binodan-baba-o-maa

বাবা ও মা, আমার শিকড় এবং আকাশ
ইন্টারভিউ
বললেন বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়, শুনলেন ও লিখলেন অদিতি বসুরায়


* আপনার বড় হয়ে ওঠার পরিবেশে কীভাবে লেখায় প্রভাব ফেলেছে জানতে চাই-
অন্য সবার মতোই আমার জীবনেও বাবা ও মা একই সঙ্গে, শিকড় এবং আকাশ। যতদিন এঁরা সঙ্গে থাকেন, আমরা অনেকেই এঁদের মূল্য বুঝতে পারিনা। আমার বাবা, স্বর্গীয় পরেশনাথ বন্দোপাধ্যায়, আমাদের আদি দেশ, হালিশহরের খ্যাতনামা সংস্কৃত-পণ্ডিত ছিলেন। এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভাল, আমার ঠাকুরদার বাবা, কর্মসূত্রে ওপার বাংলায় চলে যান। এই সূত্রে আমরা ষাট-সত্তর বছরের বাঙ্গালত্ব অর্জন করি। দেশভাগের কারণে, যখন হালিশহরে ফিরে আসতে হয় – তখন এখানকার আত্মীয়রা আমাদের খুব আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেননি – বলাই বাহুল্য। আমার মা, মলুটির রাজবাড়ির মেয়ে গৌরী রায়। দাদামশাই সীতেশচন্দ্র রায়, মলুটির শেষ রাজা। এই বিয়ের ঘটনা নিয়ে আমার গল্প আছে, ‘মা-বাবার ফুলশয্যা’। বাবার আর্থিক অবস্থার হাল দেখে, দাদু তাঁকে দুশো বিঘে জমি দিতে চান। বাবা বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী এবং প্রখর আত্ম-সম্মানজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। এই প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করেননি। আজীবন তিনি জিপিও-তে সাধারণ চাকরী করতেন। আমরা তিনি ভাই-বোন বলতে গেলে অভাবের মধ্যেই বড় হয়েছি। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি – এই বছরের পূজোয় প্রকাশিত হওয়া আমার ‘অপবিত্র পবিত্রো বা’ উপন্যাসটিকে আমি একটা বামপন্থী উপন্যাস হিসেবেই ধরি। আমার বেড়ে ওঠা থেকেই এই উপন্যাসের মূল বিষয়টি ধরা ছিল। মনে রাখতে হবে, সংস্কৃত একটি ভাষা – কোনও ধর্মীয় রীতিনীতির ম্যানুয়াল নয়। একা কোনও কিছু করা যায় না – দুই বোন নিয়ে বড় হয়েছি, পাড়ায় ঘুরেছি, এইসব থেকে আমার সমগ্রতা জ্ঞান নির্মাণ হয়। আমাদের পরিবেশ ছিল অনেকটা গণ – কমিউনের মতো। আমি আজও ওই পরিবেশটাকে মিস করি। আমার লেখালিখির পেছনে, এসবের প্রবল প্রভাব আছে। কবিতায় যেমন লেখা হয়, ‘এখন লেগেছে গায়ে বড় বেশী ব্যক্তিগত হাওয়া’ – এটা মেনে নিতে মনখারাপ করে। এই ব্যক্তিগত হাওয়ার বিপ্রতীপে আমার শৈশব, যেখানে প্রতিবেশীর বাড়ি যেতে আগে থেকে জানান দেওয়ার প্রয়োজন পড়তো না। এখানে কাকা, কমলকুমার বন্দোপাধ্যায়ের কথা একটু জানাই। আমার কাকা, লোকসংগীত-শিল্পী ছিলেন কিন্তু তার নামডাক হয় নি। কাকার সঙ্গে দেখা করতে রবীন্দ্র জৈন আমাদের বাড়িতে আসতেন এবং ঘন্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাতেন। এমনকী প্রায় দু’বছর তিনি আমাদের বাড়িতে থেকেওছেন। তাঁর গান শুনতে বহু লোক আসতেন বাড়িতে। আমার লেখা অনেক মানুষের নিঃশ্বাস দিয়ে তৈ্রি।

* তার মানে আপনি সামগ্রিকতায় বিশ্বাসী?
অবশ্যই। ‘তুমি দেখো নারী, পুরুষ/আমি দেখি শুধুই মানুষ’ –এই ধারণা, শৈশবেই তৈরি হয়ে যায়! বিজয়গড়ের বারো ভূতের মেলায় বড় হতে হতে এই সমগ্রতার সঙ্গে পরিচিতি আমার। লেখাতেও সেই ব্যাপারটাই ফিরে ফিরে এসেছে – আপনপর ভেদ করতে শিখিনি।

* বড় হয়ে কী হবেন স্বপ্ন দেখতেন? লেখার জগতে কিভাবে এলেন?
আমি আর যাই হই, কবি বা সাহিত্যিক হওয়ার কথা কখনও ভাবিই-ই নি। ছোটবেলায় খুব ভালো ফুটবল খেলতাম। রাজ্য দলের সাব-জুনিয়রে খেলেছি। একবার পায়ে চোট পেয়ে খেলা থেকে সরে আসি। এরপর অকাল প্রয়াত চলচ্চিত্র- পরিচালক, যিনি কবিও ছিলেন, সেই বাপ্পাদিত্য বন্দোপাধ্যায় আমাকে জোর করেই বলতে গেলে, লেখার জগতে নিয়ে আসেন। বাপ্পাদার বাবা, দেবাশীষ বন্দোপাধ্যায়, আনন্দমেলার সম্পাদক ছিলেন। ঠিক কোন সময় যে লেখার মধ্যে ঢুকে পড়লাম- মনে করতে পারিনা। আমার এক বন্ধু, অঞ্জন সে এই সময় একটা কবিতার বই লিখে ফেললো, যে বইটাকে সে দুটো মেয়েকে একত্রে উতসর্গ করে। এবং যখন সব বন্ধুরা তার ওপর চড়াও হল- সে জানালো, ‘তোর যদি অনেক টাকা থাকতো, সবটাকা একটা ব্যাঙ্কেই রাখতিস?’ – এই কথাটা আমাকে খুব হন্ট করলো। বাড়ি ফিরেও ভাবতে লাগলাম। আমরা তো অনেকেই ডুবে গেছি একটা ব্যাঙ্কে সঞ্চিত অর্থ রেখে। ভালবাসার ক্ষেত্রেও এটাই ঘটেছে – জীবন কাকে কোথায় নিয়ে গিয়ে তাহলে দাঁড় করায় – ভাবতে ভাবতে আমি একটা কবিতা লিখি যেটা ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এখান থেকে জার্নি শুরু।

*সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখা-লিখি নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই
আজ সোশ্যাল মিডিয়া, বিরাট একটা প্ল্যাটফর্ম। চমৎকার সব লেখা সেখানে পড়া যায়। কিন্তু একটাই বিষয় আমাকে ভাবায় – আমাদের লেখার লড়াইটা ছিল প্রত্যাখ্যানে ভরা। হয়তো দশটা লেখা দিলাম – দশটাই ফেলে দেওয়া হল। আবার নতুন একটা লেখা নিয়ে চেষ্টা করতে শুরু করতে হতো। সোশ্যাল মিডিয়ায় যেটা হয়, একটা লেখা আমি পোস্ট করে দিলাম – সেখানে আমার স্টেচার, আকৃতি ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে দেড়শো লাইক পড়ে গেল। তাতে লেখাটা যদি কিছু নাও হয়ে থাকে, আমার মনে হবেই লেখাটা দারুন। প্রত্যাখ্যান থেকে যে শেখার সুযোগ ছিল – সোশ্যাল মিডিয়া সেটাকে সংকুচিত করে দিয়েছে। কারণ প্রতি মুহুর্তেই ‘আমার কাজটাই যে সেরা’ – সেটা, আমাকে বলার লোকের অভাব নেই। কিছুই হয়নি এমন কবিতার নীচেও লোকে গিয়ে লিখে আসে – ‘ভাবায়’, ‘বহুবার পড়তে হয়’ ইত্যাদি। এটাই হয়। এর পেছনে আর একটা বড় কারণ হল, মুখোমুখি, ওয়ান টু ওয়ান মানুষকে বলা যায়, কবিতাটা কিছু হয়নি – কিন্তু সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম-এ অনেকের সামনে সেই অপ্রিয় সত্য বলতে অনেকেই ইতস্তত করেন। তবে আমি মনে করিনা, যে ভাষায় ত্রিশ কোটি মানুষ কথা বলেন, সেই ভাষাকে এতো সহজে নষ্ট করা যায় না।

*বাংলা বই কী তাহলে এই সোশ্যাল মিডিয়ায় আধিপত্যে বিপন্ন?
– একেবারেই তা নয়। তবে বেশ কয়েক বছর আগে, বইমেলার একটি স্টলে ইংরিজি আবোল-তাবোলে কিনতে বাবা-মায়েদের লাইন দেখে অবাক হয়ে, জিজ্ঞেস করাতে উত্তর পেয়েছিলাম, ‘স্কুলে হিন্দি ফার্স্ট ল্যাংগোয়েজ বলে বাচ্চা বাংলা পড়তে পারে না’। বাঙালি ইংরিজিতে আবোল তাবোল পড়বে জেনে খারাপ লেগেছিল। তখন মনে হয়েছিল এই অবস্থাটা বদলানো দরকার! একটা নির্দিষ্ট ভূখন্ড না পেয়ে, শ্যাওলার মতো ভেসে বেড়ানো ইহুদীরা যদি তাদের হিব্রু ভাষাকে রক্ত-ঘাম দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারে তবে আমরাও পারবো। আমি আশাবাদী। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সুভাষচন্দ্র বসুর ছেলেবেলা কেটেছিল কটকে। ডঃ বিধানচন্দ্র রায় জীবনের প্রথম সতেরো বছর কাটিয়েছিলেন পাটনায়- কিন্তু এঁদের বাঙ্গালিয়ানা বা ভাষা নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলার জায়গাই নেই। তার মানে, সেকালে ভারতের যে কোনও রাজ্যে বসে বাংলাভাষার চর্চা করা যেত। এখন কী সেটা সম্ভব? বাঙ্গালির এই চর্চাক্ষেত্রের জায়গাটা কমে আসছে না তো? – বাংলা বইয়ের কথায় বলি, ভালো বইকে মানুষ ঠিক খুঁজে নেয়। সিঙ্গারার একটা ক্রেজ থাকে বটে কিন্তু কড়াপাক সন্দেশ তিনদিন থাকে – মনে রাখতে হবে। সমাজ-বাস্তবতা যে লেখায় থাকে না, তা পাঠকের রুচির সমর্থন পাবে না বলেই আমি মনে করি। লেখক কোথায় লিখলেন তার থেকে বেশি বিচার্য তিনি কি লিখলেন! এটাই ভবিষ্যতের বাংলা লেখার মাপকাঠি বলে- আমার বিশ্বাস!

*সদ্য বিবাহিত বিনায়ক বন্দোপাধ্যায়ের কাছে প্রেম কিভাবে এসেছে?
আমার কাছে অসুস্থ সন্তানের মাথায় জলপট্টি দেওয়াও এক রকম প্রেম। তবে লোকে প্রেম বলতে নর-নারীর ভালবাসাকেই বোঝে! আজকের দুনিয়ায় প্রেমের সংজ্ঞা পালটে গেছে। সমকামকে আমি শ্রদ্ধা করি। নারীর সঙ্গে নারীর প্রেম বা পুরুষের সঙ্গে পুরুষের প্রেম – সবটাই ভালবাসার প্রতীক। ইদানীং ভার্চুয়াল দুনিয়ায় এক রকম প্রেম দেখা যায় – যেখানে আবেগের সুনামিতে ভেসে যেতে যেতে অনেকে ভাবতে থাকে, এটাই প্রেম। এবং এরা জানেও যে এই সব ভালাবাসা-বাসি খানিক ‘ঝুটো’। এই ব্যাপারটা আমার কাছে কুহেলিকাময়। প্রেম আদতে একটা দায়িত্ব। দুদিনের লোক-দেখানো বা ঘুরে বেড়ানো নয়। যাকে ভালবাসি তার ভালো করার দায়িত্বই আসলে প্রেম।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *