স্মৃতিচারণ
শোভনসুন্দর বসু
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমার পরিবারের সদস্য নন! কিন্তু উনি দেশনায়ক। যে অর্থে কাজী সব্যসাচী, শম্ভু মিত্র, প্রদীপ ঘোষ আমাদের আবৃত্তি পরিবারের আত্মীয়, সেই ভাবেই তিনি আমার আত্মার কাছের মানুষ। দেশনায়ক বলতে, বোঝাতে চাইছি বাংলা সংস্কৃতির মানচিত্রের অভিভাবকের অর্থে। আমি ওঁর স্নেহাশিস ও প্রশ্রয় পেয়েছি। যা আমার সাংস্কৃতিক কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
সাহিত্য ও কবিতার তিনি আজীবন মনস্বী পাঠক ও কবি, বিশেষজ্ঞ। ১৯৯৭ সালের ২০শে ডিসেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকার পাতায় অমিত মুখোপাধ্যায় লেখেন একটি দীর্ঘ আর্টিকেল। শিরোনাম – আবৃত্তি বেচতে বসে। তখন আমি সদ্য কলকাতার আবৃত্তি জগতে পা রেখেছি, একটুআধটু পরিচিতি পেতে আরম্ভ করেছি। সেই প্রবন্ধে আমি ওঁর আবৃত্তি- শৈলীর সমালোচনা করেছিলাম। ওই বক্তব্য নিয়ে পাঠক–মহলে বিস্তর সমালোচনা হয় এবং পরবর্তীতে আমার নিজের মনে হয়েছে ওই কথা আমারই অদূরদর্শিতার পরিচয় ছিল। এর ক’দিন পরে, সৃষ্টি ক্যাসেটস এবং রেকর্ডস-এর দপ্তরে ফের মুখোমুখি হওয়া এবং আমার যুক্তিও তিনি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন। কিন্ত ওঁর বক্তব্য ছিল, আবৃত্তি, কবিতাশৈলী ও কাব্যময়তারই প্রকাশমাত্র। এরপর বাড়িতে যাওয়া। সেই গরমের দুপুরে তিনি বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আমি যাওয়াতে ওই অবস্থাতেই উঠে আসেন। অবাক হয়ে যাই আম-বাঙ্গালির স্বপ্নের নায়ককে খালি গায়ে লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় দেখে। এই সময়েই ঘরে আসেন ওঁর স্ত্রী দীপা চট্টোপাধ্যায়। তিনিই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বলেন, ‘এই-ই কিন্তু শিবসুন্দর বাবুর পুত্র শোভনসুন্দর ’। আমার বাবা শিবসুন্দর বসুর সঙ্গে ওয়াই এম সি এ-তে ব্যাডমিন্টন খেলতেন ওঁরা। দীপা চট্টোপাধ্যায়ের মিক্সড ডাবলস-এর পার্টনার ছিলেন বাবা। সেই সময়, খেলার শেষে প্রতিদিন রাত্রে গাড়ি করে দীপাকে আনতে যেতেন সৌমিত্রদা। অনেকক্ষণ আড্ডা হয়েছিল সেদিন। বাবার খোঁজ নিয়েছিলেন – একবার দেখা করার ইচ্ছেও প্রকাশ করেন। সেদিন তিনি এও জানিয়েছিলেন, আবৃত্তি কোনও স্বতন্ত্র শিল্প নয় – উনি মনে করেন। আবৃত্তি আদতে কবির ভাবনারই শ্রাব্যরূপ- এই তাঁর মত। আমার ছোটবেলা থেকেই বৈপ্লবিক মন। এটা নিয়ে সে মৃদু প্রতিবাদ করে। ওঁর কাছে শম্ভু মিত্রের আবৃত্তির মধ্যে কাব্যময়তার প্রকাশ কম, ওঁর অসাধারণ উচ্চারণ-ব্যঞ্জনা ও স্বর স্থাপত্যে তা হারিয়ে যায়। তাঁর প্রিয় আবৃত্তিকার সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। আমি কিন্তু বলেছিলাম, আমি বরাবর মনে করি, আবৃত্তির নিজস্ব শৈলি আছে – গান, থিয়েটার ও সিনেমার মতো। এবং আবৃত্তি এক স্বতন্ত্র শিল্প। যাতে তিনি একমত হন নি। তবে তাতে সেদিনের চায়ের স্বাদ একটুও কমে নি। এরপর আমাদের পারিবারিক যোগাযোগ বেড়ে যায়। মেদিনীপুর শহরে পিতৃদেবের সংস্থা ‘স্বর ও আবৃত্তি’র অনুষ্ঠানে এসেছিলেন, বাবার এক কথায় রাজি হয়ে। আমার মায়ের হাতের রান্নাও খেয়েছিলেন।
বাবার বন্ধু হলেও আমি তাঁকে সৌমিত্রদা বলেই সম্বোধন করতাম। একদিনের কথা খুব মনে পড়ে! কলকাতার বাইরে আমাদের অনুষ্টান ছিল। ফেরার পথে, গাড়িতে সৌমিত্রদা, মাধবী মুখোপাধ্যায় এবং অমল সাহার সঙ্গে আমিও ফিরছিলাম। গভীর রাতে মাধবীদির অনুরোধে সৌমিত্রদা গান গাইতে শুরু করেন – ‘গোধূলী গগনে মেঘে, ঢেকেছিল তারা’ – অসামান্য কণ্ঠস্বর। সেই গান আজো মনে পড়ে। কলকাতায় ঢুকে আমরা সবাই সোজা অমল সাহার বাড়িতে যাই। সামনের পোর্টীকোতে অমল সাহার বিভিন্ন মডেলের দশটা গাড়ি তখন পার্ক করা ছিল। সৌমিত্রদা করলেন কি – প্রতিটি গাড়ির নাম্বারপ্লেট দেখে দেখে সেই সব সালে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো বলতে থাকেন এবং আমাদের জিজ্ঞাসা করতে থাকেন খেলাচ্ছলে। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা!
২০০৬ সালে আবৃত্তির পূর্নাঙ্গ ভিস্যুয়াল সিডি করে এইচ এম ভি। সেটাই প্রথম বাংলায়। তার আগে এই কাজ হয় নি। দশটি কবিতার আবৃত্তির এই অ্যালবামের নাম – কবিতার ফেরিওয়ালা। চিত্র পরিচালক রাজা সেন পরিচালনা করেছিলেন। আমার আবৃত্তির সঙ্গে ইন্দ্রানী হালদার কোরিওগ্রাফি করেন এবং পুরো সিডিটি গ্রন্থনা করেছিলেন সৌ্মিত্র চট্টোপাধ্যায়। আমার আবদারে, আমার মতো অর্বাচীনের আবৃত্তিগুলিতে উনি গ্রন্থনা করতে রাজি হয়েছিলেন যাতে এইচ এম ভি কর্তৃপক্ষও বিস্মিত হয়েছিল। আর একটা ঘটনা মনে আছে। তখন সদ্য ‘কিং লিয়র’ করেছেন মঞ্চে। দক্ষিণ কলকাতার ডি কে এস ক্লাবে বসেছি আমরা। সেখানে কবিতা এবং আবৃত্তি নিয়ে কথা হয়েছিল অনেক। তিনি বলেছিলেন, এখন অনেকে আবৃত্তি করেন, কবির অনুভব ও কবিতা না বুঝেই, এটা তাঁর ভালো লাগে না। এরপর কথায় কথায় বলেন, “আচ্ছা বলো তো – ‘রক্ত -ক্লেদ -বসা থেকে, রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি’ – এই ‘বসা’ শব্দের মানে কি “? – আমি বলেছিলাম, ‘বসা’ শব্দের অর্থ হল ‘চর্বি’। খুব খুশি হয়েছিলেন শুনে। সবাই জানেন এটা জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতার একটি লাইন – ‘বসা’ শব্দটি আর কোথাও বাংলা সাহিত্যে ব্যবহার হয় নি।
২০১২ সালে কবি জয় গোস্বামী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং আমি – শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের স্ক্রিপ্টে কাজ করি। রবীন্দ্রসদনের সেই অনুষ্টানের রিহার্শালে অনেক আড্ডা হতো। কনস্ট্রাকটিভ সেই সব আড্ডা আজকাল খুব মিস করি। আর একটা ঘটনার কথা বলি। ২০০৭ সালে, লেক ক্লাবে কোনও একটা পার্টিতে গেছি – আমি হুইস্কির গ্লাস হাতে নিতেই দেখি সৌমিত্রদা ঢুকছেন। আমি চেয়ারের নীচে গ্লাসটা রেখে কথা বলতে গেছি, উনি বলে উঠলেন, “আরে, লুকোচ্ছ কেন? তোমার বয়েসে আমরাও খেতাম। যাও, নিয়ে এস”। আজ লিখতে বসে কত কথা যে মনে পড়ে যাচ্ছে! ২০১৬র জানুয়ারিতে বিয়ের কার্ড দিতে গেছি। বউয়ের মূল পরিচয় কবি – এটা জেনে খুব খুসি হলেন। আমার সামনেই মেয়ে, পৌলমীদিকে ডেকে বললেন, দেখ তো চোদ্দ তারিখ কী আছে ! দেখা গেল ওঁদের সেদিন বারাসাতে শো আছে। বলেছিলেন, ‘আমি যাবো – তবে খুব যদি রাত্রি না হয় “। রাত বারোটায় আমাদের রিসেপশন থেকে ফোন করেছিলাম – জানালেন তখনও বেরতে পারেন নি বারাসাত থেকে। আমার মেয়ে পদ্যর এক বছরের জন্মদিনেও আসতে পারেন নি অসুস্থতার জন্য। শেষবার দেখা, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে। আবৃত্তিলোকের অনুষ্ঠানে। মধুসূদন মঞ্চে। তারপর তো শোক – অসুখ – আতঙ্ক। এবং মহীরূহ পতন। আমার ‘চিরপ্রণম্য অগ্নি’, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে প্রণাম।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
Khub bhalo laglo ei smriticharon. Anek kichhoo jante parlam onar sommondhe..actor Soumitra chhara anyo Soumitra ke chinlam, janlam. shobdo choyon, logical flow, ebong bishesh kore bhalo laglo lekhar bhongima. Thank you for sharing. Loved it.