সকলেরই ক্ষতি। আর তাছাড়া আমাকে ঘিরে তো কিছু মানুষের জীবন জীবিকা নির্ভর করে। সেটা আমাকে দেখতে হয়। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছে যেখানে মানুষ কাজে যেতে পারছেন না। কাজে না গেলে মানুষ খাবে কী? সকলের পক্ষে স্বাভাবিকভাবেই ওয়ার্ক ফ্রম হোম করা সম্ভব নয়। আমার দেশে বেশিরভাগ কাজের ক্ষেত্রেই সেটা অসম্ভব ব্যাপার। ওটা একটা প্রচারের ঢক্কানিনাদ মাত্র। এ দেশে খুব সামান্য সেক্টরেই ওইভাবে কাজ করা যায়। বেশিরভাগ মানুষেরই কাজের জায়গায় না গেলে কাজটা হয় না। আমাদের ক্ষেত্রেও তো তাই। আনলক হবার পরেও আমাদের অনেকেরই হাতে কোন কাজ ছিল না। কাজ না থাকলে যে কোন মানুষের সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক।

প্রশ্ন: তোমার প্রথম দিককার জীবন সংগ্রামের কথা তুমি অনেক জায়গাতেই বলেছ। একটা সময় তুমি নিয়মিত চিত্রনাট্য লিখতে, সেখান থেকে অভিনেতা হবে কখন ঠিক করলে?
রুদ্রনীল: সবাই কি প্ল্যান করে কিছু হতে পারে? আমাদের মতো দেশে শুধু শিল্প করে একজন বাঁচবে এটা ভাবা সবচেয়ে বড় স্পর্ধার। আমি অভিনেতা হয়ে গেছি, কোন পরিকল্পনা ছিল না। বাবা মা ছেলেমেয়েকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার লইয়ার বানাতে চায়। কেউ খুব একটা বলেন না আমার সন্তান শিক্ষক হবে। আর কেউ কখনোই বলেন না আমার সন্তান শিল্পী হবে। কারণ তারা জানেন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হলে তার রোজগারটা নিশ্চিত হবে। কিন্তু শিল্পী হলে তো সে না খেতে পেয়ে মারা যাবে। এটাই দেখে আসছে সকলে। আমার বাবা মা শিক্ষক ছিলেন। বাবা পেইন্টারও ছিলেন সেই সঙ্গে। কিন্তু তারাও ভাবেননি আমি শিল্পী হবো। শিল্পী হতে অনেকেরই ইচ্ছে হয়, কিন্তু কে সফল হবেন আর কে হবেন না সেটা তো আগে থেকে জানা সম্ভব নয়। পৃথিবীতে এমন মানুষ খুব কম আছেন যারা নিজের ভালবাসার জায়গাটাকে পেশা করতে পারেন। খুব ভাগ্যবান মানুষ এরা। আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই যে আমি যেটা করতে সবথেকে ভালবাসি সেটাই আমি পেশা হিসেবে পেয়েছি এবং সেটা দিয়ে আমার পেট চলে যায়। তবে সেটা নিয়ে কোন পরিকল্পনা ছিল না কোনদিনই। যোগাযোগটা ঘটে গেছে।

প্রশ্ন: শিল্পের ক্ষেত্রে প্রফেশনালিজম নাকি আবেগ, কোনটা বেশি জরুরী বলে তোমার মনে হয়?
রুদ্রনীল: শিল্পী কখনো ১০০% প্রফেশনাল হতে পারে না। কারণ শিল্পীরা মেপে কাজ করতে পারে না। আমাদের তো আর মাইনে হয় না। যেখানে মাইনে বেঁধে কাজ হয়, যেমন টেলিভিশনে কিছু জায়গায় হয়, সেখানে শিল্পীর মুক্তি নেই। এভাবে সময় মেপে শিল্পী কাজ করবেন কীভাবে? আমরা কিন্তু জানি না কোন মাসে কত টাকা পাবো। কখনো কাজ উপচে পড়ে আবার কখনো দিনের পর দিন কাজ থাকে না। অনেক সময়েই দেখা যায় কোন পরিচালক খুব আন্তরিকতার সঙ্গে একটা কাজ করতে চাইছেন, অথচ আমাকে নেবার মতো আর্থিক সঙ্গতি তার নেই। কিন্তু আমি জানি ও কাজটা অনেকের চেয়ে ভালো করবে। আমরা অনেকেই কত সময়ে সেখানে বিনা পারিশ্রমিকে বা অর্ধেক পারিশ্রমিকে কাজটা করে দিই। চূড়ান্ত প্রফেশনাল হল তো এটা হতো না। এখানে আবেগটাই আসল। তাই সেই অর্থে এটা প্রফেশনও না। আমি বলবো ভালবাসা। আবেগ না থাকলে শিল্পী হওয়া যায় না।

প্রশ্ন: তুমি যে সময়ে ছবিতে এসেছিলে তখন মূলধারার ছবি হতো নায়ক-নায়িকা নির্ভর। নায়কের ভূমিকায় দেব, জিৎ, সোহমরা থাকতেন। সেখান থেকে এখন চিত্রনাট্যনির্ভর ছবিতে অনির্বাণ, ঋত্বিক, পরমব্রত, তুমি ছবির মেইন লিড হিসেবে উঠে এসেছো। এটা যে কোনদিন সম্ভব হবে সেই সময় ভাবতে পেরেছিলে?
রুদ্রনীল: এই সময়ের স্বপ্নটাই তো আমরা দেখতাম। আমি, পরমব্রত(চট্টোপাধ্যায়), রাজ(চক্রবর্তী) আমরা সবাই। সেই ‘চ্যাপলিন’-এর সময় থেকে। আজকের এই সময়টা নিয়ে আসার মূল কর্মী তো আমরাই ছিলাম। মানুষ যেমন জিনিস পাবে তার মধ্যে থেকেই তো সে নির্বাচন করবে কোনটা ভালো আর কোনটা নয়। দিনের পর দিন ঝকঝকে প্যাকেটে কৃত্রিম পনির নেবে নাকি কলাপাতায় মুড়ে খাঁটি দুধের ছানা নেবে সেটা দর্শককে ঠিক করতে হবে। সবটা দেখলে তবেই তো তারা ভালটা নেবে। মানুষের কাছে সেই বেছে নেবার সুযোগটাই ছিল না। যখন এলো তখন তারা ভালোটা নিয়েছে বলেই ছবির ধরণ পাল্টেছে, আরো পাল্টাচ্ছে।

প্রশ্ন: ‘ভিঞ্চিদা’ তোমার কেরিয়ারে বড় সাফল্য এনে দিয়েছে। এই গল্পটা লেখার পিছনে আসল গল্পটা কী ছিল?
রুদ্রনীল: ২০১৬তে একটা ছবির শুটিং করছিলাম। আমার বন্ধু মেকআপ আর্টিস্ট সোমনাথ কুণ্ডু সেই ছবিতে আমার একটা বিশেষ মেকআপ করেছিল। আগুনে পুড়ে যাওয়া বিধ্বস্ত একটা চেহারার মেকআপ। সেটার জন্য প্রস্থেটিক করতে হয়েছিল। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় দিয়ে একেবারে বাস্তব একটা পুড়ে যাওয়া শরীরের মেকআপ নিয়ে আমি যখন সেটে গেলাম তখন আমাকে এতটাই বীভৎস দেখতে লাগছে যে পরিচালক সামনে থেকে সেই দৃশ্যের টেক করতে চাইলেন না। কারণ ছবিতে ওই চেহারা দেখালে হয়তো ছবিটা A তকমা পেয়ে যাবে। ওই মেকআপ দেখলে মানুষ ভয় পাবেন। তখন ওই দৃশ্যটা দূর থেকে তোলার ব্যবস্থা করা হয়। উপায়ও ছিল না, ছবিতে A রেটিং থাকলে মানুষ বাচ্চাদের নিয়ে হলে আসবেন না। পরিবার নিয়ে দেখা না গেলে সেই ছবি মার খেয়ে যাবে। সেই মেকআপ তুলতে সময় লেগেছিল আড়াই ঘণ্টা। সেদিন মেকআপ তোলার সময়ে আমি সোমনাথের চোখে জল দেখেছিলাম। এত মন দিয়ে ও কাজটা করেছিল সেটা কাউকে দেখাতে না পারার যন্ত্রণা আমি ওর মধ্যে দেখেছিলাম। তখন মনে হয়েছিল একজন শিল্পী যে একজন মানুষকে সম্পূর্ণ অন্য মানুষের চেহারায় পরিবর্তিত করতে পারে সে যদি কখনো খারাপ মানুষের পাল্লায় পড়ে তবে কী হতে পারে? সেটা নিয়ে আমি একটা গল্প লিখি, নাম দিয়েছিলাম ‘শিল্পী’। আমার বন্ধু পরিচালক সৃজিত(মুখার্জী) খুব ভালো থ্রিলার ছবি বানায়। ও এই গল্পটাকে চিত্রনাট্যের রূপ দেয়। ছবিটা প্রচুর মানুষ দেখেছেন, তারা সোমনাথ কুন্ডুকে চিনেছে, ওর পরিশ্রমটা বুঝেছে।

প্রশ্ন: ব্যর্থতা মানুষকে অনেক কিছু শেখায়। পরিচালক বুদ্ধদেব দাসগুপ্তর ‘আনোয়ার কা আজব কিসসা’ থেকে তোমাকে না জানিয়ে বাদ দেওয়ায় একটা সময় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলে তুমি, এটা তুমি আগেও বলেছ। সেই চরিত্রে নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকি অভিনয় করেন। তোমাকে বাদ দেবার কারণ কী ছিল বলে তোমার মনে হয়? এরকম ঘটনা যদি আবারও ঘটে তাহলে কি এখনো একইরকম খারাপ লাগবে?
রুদ্রনীল: না, এটা আসলে প্রথম প্রেমে চোট পাওয়ার মতো। প্রথমবার ধাক্কাটা সহ্য করে নিলে তারপর আর সেটা অতটা কষ্ট দেয় না। কারণ ততদিনে বাস্তববোধটা তৈরি হয়ে যায়। ঘটনাটা এরকম ঘটলো যে আমার সঙ্গে কন্ট্র্যাক্ট সাইন হয়ে যাওয়ার পর ওই অভিনেতার একটা হিন্দী ছবি মুক্তি পায়। সেই ছবিটা ব্লকবাস্টার হিট করেছিল। নারীকেন্দ্রিক একটা ছবি। হয়তো পরিচালকের মনে হয়েছিল সেই খ্যাতিটা উনি কাজে লাগাবেন। ব্যাপারটা আর কিছুই না, আমার পরিবর্তে একজন শক্তিশালী অভিনেতা কাজ করবেন এতে আমার খারাপ লাগার কিছু নেই। তবে কন্ট্র্যাক্ট হয়ে যাওয়ার পর আমাকে না জানিয়ে সেটা বাতিল করায় আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। সেটা করে উনি কী পেলেন আমি জানি না। তবে আমার মতে কোন কাজের সঙ্গে চালাকি জড়িয়ে থাকলে তার ফল ভালো হয় না।

প্রশ্ন: ‘ভিঞ্চিদা’র পর তুমি ‘বিবাহ অভিযান’ ছবির গল্প লিখেছিলে। পরিচালক বিরসা দাসগুপ্তর সেই ছবিতে তুমি অভিনয়ও করেছো। কিন্তু ভিঞ্চিদার মতো থ্রিলারের পরে এরকম একটা স্ল্যাপস্টিক কমেডি গল্প কীভাবে আর কেন লিখলে?
রুদ্রনীল: দেখো, আমাদের এখানে দু’ধরণের দর্শক রয়েছেন। এক, যারা ভিঞ্চিদার মতো ছবি দেখতে পছন্দ করেন। আর দুই, যারা হার্ডকোর কমার্শিয়াল ছবি দেখতে চান। আমাদের কাছে দু’জনই মূল্যবান। আসলে এই মেইনস্ট্রিমকে বাঁচানো খুব দরকার। মেইনস্ট্রিম মানেই কিন্তু লাল প্যান্ট হলুদ জামা নয় বা চোখা চোখা সংলাপ নয়। মুম্বই কিন্তু তাদের মেইনস্ট্রিমকে বাঁচিয়ে রেখেছে। হয়তো তার রূপ বদলেছে। এখানেও আমাদের মনে রাখতে হবে বৃহত্তর পশ্চিমবাংলা আমাদের দর্শক। তারা কী চাইছেন সেটা আমাদের দেখতে হবে। শুধু শহরকেন্দ্রিক গল্পে তো ছবি হতে পারে না। মানুষের রুচি কিন্তু পাল্টাচ্ছে। গল্পটা আমি কিভাবে বলবো তার ওপরে নির্ভর করবে কোনটা আরবান ছবি হবে আর কোনটা মেইনস্ট্রিম হবে। দর্শক ভালো ছবি দেখছেন এটা এখন একটা ভালো দিক। যে ছবি বেশি সংখ্যক মানুষ দেখবেন সেটাই কমার্শিয়াল ফিল্ম। বহু মানুষ রয়েছেন যারা চাইছেন এই শহুরে ধাঁচের ছবির বদলে অন্য ধরণের ছবি হোক, সেটাই আমরা করতে চেয়েছিলাম। একটা ছক থাকে ছবির, সেটাকে আমরা উল্টে দিয়েছিলাম। যা যা ভাবছেন তা হবে না। এটা একটা পরীক্ষার মতো ছিল আমাদের কাছে, যে মানুষ কীভাবে নেয় দেখা যাক। ছবিটার সংলাপ কিন্তু এখনো লোকের মুখে মুখে ফেরে। তার মানে লোকের সেটা ভালো লেগেছে।

প্রশ্ন: অর্থাৎ তুমি দু’ধরণের ছবির ক্ষেত্রেই সমান সাবলীল?
রুদ্রনীল: আমি একজন অভিনেতা। যে কোন ধরণের চরিত্রে আমাকে কাজ করতে হতে পারে। যখন ‘রিফিউজি’ করেছিলাম প্রসেনজিতের সঙ্গে সেখানে আমার নেগেটিভ রোল ছিল, যার জন্য আমি মাথার চুল কামিয়ে ফেলেছিলাম। দর্শকরা সেখানে আমাকে পছন্দ করেছিল। ‘প্রলয়’তে আমার চরিত্রটাও লোকে মনে রেখেছেন। আর একটা ছবি ছিল ‘লাভ এক্সপ্রেস’। সেখানে আমি অটো চালক আর দেব প্যাসেঞ্জার। সেই ছবিতে আমার ‘সেটা বড় কথা নয়’, এই সংলাপটা তখন লোকের মুখে মুখে ঘুরতো। আমি যে কোন ভালো চরিত্র পেলেই করতে রাজি। মানুষ যেটা দেখতে চায় সেটা তাকে দেখাতে হবে।

প্রশ্ন: কিন্তু আগে বাংলা ছবির একটা ধাঁচ ছিল, যেটাকে তখন মেইনস্ট্রিম বলা হতো। সেই ধাঁচটাকে তোমরাই পাল্টে দিয়েছো, তাহলে আবার সেই পুরোনো ধারার মেইনস্ট্রিমকে ফেরাবার দরকার কি?
রুদ্রনীল: আমরা তো সেই মেইনস্ট্রিমে ফিরছি না। বরং তারা আমাদের সঙ্গে মিলছে। দেখবে এখনো বহু দর্শক গোবিন্দার গানে নাচতে ভালবাসে। বিশ্বকর্মা পুজো, কার্তিক পুজোয় মফঃস্বলে কী গান বাজছে তার থেকে বোঝা যায় সাধারণ মানুষ কী চাইছে বা কী ভালবাসছে।

প্রশ্ন: গতবছর লাকডাউনের সময় তোমার কবিতার ভিডিও খুব জনপ্রিয় হয়। কবিতা লেখা কবে থেকে শুরু করলে? বরাবরই কি এরকম স্যাটায়ারধর্মী কবিতাই লেখো তুমি?
রুদ্রনীল: কবিতা আমি বরাবরই আমার নিজের মতো করে লিখে এসেছি। কখনো পাবলিশ করার কথা মনে হয়নি। তবে স্যাটায়ারধর্মী যে লিখতাম তা নয়। যখন মানুষকে শোনাবার জন্য লিখলাম তখন মনে হলো মানুষ কখনোই জ্ঞান শুনতে চায় না। মানুষ বন্ধুত্ব চায়। এই কঠিন সময়ে সকলের জীবনই অনেক চড়াই উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় কারোর কাজ নেই, কেউ অসুস্থ, কারোর দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে। চারপাশে কী ঘটছে তারা তো সব জানেন। নতুন করে কী আর বলবো। বরং যদি মজার ছলে সেগুলো তাদের শোনানো যায় তাদের ভাষাতেই, তাহলে তারা বন্ধুর মতো সেটা শুনতে চান। লিখতে ভালো লাগে, তাই এরকম লেখা হয়তো আরো লিখবো।

প্রশ্ন: গতবছর হিন্দী ও বাংলা ছবির জগতে একটা শব্দ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। শব্দটা হলো ‘নেপোটিজম’। শব্দটায় তুমি কতটা বিশ্বাসী?
রুদ্রনীল: নেপোটিজম খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। কিন্তু শুধু নেপোটিজম দিয়ে কেউ বিখ্যাত হতে পারে এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। একটা উদাহরণ দিই – ধরো আমি এখান থেকে ধর্মতলায় যাব একটা ইন্টারভিউ দিতে। সেটা কীভাবে যাবো জানিনা। অটো বা বাসে যাবো, নাকি হেঁটে যাবো সেটা হয় আমাকে ঠিক করতে হবে নাহলে কেউ একজন বলে দেবে কিভাবে গেলে তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে। আমি নিজে গেলে রাস্তা খুঁজে নিয়ে যেতে হয়তো একটু বেশি সময় লাগবে, পরিশ্রম লাগবে। আর কেউ যদি আমাকে বলে দেয়, বা তার গাড়িতে করে ধর্মতলা অবধি পৌঁছে দেয় তাহলে আমার পৌঁছনোটা আরামে হলো। নেপোটিজম হলো ওই বলে দেওয়াটা বা পৌঁছে দেওয়াটা। কিন্তু ইন্টারভিউটা কেমন দেব সেটা আর নেপোটিজম দিয়ে হয় না। মানুষ কখনো অযোগ্য মানুষকে বার বার সুযোগ দেয় না। একবার সুযোগটা পেয়ে গেলে এরপরের সবটাই নিজের পরিশ্রম আর দর্শকের হাতে। কোটি কোটি টাকার লাভ লোকসান এমনি এমনি তো আসেনা। সেটা কেউ কাউকে পাইয়ে দিতে পারে না। যেদিন মানুষের নিজের রক্ত ও বন্ধুত্বের ওপর দুর্বলতা উঠে যাবে সেদিন নেপোটিজম উঠে যাবে বলে আমি মনে করি। চোখের সামনেই তো উদাহরণ আছে। মুম্বইতে যারা আজ তারকা, তারা কিন্তু কেউ নেপোটিজমের ফসল নয়। রাজকুমার রাও কে? নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি কে? পঙ্কজ ত্রিপাঠি, আয়ুষ্মান খুরানা কে? এরা কারা? এদের কোন আত্মীয় কোনদিন বলিউডে বিখ্যাত ছিল না। আবার অভিষেক বচ্চন, রণবীর কাপুর ভালো অভিনেতা হয়েও ক’টা কাজ পান? এদের বাবারা তো এতদিন ধরে বলিউডে রাজত্ব করে গেছেন। তাহলে এই প্রসঙ্গটা উঠছে কেন? আজ যখন আমি পুজোর জামাকাপড় কিনতে যাই সবচেয়ে দামী জামাটা কিন্তু কিনি আমার সন্তানের জন্য। আর সবচেয়ে কম দামীটা কিনি বাড়ির কাজের দিদির জন্য। সবাই এটা করে। এগুলো যেদিন থেমে যাবে সেদিন নাহয় নেপোটিজম নিয়ে কথা বলবো আমরা। নেপোটিজম থাকলে কঙ্গনা রানাওয়াত তৈরি হতো? এতগুলো ভালো দৃষ্টান্ত থাকতেও গুটিকয়েক খারাপ নিয়ে লোকে কেন মাথা ঘামায় আমি জানি না।

প্রশ্ন: গতবছর অনেক নামকরা মানুষ চলে গেলেন। তার মধ্যে অন্যতম অবশ্যই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ইন্ডাস্ট্রির এমন একজন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ চলে যাওয়ায় তোমার প্রতিক্রিয়া কী?
রুদ্রনীল: একের পর এক গুণী মানুষ চলে গেলেন গতবছর। তবে সৌমিত্রকাকুর সঙ্গে যেহেতু পরিচয় বেশি তাই ওঁর চলে যাওয়াটা নিশ্চিতভাবেই বেশি ধাক্কা দিয়েছে। ওঁকে নিয়ে একটা ওয়েব সিরিজ করার প্ল্যান ছিল আমার। এমন একটা চরিত্র আমি সৃষ্টি করেছিলাম যেটা উনি কখনো করেননি। সেটা নিয়ে খুব ইন্টারেস্টেড ছিলেন। আমি লন্ডনে চলে গেলাম শুটের কাজে। উনি বলেছিলেন ‘তুই ফিরে আয় তারপর এটা নিয়ে বসবো।’ এই জানুয়ারিতেই বসার কথা ছিল। সে আর হলো না।

প্রশ্ন: আর কোন জটিল প্রশ্ন নয়। এবার বরং কয়েকটা হালকা প্রশ্ন করা যাক। তোমার নিজের অভিনীত চরিত্রগুলোর মধ্যে যদি তিনটে চরিত্র বেছে নিতে বলা হয় তাহলে কোনগুলো বাছবে?
রুদ্রনীল: ‘চ্যাপলিন’ ছবির বংশীদাস। ‘প্রলয়’তে প্রশান্ত। আর ‘ভিঞ্চিদা’।

প্রশ্ন: এমন কোন চরিত্র আছে যেটা এখনো করা হয়নি, করতে পারলে ভালো লাগবে?
রুদ্রনীল: আমার খুব ইচ্ছে একজন বোবা কালা মানুষের চরিত্রে অভিনয় করার। কথা তো অনেক বলা হলো। এছাড়া ‘পিয়ানিস্ট’ ছবিতে একজন পিয়ানো বাদকের চরিত্র আছে। সেটা আমার খুব পছন্দের চরিত্র। ওটা করতে পারলে ভালো লাগতো।

প্রশ্ন: এই মুহূর্তে বাংলা ছবিতে তোমার প্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রী কারা?
রুদ্রনীল: প্রিয় অভিনেতা প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায়, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। প্রিয় অভিনেত্রী পাওলি দাম, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়।

প্রশ্ন: আর তিনজন প্রিয় পরিচালকের নাম বলতে বললে?
রুদ্রনীল: সৃজিত মুখার্জী, কৌশিক গাঙ্গুলী আর শিবপ্রসাদ মুখার্জী।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “binodan-aadda-rudranil

Leave a Reply to Subhanjan Bhaumik Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *