binodan-aatrangee-rey

ভালবাসার রঙে রঙিন মিষ্টি রূপকথা: আতরঙ্গী রে
ফিল্ম রিভিউ
স্বাতী চট্টোপাধ্যায় ভৌমিক


মাধ্যম: ডিজনি হটস্টার
পরিচালনা: আনন্দ এল রাই
অভিনয়ে: সারা আলী খান, ধনুষ, অক্ষয় কুমার, আশীষ ভার্মা, সীমা বিশ্বাস
দৈর্ঘ্য: ১৩৭ মিনিট

ইদানিংকালে সিনেমা দেখতে বসা মানেই এক ধরণের মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। ছবি মানেই হয় তা থ্রিলার হবে, কিংবা অ্যাকশনধর্মী। যুদ্ধের ছবিও হতে পারে, কিংবা হয়তো মার্ডার মিস্ট্রি। সম্পর্কের টানাপোড়েনের ছবি বা সামাজিক সচেতনতামূলক ছবিও হচ্ছে আকচার। এত গুরু গম্ভীর বিষয়ের ভিড়ে হালকা হাসি বা মিষ্টি ভালবাসার ছবি কবেই যেন গা ঢাকা দিয়েছে। তাহলে মানুষ কি আর ভালবাসে না? তার সব আবেগ কি এখন শুধু সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর? ভালবাসা-টালবাসা কি এখন তাহলে শুধুমাত্র একটা ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট? জীবনে কি তবে সবার উপরে সারকাজম সত্য তাহার উপরে নাই!


এইসব ভেবে যখন যারপরনাই বিরক্ত হয়ে আছি সেই সময়েই এই ছবিটা দেখার সুযোগ হলো। ছবির নামটা এমনই যে শুধু নাম দেখে কিছু ভেবে নেয়া মুশকিল। আতরঙ্গি মানে সোজা বাংলায় অতি রঙিন। তা কতটা রঙিন সেটা দেখার আশায় আগ্রহ নিয়ে বসে পড়লাম। ভূমিকার আড়ম্বরে পাঠক আবার এমনটা ভেবে বসবেন না যে এ ছবির কাহিনী খুব সহজ সরল। গল্প সহজ তো নয়ই, বরং ঘোরতর জটিল। দুর্বোধ্য মনস্তাত্বিক সমস্যার গল্প রয়েছে এ ছবিতে। কেমন সে গল্প, আর এতগুলো শব্দই বা ভূমিকায় খরচ করলাম কেন সে নিয়েই বরং আলোচনায় যাওয়া যাক।



রিঙ্কু পালায়। মানে প্রায়ই পালায়। সুযোগ পেলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে রিঙ্কু সূর্যবংশী(সারা) নামের আঠারো-উনিশের মেয়েটি। তারপর দৌড় দৌড় দৌড়। বাড়ি মানে তার দিদার(সীমা) বাড়ি। দিদা মামা মামী সকলেই চায় জোর করে রিঙ্কুর বিয়ে দিয়ে দিতে। কিন্তু রিঙ্কু প্রত্যেকবার তাদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যায়। বাড়িশুদ্ধু লোক তটস্থ হয়ে থাকে রিঙ্কুর ভয়ে। শেষে রিঙ্কুর হাত থেকে মুক্তি পাবার আশায় এক রাতে ধরে বেঁধে তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় ভেঙ্কটেশ বিশ্বনাথ আইয়ার, ওরফে বিষ্ণুর(ধনুষ) সঙ্গে। কেউই রাজি ছিল না বিয়েতে, তাই ওষুধ খাইয়ে আর লাফিং গ্যাস দিয়ে দুজনকে প্রায় অচৈতন্য করে চার হাত এক করে দেওয়া হলো। কিন্তু ট্রেনে করে দিল্লী যাবার সময় দুজনেই জানায় তাদের অন্য কাউকে পছন্দ করা আছে। বিষ্ণুর বিয়ে সামনেই, সেখানেই তার যাবার কথা ছিল। পাকেচক্রে সে এখানে এসে পড়েছে। অন্যদিকে রিঙ্কুরও আছে এক স্বপ্নের রাজকুমার। যার কারণে রিঙ্কু বার বার বাড়ি থেকে পালাবার চেষ্টা করে যায়। সাজ্জাদ আলী খান(অক্ষয়) নামে সেই অসাধারণ জাদুকর আর কিছুদিন পরেই দিল্লীতে আসছে, আর সে এসে রিঙ্কুকে নিয়ে যাবে। ভিন্ন ধর্মে ভালবাসার কারণে রিঙ্কুকে বাড়িতে কত অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে, সেই সব গল্প সে বিষ্ণুকে শোনায়। এরপর পাকেচক্রে একরকম রিঙ্কুর কারণেই বিষ্ণুর বিয়ে ভেঙে যায় ও বিষ্ণু আবিষ্কার করে সে রিঙ্কুকে ভালবেসে ফেলেছে। কিন্তু সাজ্জাদ আসছে, কাজেই রিঙ্কুকে বিদায় দিতে হবে এবার। এখানেই শুরু হয় আসল গল্প। যে সাজ্জাদ নেই সে কীভাবে আসবে? সাজ্জাদ আছে শুধু রিঙ্কুর পৃথিবীতে। সেখানে সাজ্জাদ হাসে, গান গায়, নাচে, আবার রেগেও যায়। শুধু তাকে আর কেউ দেখতে পায় না রিঙ্কু ছাড়া। ব্যাপারটা কীরকম? সমস্ত গোলমালের মূলে রিঙ্কুর মনোজগত। তার মনের ভেতর একটা আলাদা জীবন চলছে। রিঙ্কু একই সঙ্গে তার মনের ভেতরে ও বাস্তব পৃথিবীতে নিজের ভূমিকা পালন করে চলেছে। এক বিচিত্র মানসিক রোগে আক্রান্ত রিঙ্কু, যাকে OCD বা Obsessive compulsive disorder বলা চলে। আবার ট্রমাও বটে। রিঙ্কু আটকে রয়েছে তার ছোটবেলায়। নিজেকে মায়ের জায়গায় বসিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যেন তার মতোই হয়ে গেছে সে। তার জীবনের আদর্শ পুরুষ সাজ্জাদ। সেই সাজ্জাদ যাকে সে দেখেছে ছোটবেলায়। একটা আনন্দে পরিপূর্ণ সময় সে কাটিয়েছে মা বাবার সঙ্গে। আচমকা বাস্তবের অভিঘাতে সে জীবনটা হারিয়ে গেলেও রিঙ্কু যেন আটকে যায় সেই সময়ের জালে। ফলে তার কাছে সাজ্জাদ এক আদর আবদার ভালবাসায় ভরা মানুষ, যে রিঙ্কুকে সমস্তরকম অনিশ্চয়তা থেকে আড়াল করে রাখে। এক সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়।

ছবির বাকি পর্বে বিষ্ণু ও তার বন্ধু মানসিক চিকিৎসক মধু(আশীষ) মিলে রিঙ্কুকে সুস্থ করে তোলার আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে যায়। সে চিকিৎসা মেডিক্যাল সায়েন্স অনুযায়ী কতটা সঠিক সে তর্কে না যাওয়াই ভালো। কারণ দিনের শেষে সিনেমা একটা বিনোদন মাধ্যম। তাই বাকি গল্পটা পাঠকের নিজের বিচারের জন্য তোলা থাকুক, ডিজিট্যাল মাধ্যমে যে কেউ ছবিটা দেখে নিতে পারেন। বরং একটু আলোচনা করা যাক ছবির গল্প নিয়ে।

যুক্তি দিয়ে দেখলে এ ছবিতে প্রচুর খুঁত রয়েছে। রিঙ্কুর মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে তার মামারবাড়ির অজ্ঞতা আশ্চর্য করে। বিষ্ণুর হবু শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে রিঙ্কুর কান্ডকারখানা এবং এই সবকিছুর পরেও সেই রিঙ্কুকেই ভালবেসে ফেলা, মানসিক সমস্যা বিষ্ণুরও কি কম ছিল! বিষ্ণু যেখানে থাকে সেটা একটা বয়েজ হস্টেল। সেখানে কীভাবে একটা মেয়েকে সে দিনের পর দিন এনে রাখতে পারে তার কোন ব্যাখ্যা ছবিতে নেই।


রিঙ্কুর অসুস্থতা যে প্রথম বুঝতে পারে সেই মধু আসলে এক ডাক্তারি ছাত্র। সে কীভাবে নিজের দায়িত্বে রিঙ্কুর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারে! তাছাড়া শুধু ওষুধ খাইয়ে এত জটিল মানসিক সমস্যা কাটানো যায় এটা বিশ্বাস করা কঠিন। এ যেন সেই নব্বইয়ের বলিউডি ছবি যেখানে যে কোন অদ্ভুত গল্পকেই ‘এক দেশে একদিন এমনটাই ঘটেছিল’ যুক্তিতে মিলিয়ে দেওয়া হতো।


কিন্তু তবু, এত খুঁত সত্বেও মন কেড়ে নেয় রিঙ্কু আর বিষ্ণুর কাহিনী। রিঙ্কুর সহজ সারল্য আর প্রাণোচ্ছল হাসি এ ছবিকে এক অন্য মাত্রা দেয়। কিছুতেই যেন গম্ভীর হয়ে গল্পের যৌক্তিকতা বিচার করতে দেয় না। চিকিৎসা বিজ্ঞান হয়তো এ ছবিকে ছাড়পত্র দেবে না কিন্তু এ কথা তো সত্যি যে নিজে থেকে সুস্থ হতে না চাইলে কোন ওষুধেই মানসিক রোগকে সারানো সম্ভব নয়। যতদিন রিঙ্কু তার রোগ সম্পর্কে জানতো না বা যতদিন তেমন কোন ভালো লাগার মানুষ তার জীবনে আসেনি ততদিন সাজ্জাদ তার কাছে জীবন্ত ছিল। কিন্তু বিষ্ণুর সংস্পর্শে এসে, তার আন্তরিকতা দেখে, কোথাও যেন একটু দুর্বল হয়ে পড়ে রিঙ্কুও। যত যাই হয়ে যাক বিষ্ণু কোথাও তার বিবাহিতা স্ত্রীকে অপমানিত হতে দেয়নি, আজন্ম দিদার বাড়িতে হেলাফেলায় মানুষ রিঙ্কুর মনে বিষ্ণুর এই যত্ন আলাদা এক ভাল লাগা তৈরি করে। ক্রমশ বিষ্ণুর সঙ্গে মেলামেশা করতে গিয়ে তার মনেও এক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তবে কি সাজ্জাদ সত্যিই নেই? যদি থাকতো তাহলে সে বিষ্ণুর সামনে আসতো, তাকে বাঁচাতো। সামনে দাঁড়িয়ে সব দেখেও সে এগিয়ে এলো না কেন? রিঙ্কু যেন কাউকেই ফেলতে পারে না। তার সাজ্জাদকেও চাই আবার বিষ্ণু তার অন্যতম অবলম্বন। সাজ্জাদ রিঙ্কুর চিন্তায় সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু সে এমন কিছু করে না যা তাকে সকলের সঙ্গে করতে হয়। সে একা, সর্বত্র একা। রিঙ্কু ছাড়া সেই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কাকে বেছে নেবে রিঙ্কু? তার অবুঝ মন দুজনকেই চায়, কিন্তু কোথাও যেন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে যেতে থাকে একসঙ্গে দুজনকে পাওয়া যায় না। যে কোন একজনকে বেছে নিতে হবে রিঙ্কুকে। এই টানাপোড়েনে মিলিয়ে যায় রিঙ্কুর মুখের হাসি। জীবন জুয়ায় শেষ দান খেলে বিষ্ণু। হয় এসপার নয় ওসপার।


আগাগোড়া একটা আবেগপ্রবণ গল্পে নিজ নিজ যুদ্ধে রিঙ্কু ও বিষ্ণুর প্রাণপনে লড়ে যাওয়া মন কেড়ে নেয়। রিঙ্কুর মতো একটা আধপাগলী ও ছটফটে মেয়ের ক্রমশ পাল্টে যাওয়া, একটি কিশোরী মেয়ের মানসিকভাবে যুবতী হয়ে ওঠা পর্দায় ভারী সুন্দরভাবে ফুটিয়েছেন সারা। এই মুহূর্তে এই চরিত্রটি তাঁর চেয়ে ভালো আর কেউ করতে পারতো না। কারণ সারা ব্যক্তিগত জীবনেও এরকমই ছটফটে। তিনি এ ছবির প্রাণ। তাঁকে ছাড়া কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতো না রিঙ্কুর জীবনের আষাঢ়ে গপ্প। এ ছবি শুধুই ধনুষের হয়ে উঠতে পারতো। দক্ষিণের সুপারস্টার তিনি। অভিনয়ে রথী মহারথীদের টেক্কা দিয়ে থাকেন। তিনি অবশ্যই অসাধারণ। আন্ডারঅ্যাক্টিং তাঁর অন্যতম বড় অস্ত্র। সেই অস্ত্র দিয়ে বিষ্ণু এবারেও বাজিমাত করবে এ তো জানা কথা। তবে এ ছবি একা তাঁর এমনটা বলা যাবে না। সেই জায়গায় ভাগ বসিয়েছেন সারা।


এদের দুজনের দ্বিগুন বয়সের অক্ষয় অভিনয় করছেন তিন দশক ধরে। তবে ইদানিং পরের পর ছবিতে তাঁর একই ধরণের ওভারঅ্যাক্টিং একটু একঘেয়ে লাগছে। সেই ‘হেরাফেরি’র সময়ের অক্ষয়কে যেন আর মনেই পড়ে না। তাঁর স্ক্রিন প্রেজেন্স অনস্বীকার্য। বয়স ঢাকার চেয়ে একটু অভিনয়ে মন দিলে আরো বেশিদিন ইন্ডাস্ট্রিতে সসম্মানে টিকে যাবেন অক্ষয়।


সবশেষে বলতেই হবে গানের কথা। বহু-বহুদিন পরে আল্লারাখা (এআর) রহমানের সুরে একসঙ্গে এতগুলো ভালো গান পাওয়া গেল। গানের সুরে নব্বইয়ের ছোঁয়া কানের সঙ্গে মন মাতিয়ে দেয়। শ্রেয়া ঘোষালের গাওয়া ‘চকা চক’ আগেই জনপ্রিয় হয়েছিল। মন ছুঁয়ে যায় অরিজিৎ সিংয়ের কণ্ঠে ‘তুমহে মহব্বত হ্যায়’ ও ধনুষের গাওয়া ‘লিটল লিটল’ গানদুটিও। ছবির থেকে আলাদাভাবে শুনেও গানগুলো ভালো লাগতে বাধ্য। যেমন শ্রেয়া ঘোষাল ও হরিচরণের গাওয়া ‘মুরলি কি ইয়ে ধুন’ গানটি, বহুদিন মনে থেকে যাবে এমন ঝর্ণার মতো বয়ে চলা সেমি ক্লাসিকাল সুর।


বড় বেশি মগজের কথা ভাবতে গিয়ে মনকে যেন দিন দিন হারিয়ে ফেলছি আমরা। এই ছবি সেই মনের কথাই বলে। যুক্তি বুদ্ধি জ্ঞান একদিকে, আর আমাদের মনের খুশি মনের ইচ্ছে অন্যদিকে। সেই মনকেই খুশি করে দেয় রিঙ্কু আর বিষ্ণুর নব্য রূপকথা। সবসময় মাথার কথা না শুনে মনের কথাও তো শুনি আমরা। হলোই বা আবেগপ্রবণের আর এক নাম বোকা, তবু মাঝে মাঝে তা যুক্তি বুদ্ধিকেও ছাপিয়ে যায়। বেঁচে থাকুক পৃথিবীর সব বোকা বোকা ভালবাসাগুলো।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *