সাক্ষাৎকার নিলেন: চুমকি চ্যাটার্জী এবং জয়তী রায়
লিপিবদ্ধ করলেন: চৈতালী নাথ (দে)
ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী পড়ন্ত বিকেল। কিন্তু সদ্য বৈশাখের গনগনে রোদে বিকেল পাঁচটাতেও সূর্যের তেজ চারিধার গলিয়ে দিচ্ছে। এমন দিনে অপার বাংলার জুলাই সংস্করণের জন্য বিশিষ্ট সমাজকর্মী, মনোবিদ ও সংগীতজ্ঞা পিয়া চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার নিতে ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাবে পৌঁছলেন ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনা সংস্থা পত্রভারতীর কর্ণধার ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক চুমকি চ্যাটার্জী (চুমকি দি) এবং অন্যতম বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও মনোবিদ জয়তী রায় (জয়তী দি)। শুরুতেই একটু তাল কাটলো। সাক্ষাৎকারের জন্য নির্দিষ্ট ঘরটি বিকেল ৬টার আগে পাওয়া যাবে না বলে জানানো হলো। কিন্তু, জয়তী দি যেখানে, মুশকিল আসান সেখানে। ওনার পরিচিত এক ব্যক্তিকে অনুরোধ করে বিজলী গ্রীলের ডাইনিং হলে সাক্ষাৎকারের বন্দোবস্ত হলো। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত নির্জন রেস্তোরাঁর উপাদেয় খাবার আর শীতল পানীয় সহযোগে সাক্ষাৎকার শুরু হলো। পরবর্তীতে আমি, মানে অপার বাংলার সহ সম্পাদিকা চৈতালীর ওপর দায়িত্ব পড়লো সাক্ষাৎকারটি লিপিবদ্ধ করার।
চুমকি দি: ছোটবেলায় তুমি কী হতে চাইতে? শিশুদের জিজ্ঞেস করলে যেমন উত্তর দেয় – ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার সেরকম কিছু কী তোমারো ইচ্ছে ছিল?
পিয়া: ছোটবেলায় আমার সেরকম কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল না। ছোটবেলায় সাধারণত আমরা যা দেখি তাতেই মুগ্ধ হয়ে যাই। আমিও যেটাই দেখতাম, মনে হতো আমি এটাই হবো। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ছোটবেলায় অনেক বার বাবার সাথে ওঁর অফিসে গিয়েছি। ওখানে একজন রিসেপশনিস্ট ছিলেন যিনি টাইপ করতেন। ওনাকে দেখে আমার খুব টাইপিস্ট হতে ইচ্ছে করতো। (কিছুটা হেসে নিয়ে) আবার সুস্মিতা সেন মিস ইউনিভার্স হবার পর, আমার ইচ্ছে করতো আমিও একদিন ওর মতো মিস ইউনিভার্স হবো। আমি ভবিষ্যতে কি হতে চাই, সেটা নিয়ে আমি পরবর্তী কালে বেশি গুরুত্ব সহকারে ভেবেছি।
চুমকি দি: তুমি বর্তমানে একজন সমাজ কর্মী, মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলন কর্মী, গবেষক এবং সংগীতজ্ঞা। আবার কিছুদিন তুমি শিক্ষকতার কাজও করেছো। তোমার এই সকল পরিচয়ের মধ্যে কোন পরিচয়টি তোমার মনের খুব কাছে বলে তোমার মনে হয়?
পিয়া: (একটু ভেবে) আসলে সবকটাই বিভিন্ন ভাবে মনের কাছাকাছি। আমি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সোসিওলজি নিয়ে ব্যাচেলর করি। জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করি। তারপর সোশ্যাল সায়েন্স নিয়ে গবেষণা করি। আমার এই গবেষণার কাজ আমাকে ভীষণ ভাবে সমৃদ্ধ করেছে। আজ আমি যে কাজ করছি সেই কাজটাকে আমার এই গবেষণা ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করেছে। গবেষণার কাজটা আমাকে কোনো একটা জিসিনের গভীরে গিয়ে তাকে বিশ্লেষণ করতে শিখিয়েছে। সেদিক থেকে বলতে গেলে আমার গবেষক পরিচয়টা আমার কাছে ভীষণ ভাবে প্রাধান্য পায়। এছাড়াও আমি বলতে চাই যে, ছোট বেলা থেকে আমি এমন একটা পরিবারে বড়ো হয়েছি যেখানে আমার মা-বাবা কে আমি সব সময় দেখেছি অন্যের জন্য ভাবতে। আমার মানসিকতাটাই সেভাবে গড়ে উঠেছে। আলাদা করে সোশ্যাল ওয়ার্ক করছি সেভাবে কখনো ভাবিনি। তবে বলবো, এটাও আমার খুব মনের কাছের একটা পরিচিতি। তবে, যদি আমাকে কোনো একটা বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে বলবো যে মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলন কর্মী – এই পরিচয়টা আমার সব চেয়ে কাছের। যখন আমি এই কাজের সাথে যুক্ত ছিলাম না, তখন থেকেই আমি এই বিষয়টা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতাম। আমি সাইকোলজি নিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম একটা সময়। কোনও এক কারণ বসত সেটা আর হয়ে ওঠে নি। কিন্তু সেই ইচ্ছেটা আমার মনের মধ্যে সুপ্ত হয়ে ছিল সবসময়। আজ যখন আমি ‘মেন্টাল হেলথ রাইটস’ নিয়ে কাজ করছি, আমার মনে হয় আমি এই কাজটার সাথেই সবচেয়ে বেশি ভালোবেসে জড়িয়ে পড়েছি।
চুমকি দি: তাহলে এটা বলা যায় যে শুধু মাত্র সোসিওলজি পড়েছো বলে নয়, ছোট বেলা থেকে যে পরিবেশে তুমি বড়ো হয়েছো সেই পরিবেশ তোমাকে তৈরী করে দিয়েছে সমাজের জন্য কাজ করার।
পিয়া: এটাই কিন্তু স্বাভাবিক। ছোটবেলায় যে ভিতটা তৈরী হয়, সেটাই পরবর্তীতে সাহায্য করে। আমার বাবা একটি এডভার্টাইসিং সংস্থায় কাজ করতেন। ১৯৯০ সালে উনি একটি NGO খোলেন। যা HIV সচেতনতা নিয়ে কাজ করতো। সেই NGO র সাথে আমিও জড়িয়ে। সংগঠনটির নাম HEAD। COVID এর সময়ে আমরা শহরে তিনটে বড়ো ইমার্জেন্সি সেন্টার চালিয়েছি। পাবলিক হেলথ, ওমেন হেলথ নিয়েও আমরা কাজ করি।
চুমকি দি: খুব ভালো লাগলো শুনে। তোমার বিষয়ে অনেক অজানা তথ্য আজ আমরা জানতে পারছি। তুমি তো ভীষণ ভালো গান গাও। গানকে কখনো পেশা করার কথা ভেবেছো কি?
পিয়া: (একটুও না ভেবে, উত্তর এলো ‘না’। তারপর একটু হেসে) ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ দিয়ে যদি উত্তর দিতে হয়, তাহলে বলবো ‘না’। তার কারণ হলো, গানটা আসলে আমি ভালোবেসে গাই। ছোটবেলা থেকে মা কে দেখেছি রবীন্দ্রসংগীত গাইতে। আমিও গাই। কিন্তু অতটা গুরুত্ব সহকারে কখনো গান নিয়ে কিছু করবো ভাবিনি। গান আমাকে রিলাক্স করায়। মায়ের অনুপ্রেরণা আর উদ্যোগে ‘দক্ষিণী’ তে ভর্তি হয়েছিলাম। সেই সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গানও গাইতাম। অনেক পরে কিছু গান রেকর্ড করি। ইউটিউবে আমার কিছু গান রিলিজ করি। যেগুলো পরবর্তীতে দেখলাম অনেকেই খুব পছন্দ করেছেন। ইউটিউবে আমার গাওয়া ‘তোমার অসীমে’ গানটার প্রায় ৫ মিলিয়ন ভিউ হয়েছে যেটা আমার কল্পনার অতীত। তবে গান ছাড়া আর যে সকল বিষয়ের সাথে আমি জড়িত, সেগুলো আমার বেশি ভালো লাগার জায়গা।
চুমকি দি: বাহ্, আমাকেও তাহলে গানটা শুনতে হবে। আমি তোমার অন্য একটা গান শুনেছি। তোমার ইউটিউব চ্যানেলটির নামটা একটু বলবে?
পিয়া: আমি লিংকটা তোমায় পাঠিয়ে দেব। আমার গান অনেকে পছন্দ করছেন সেটা যখন বুঝতে পারলাম তখন একটু উৎসাহ বাড়লো বৈকি।
চুমকি দি: নিশ্চয়ই।
পিয়া: এখন অনেকেই আমার পরবর্তী গান কবে আসছে সেটা জানতে চান। অনেকে আবার এটাও বলেছেন যে এই গানটি তাদের জীবনে অনেক ভাবে সাহায্য করেছে। এগুলো শুনে সত্যি খুব অনুপ্রেরণা পাই। আর সেজন্যই ইচ্ছে আছে গান নিয়ে আরো কিছু কাজ করার।
চুমকি দি: (আনন্দের সাথে) বাহ্, আমরা তাহলে এবার পিয়ার আরো গান শুনতে পাবো। জয়তী দি যিনি এতক্ষন চুপ করে দুজনের কথোপকথন শুনছিলেন, এবার গানের কথা শুনে তিনিও আর চুপটি করে থাকতে পারলেন না। চুমকি দির সাথে গলা মেলালেন।
চুমকি দি: তুমি কি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান?
পিয়া: হ্যাঁ, আমি একমাত্র সন্তান। একা সময় কাটাতে আমি প্রচুর বই পড়তাম ছোটবেলায়। সেই অভ্যেসটা এখনো রয়ে গেছে। এখনো আমি একা একা বই পড়ে সময় কাটাতে ভালোবাসি।
চুমকি দি: তুমি যেমন বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, আমিও তাই। এখনকার নিউক্লিয়ার পরিবার গুলোর যেখানে বাবা মা দুজনেই চাকুরীজীবি, সন্তানেরা হয়তো মোবাইল, সোশ্যাল মিডিয়াতে আসক্ত। তাদের অনেকের একাকিত্ব, অবসাদ এরকম নানা মানসিক পরিস্থিতির কথা আমরা শুনতে পাই। একজন মনোবিদ হিসেবে তুমি যদি আমাদের অপার বাংলার পাঠকবৃন্দকে পরামর্শ দাও কিভাবে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে ভালো থাকা যায়, বই পড়ার প্রতি ঝোঁক বাড়ে, তাহলে তারা খুবই উপকৃত হবেন।
পিয়া: খুব কঠিন প্রশ্ন। আমি যখন বড় হচ্ছিলাম, সেই সময়টা এখন অনেকটাই পাল্টে গেছে। আমরা তো ফোন নিয়ে বড়ো হইনি। সোশ্যাল মিডিয়া অনেক পরে এসেছে। আমাদের সময়কার সাথে এখনকার ব্যাপারগুলো কিন্তু মেলানো সম্ভব নয়। নিজের কিছু ভালোলাগা আবিষ্কার করাটা বা নিজেকে বোঝা খুব দরকার। কেউ হয়তো বই পড়তে ভালোবাসে, কেউ হয়তো গান ভালোবাসে, বা অন্য কিছু ভালোলাগার আছে। সেরকম একটা কিছু ভালোলাগার কাজ অবশ্যই প্রয়োজন। আর দ্বিতীয়ত আমি বলবো, আমি একা আছি মানে যে বাকিদের থেকে আমি বিচ্ছিন্ন সেই ভাবনাটা যেন মনে না আসে। ভালো থাকার একটা উপায় হলো একা থেকেও কানেক্টেড থাকা। আমাদের সবারই একটা কমুনিটির প্রয়োজন আছে।
চুমকি দি: এখনকার যুব সমাজ সারাক্ষন সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করছে, রিল্স বানাচ্ছে। যা করতে গিয়ে অনেক সময় বড়ো রকমের দুর্ঘটনাও ঘটছে। তুমি কি এটা নিয়ে কিছু বলবে? কি করলে এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব?
পিয়া: আমরা নিজেরাও কিন্তু এই সোশ্যাল মিডিয়াতে ভীষণ ভাবে আসক্ত। সারাক্ষন ফোন ঘেঁটে যাচ্ছি। আমি নিজেকে যেটা সবসময় বলি সেটা হলো কিছু ‘গুড প্রাকটিস’ থাকা খুব জরুরি। এই কথাটা আমি আগেও কিছু জায়গায় বলেছি। সেটা হলো ঘুম থেকে উঠেই আমি কখনো ফোন দেখি না। এটা অনেকটা এরকম যে, সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই তো আমি চাইবো না যে আমার শোবার ঘরের দরজাটা আমি খুলে দেই আর সবাই এসে ঢুকুক সেখানে। তার বদলে ওই সময়টা অন্যকিছু নিয়ে কাটানো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনেহয়। এগুলো কিন্তু সারাদিনটা কেমন যাবে সেটার আকার দিতে অনেকটা সাহায্য করে। আজকাল আসলে ইনস্ট্যান্ট গ্রাটিফিকেশন এর দাবিটা অনেক বেড়ে গেছে। রিল্স বানানো কিন্তু তারই একটা অংশ। ৩০ সেকেন্ড বা ৬০ সেকেন্ড সেই স্টিমুলেশন টা দিয়ে দিচ্ছে। এটা কি করে কাটানো যাবে সেটা নির্দিষ্ট করা খুব সহজ নয়।
জয়তী দি: সঠিক। এই স্টিমুলেশন টা স্থায়ী নয় বলেই কিন্তু প্রব্লেমটা বেশী। এটেনশন স্ট্যান্ড টাও কমে গেছে।
পিয়া: আর আমরা সবাই সেটার ভিকটিম। কোথাও গিয়ে এই সিস্টেম টার একটা পরিবর্তন প্রয়োজন।
চুমকি দি: ঠিক। এটা কিন্তু সবাইকে মিলেই করতে হবে। আমাকে নিজেকেই এর থেকে বের করে আনতে হবে। ইম্পাল্স টাকে কমিয়ে যুক্তি দিয়ে ভাবতে হবে। বই পড়াটা কিন্তু খুবই প্রয়োজন।
আলোচনার শেষে আবার এক প্রস্ত খাবার এসে পৌঁছলো। সবাই মিলে এবার একটু খাবারে মনোযোগ দেওয়া হলো।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন