binodan-adolesence

নেটফ্লিক্স রিলিজ ‘অ্যাডোলেসেন্স’ রিভিউ 
ফিল্ম রিভিউ
সুরশ্রী ঘোষ সাহা

 

‘বয়ঃসন্ধিকাল’ যাকে ইংরেজিতে বলে ‘এডোলেসেন্স’ তা হল দশ থেকে উনিশ বছর বয়সের ছেলে-মেয়েদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের বিশেষ পর্ব। এই সময়ে কিশোর – কিশোরীদের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানের মধ্য দিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য গড়ে ওঠে। আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠারও এটাই মোক্ষম সময়। এমন মোক্ষম সময়ে বাবা – মায়ের ভূমিকাটাও তাদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাবারা তো বহু ছেলেদের কাছে আইডল হয়ে ওঠে। কিন্তু সকল বাবা – মা কি এই বয়সের ছেলে-মেয়েদের মনের খবর রাখেন? জানতে চেষ্টা করেন তার সন্তানের মধ্যে প্রতিনিয়ত কোন্ কোন্ স্বপ্ন গড়ে উঠছে আর ভাঙছে! কোন্ চোরা অন্তর্দ্বন্দ্বকে বুকে পুষে রেখেছে তার সন্তান! হয়তো খুব সহজেই ভেবে ফেলা যায় আমরা বড়রা সকলেই তো বয়ঃসন্ধিকাল পার করে এসেছি। এ আর নতুন কী সমস্যা! হ্যাঁ, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের সন্তানের বয়ঃসন্ধিকাল পার করার যে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, তা একেবারেই আলাদা ও নতুন। যুগ বদলের হাওয়া লেগেছে দুর্বার টালমাটাল এই যুগের কৈশোর কালের বয়ঃসন্ধিক্ষণে। আর তাকে নিয়েই নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে চার পর্বের মিনি সিরিজ ‘এডোলেসেন্স’। টানটান উত্তেজনায় ভরপুর বিষম দুশ্চিন্তার – দুর্ভাবনার – স্তব্ধতার এক সিরিজ। 

কাহিনি শুরু হয়েছে যে দৃশ্য দিয়ে তা হল, পুলিশ বাহিনী এক ভদ্রলোকের বাড়ির দরজা ভেঙে ঢুকে জেমি মিলার নামে একজন ১৩ বছর বয়সী ছেলেকে খুন করার দায়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সে নাকি তার সহপাঠিনী কেটিকে নৃশংসভাবে খুন করেছে। 

এরপর কাহিনি আর গড়পড়তা বাকি সকল খুনের গল্পের ধারায় এগোয়নি। কোন্ ধরনের মানসিকতা থেকে একজন তেরো বছর বয়সী ছেলে তার সহপাঠিনীকে খুন করার মতন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, কোন্ হিম শীতল স্নায়ুর বসে সে ক্রমাগত নাকোচ করতে চাইছে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে, কোন্ পরিবেশ – জিন – নিত্য ব্যবহার্য গ্যাজেট, বিশেষত কোন্ সামাজিক অ্যাপ্লিকেশন তাকে ঠেলে দিচ্ছে খুন করার মতন অপরাধ প্রবণতায়, এই গল্প সেই কথাই বলে। পাশাপাশি দেখতে পাওয়া যায়, যে পরিবারে এমন একটি ঘটনা ঘটছে সেই পরিবারটি সামাজিক – পারিবারিক এবং মানসিক সকল দিক থেকে কীভাবে গভীর অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। 

সিরিজটি দেখে আমরা বাবা-মায়েরা এই সময়ে বেড়ে ওঠা ছেলেপুলেদের চিনতে পারি ও ভয় পাই। আতঙ্কিত হই। জেমির উচ্চারিত প্রতিটি লব্জ, বিস্ফোরক তর্ক, হঠাৎ হঠাৎ রেগে ওঠা, তেরো বছর বয়সী আশ্চর্য উগ্র পৌরুষ দেখে ধরতে পারি না এটা কোনো অভিনয় কিংবা ধারাবাহিক মুভি দেখছি। এ যে আমাদের প্রত্যেকের ঘরেরই ছবি। জেমির চোখে, দোটানায় কাঁপা গলায়, বিষণ্ণতায় ভরা মুখে যেন আজকের কিশোরদের অন্তর্জগৎ ফুটে উঠেছে… নারী শরীরকে জেমিরা পণ্য ব্যতীত আর কিছু ভাবে না। তার উপর আমরা জানি এই বিষাক্ত ডিজিটাল দুনিয়ায় কীভাবে সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সররা জেমিদের কানে সযত্নে বিষ ঢেলে মস্তিষ্কে বারুদের স্তূপ গড়ে তুলছে। জেমিরা তো ইউটুবার গুরুদের বাণীকে মনীষীদের উচ্চারিত বাক্যের চেয়েও অনেক বেশি বিশ্বাস ও ভরসাযোগ্য বলে মনে করে। প্রতিটি ইমোজির যে নিজস্ব অর্থ আছে; হৃদয়ের ইমোজির রং পাল্টে গেলে যে পাল্টে যায় প্রেরকের অভিসন্ধি তা জানতে পেরে আমাদের অবাক হতে হয় বৈকি। কাউন্সিলিং করতে আসা সাইক্রিয়াটিস্ট ও জেমি মিলারের কথোপকথন যা টানা এক ঘন্টা ধরে চলতে থাকে, সেই মুহূর্তটা এই সিরিজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ বলে মনে হয়। এই পর্বের রেশ মনের মধ্যে থেকে যায় বহুক্ষণ। মিলারের মস্তিষ্কে বইতে থাকা উগ্রতার চোরাস্রোত এখানে বেরিয়ে আসে গলগল করে। স্তব্ধ হওয়া ছাড়া, চোখ জলে ভরে ওঠা ছাড়া সাইক্রিয়াটিস্টের পাশাপাশি দর্শকেরও কিছু করার থাকে না। 

ফিলিপ বারান্তিনি নির্দেশিত এই সিরিজের চারটি পর্বই ওয়ান টেকে নেওয়া। অর্থাৎ একটিই মাত্র শটে শুরু থেকে শেষ অব্দি দেখানো হয়েছে। মাঝে কোন কাট নেই। একটানা নিরবিচ্ছিন্নভাবে চরিত্রের সঙ্গে থাকতে হয়েছে দর্শককে। কখনো কখনো দম বন্ধ হয়ে এসেছে। কাটের তৃষ্ণা এসেছে। মনে হয়েছে পুরো ঘটনাটা দর্শকের চোখের সামনে ঘটছে। দর্শকই আসলে চেয়ার টেনে বসে আছে জেমির জেরার ঘরে। কখনো তার বাবার চালানো ভ্যান গাড়ির মধ্যে। কখনো-বা তাদের রান্নাঘরে কিংবা ছোট্ট জেমির শোবার ঘরে। শ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছে। যে দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে দর্শকদের মুক্তি দিতে পারতো কয়েকটি কাট কিংবা দৃশ্যান্তর। কিন্তু নির্মাতারা তা দেননি। বোঝাতে চেয়েছেন, এই সিরিজ হয়তো পজ করে কেউ চাইলেই থামিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু যে বাস্তবতা এই সিরিজে উঠে এসেছে তা রোধ করা কারুর পক্ষে সম্ভব নয়। সমাজের স্রোত থামাবার উপকরণ যে এখন আর কারোর হাতেই নেই। করাল বাস্তবের মুখোমুখি হতেই হবে। যেমন ভাবে এই সিরিজের অপর দুই প্রধান চরিত্র ডি আই ব্যাসকোম্ব কিংবা সাইক্রিয়াটিস্ট ব্রায়নি চুপ করে থেকে গেছেন, আমাদেরও তেমনি চুপ করেই থাকতে হবে। ছেড়ে ওঠবার কিংবা পালাবার পথ নেই। 

১৩ বছর বয়সী জেমি মিলারের চরিত্রে অভিনয় করা ওয়েন কুপার এই বয়সেই এক আশ্চর্যজনক অভিনেতা। বয়স তার অল্প হলেও গোটা সিরিজে তার নিঁখুত ঔদ্ধত্যপূর্ণ বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ, কখনো অসম্ভব ভয়াল মারমুখী হয়ে ওঠা, কিশোরসুলভ গলা ভেঙে যাওয়া আমাদের চমৎকৃত করে। বয়ঃসন্ধির ছেলেদের মধ্যে সমস্ত কিছু ভেঙে ফেলার যে চরমপন্থী প্রবৃত্তি থাকে, সেই ভাঙনের সম্ভাবনা সারাক্ষণ লেগে থাকে তার চোখেমুখে। সে নিজেকে ‘আগলি’ বা কুৎসিত চেহারার পুরুষ বলে মনে করে। অথচ মুখোমুখি বসে থাকা মানুষটার কাছ থেকে ভ্যালিডেশন শুনতে চায়, ‘না না, তুমি কুৎসিত নয়, তুমিও সুন্দর’-এর মতো মন ভেজানো কথা। সে অম্লান বদনে ঘোষণা করে, সে চাইলেই একটা নারীশরীরকে স্পর্শ করতে পারত, কিন্তু করেনি। যা তার উদারতার পরিচয়। চাঁচাছোলা ভাবে জানায়, কেটিকে তার পছন্দ ছিল না, কারণ সে ফ্ল্যাট। তবুও সে কেটিকে ডেটিংয়ে মেলায় যাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। নিজের পৌরুষে ঘা খেয়ে আর দিনের পর দিন বুলিড হতে হতে কখন যে সে অপরাধী হয়ে উঠেছে তা নিজেও ঘুণাক্ষরে টের পায়নি। 

জেমির বাবা হিসেবে অভিনয় করা স্টিফেন গ্ৰাহাম এই সিরিজের আরো এক অনবদ্য চরিত্র। সমগ্ৰ চতুর্থ পর্বে জেমির বাবা, মা আর অল্প হলেও দিদির অভিনয় অপূর্ব। তৃতীয় পর্বেই দেখা গিয়েছিল সাইক্রিয়াটিস্ট জেমির কাছে বারবার তার বাবার সম্পর্কে প্রশ্ন করছেন। বাবার রাগ, মায়ের প্রতি আচরণ, অন্য নারীর প্রতি আকর্ষণ আছে কিনা, এমনকি জেমির প্রতি তাঁর ব্যবহার কেমন এমন নানা প্রশ্ন উঠে আসছে। চতুর্থ পর্বে এসে যখন দেখা যায় জেমির বাবা উত্তেজিত হয়ে উঠলে কীরূপ ভাবে রাগে ক্রোধে ফেটে পড়েন, কেমন ধরনের আচরণ শুরু করেন, তখন মনের মধ্যে বাজতে থাকে, ‘সকল পিতাই ঘুমিয়ে থাকে সব শিশুরই অন্তরে’। আর সন্তান কোন অপরাধ করলে বাবা মাকে মেনে নিতেই হয় যে, তাদের ‘পরভরিস’ অথবা মানুষ করাতেই কোন গাফিলতি থেকে গেছে। যার ফলস্বরূপ এমন দিন তাদের দেখতে হচ্ছে। অথচ এটাও তাদের চোখে পড়ে, তাদের প্রথম কন্যা সন্তান লিজার আচরণ অনেক আলাদা। লিজা ধীর-স্থির, লাজুক, শান্ত, ঠান্ডা প্রকৃতির মেয়ে। একই হাতের পাঁচটা আঙুলের মতো একই পরিবারের সকল সন্তান যে সমান হয় না, তা তো জানা কথাই। সুতরাং প্রত্যেক সন্তানের দিকে আলাদা আলাদা ভাবেই মা-বাবা হিসেবে তাঁদের নজর রাখা উচিত ছিল। শেষ দৃশ্যে একজন অসহায় ব্যর্থ পিতা হিসেবে জেমির বাবার হাহাকার ভরা কান্না দর্শকেরও চোখ ভিজিয়ে দেয়। 

 বহু দিক দিয়েই ‘এডোলেসেন্স’ সিরিজটাকে চরম অস্বস্তিকর, শ্বাসরোধী, অসংবেদনশীল তৈরি করে নির্মাতারা আসলে এটিকে বর্তমান যুগের একটা ছোট্ট রিমাইন্ডার হিসাবে দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন। শোনা যায়, গোটা সিরিজটা বিলেতে স্কুলপাঠ্য হিসেবে দেখানো হবে বয়ঃসন্ধিকালে থাকা সকল ছেলেমেয়েদের। এখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে সকল বাবা-মায়ের… যেকোনো উপায়ে সন্ততিরা ভালো থাকুক, এটাই তো প্রধান কাম্য তাই নয়কি!

 



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *