binodan-maer-kono-bikolpo-nei

মায়ের কোনও বিকল্প নেই
(মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সাস নরওয়ে)
ফিল্ম রিভিউ
অদিতি বসুরায়


মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সাস নরওয়ে ছবির যে ব্যাপারটা আপনি আগে দেখেন নি, তা হল – বাবা-মায়ের কাছ থেকে, অযত্নের অভিযোগে রাষ্ট্র কর্তৃক সন্তানদের তুলে নিয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে ইস্যু – বাবা-মা (পড়ুন অনুপযুক্ত মা) বাচ্চাদের দেখভালের উপযুক্ত নয়। আর অভিযোগগুলো যথাক্রমে – মা বাচ্চাদের চামচের বদলে হাতে তুলে খাওয়ান, কপালে কালো টিপ এঁকে দেন, বাচ্চার অটিজম আছে অথচ তিনি খেয়াল করেন নি ইত্যাদি নানা ব্যাপার। রাষ্ট্র চাইলে কিনা পারে ! কিন্তু প্রায় চোরের মতো, ঘর থেকে বাচ্চাকে কেড়ে নিয়ে যায় যে রাষ্ট্র, সেই রাষ্ট্র কীভাবে স্ত্রীর ওপরে স্বামীর পীড়ন বিষয়ে টুঁ শব্দ করে না – তা নিয়ে ছবির পরিচালকও নিশ্চুপ। মিসেস দেবিকা চ্যাটার্জি এবং অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জি নরওয়েতে যে দুর্ভাগ্যের শিকার হন, তা ভারতবর্ষে অভাবনীয়। তবে কেবল শিশুপালন নয়, এর সঙ্গে আর যে যে বিষয়গুলো জড়িত সেসব আমরা হাড়ে হাড়ে জানি। সে সব ব্যাপারের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এবং আমার মতো কিছু হতভাগ্য লোক, সে সব-ই আবার নিজের জীবনে পার করে এসেছে। প্রসঙ্গত, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের কথা বলছি। বলছি, সন্তান জন্মের পরের ব্লু-পিরিয়ডে মায়ের নানা হরমোনাল বদল এবং পুরো ব্যাপারটাকে সামলাতে না পেরে যে সব মেয়েরা অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে থাকেন – তাদের মানসিক ভারসাম্যহীন বলে দেগে দেওয়া কী আদৌ সুস্থতার লক্ষণ? মায়ের কোল থেকে বাচ্চা কেড়ে নিয়ে চলে যাবে ওয়েলফেয়ার কমিটির সদস্যরা, আর মা আছাড়িপিছাড়ি খেয়ে কাঁদলে, সে উন্মাদ? সে বাচ্চার সামনে কাঁদলে, সার্মন জারি করা হবে, সে বাচ্চাকে দেখাশোনার উপযুক্ত নয়? – এসব আমরা ঢের দেখেছি। তফাত কেবল নরওয়েতে উক্ত ব্যাপারে দেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে, আমাদের এখানে প্রতিবেশি- আত্মীয়তে আঁতাত হয়।

মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সাস নরওয়ে ছবিতে দেবিকা( রাণী মুখার্জি)-র স্বামী অনিরুদ্ধ এমন এক স্বামী, যাকে গৃহস্থালীর কাজে সাহায্য করার কথা নরওয়ে – ওয়েলফেয়ার সার্ভিস থেকে জানালে, সে স্ত্রীকে আড়ালে বলে ‘আমি তাহলে চুড়ি পরে বসে থাকি, নাকি?’। বিদেশে দু’দুটি শিশু নিয়ে, ঘরের কাজ মানে আক্ষরিক অর্থে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ করা স্ত্রীকে গৃহকর্মে সহায়তা করার প্রসঙ্গে ভারতীয় স্বামীটি যখন বউকে টেনে হিঁচড়ে এই জাতীয় কথা বলতে থাকে, সেই ফাঁকে দুটি শিশুকে নিয়ে রীতিমত অপহরণ করে নিয়ে যায় নরওয়ের চাইল্ড ওয়েলফেয়ারের কর্মীরা। দেবিকা ছুটন্ত গাড়ির পেছনে দৌড়তে থাকে – এবং আছড়ে পরে রাস্তায়। ছবির শুরুতেই রাণী মুখার্জিকে এই দৃশ্যে দেখে কিছুতেই দেবিকার থেকে আলাদা করা যায় না। নির্মাণে হাজার ফাঁক ফোকর থাকা সত্ত্বেও শুধু রাণীর কারণে চোখের জল আটকানো অসম্ভব। দেবিকা পাঁচমাসের মেয়ের জন্য নিয়মিত মাতৃদুগ্ধ পাম্প করে নিয়ে যায় – ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এসে দুধ কলা খেতে খেতে শাশুড়ির গঞ্জনা শোনে – স্বামীর কাছ থেকে সাহচার্যের বদলে ভৎসনা পায় – দুনিয়াশুদ্ধ লোক তাকে দোষী তকমা দেয় – ফস্টার প্যারেন্ট-র বাড়ি থেকে সে বাচ্চাদের তুলে এনে পালিয়ে সুইডেন যাওয়ার চেষ্টা করে – নিজের সন্তানদের নিয়ে আসা ‘অপরাধে’ তাকে কিডন্যাপার বলা হতে থাকে – দেশে শ্বশুরবাড়িতে বাচ্চাদের আনতে গেলে তাকে লাঠির বাড়ি খেতে হয় – তবু সে লড়াই ছাড়ে না। সে ‘মা’। সমস্ত স্বত্তা মিথ্যে করে কেবল এই মাতৃ পরিচয়-ই তাকে হাল ছাড়তে নিষেধ করে। এবং একটি দেশ – একটি উন্নত, অগ্রসর দেশ তার কাছে নত হয়। সেই সঙ্গে দর্শকের বিবমিষা হতে থাকে তার স্বামীর কার্যকলাপ দেখে। সে আপন সন্তানের থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয় ভিন দেশের নাগরিকত্ব পাওয়াকে। অফিসে সহকর্মীর মুখ থেকে আমরা জানতে পারি, পূর্বে সে স্ত্রীকে মেরে প্রায় হাত ভেঙ্গে দেওয়ার যোগাড় করে ফেলেছিল! দেবিকা তা নিয়ে সরব না হলেও সন্তানদের কারণে তৈরি হওয়া ক্রাইসিসে যখন অনিরুদ্ধ তাকে চড় কষিয়ে দ্যায় – সেও উল্টে সপাটে থাবড়া দিয়ে দিতে দ্বিধা করে না। ছবির নানা দৃশ্যে অনিরুদ্ধের অবিবেচক আচরণ দেখে, বুঝতে দেরী হয় না, দেবিকার স্বামীটি একজন ‘আবিউসার’ এবং নিষ্টুর প্রকৃ্তির মানুষ। যে আবেগপ্রবণ স্ত্রীকে নির্দ্বিধায় মানসিক রোগী বলে চিহ্নিত করে ফেলে। এবং দুর্ভাগ্যের বিষয়, পরিচালক ছবিতে এই গৃহ-হিংসার প্রসঙ্গটিকে পুরোপুরি এড়িয়ে গিয়েছেন। মায়ের লড়াইকে মহীয়ান করে দেখাতে গিয়ে, তিনি এক অত্যাচারিতা স্ত্রী-র অবস্থাকে গুরুত্ব দেন নি। গুরুত্ব দেন নি, অনিরুদ্ধের অত্যন্ত টক্সিক আচরণকেও। পরিচালকের এই অবিবেচনা এই অসীম সম্ভাবনাময় গল্পটিকে বেশ খানিকটা ফিকে করে দেখায়। বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে ছবি নির্মাণ করতে গেলে, যে দায়বদ্ধতা প্রকৃ্ত ঘটনাটির প্রতি থাকা উচিত, পরিচালক তা পালন করতে পারেন নি। মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সাস নরওয়ে, নরওয়েতে অভিবাসী এক ভারতীয় এবং বাঙালি দম্পতির জীবনের ভয়াবহ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত ছায়াছবি। ২০১১ সালে মিসেস সাগরিকা চ্যাটার্জি এবং মিস্টার অনুরূপ চ্যাটার্জির দুই সন্তানকে অবহেলার অভিযোগ দেখিয়ে নরওয়ে সরকার উঠিয়ে নিয়ে যায়। সেই ঘটনাকে নিয়েই ছবিটি করেছেন পরিচালক অসীমা ছিব্বার। এবং ছবির চিত্রনাট্যে বিস্তর গোলমাল দেখা যায় – আগেই জানানো হয়েছে।

রাণী মুখার্জি সম্ভবত জীবনের সেরা কাজ করেছেন এই ছবিতে। অনির্বাণ সামান্য হতাশ করেছেন। এবং এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, তাঁর চরিত্রটি চিত্রনাট্যের দাক্ষিণ্য পায় নি একেবারেই। পরিচালক তাঁকে ভিলেন না হিরো হিসেবে পর্দায় আনবেন – এই ব্যাপারটায় মনস্থির করতে পারেন নি। ফলে যা হওয়ার হয়েছে। জিম সর্ভ অসামান্য। তাঁর অভিনয় এই ছবির সম্পদ। অমিত ত্রিদেবীর মিউজিক আরেঞ্জমেন্ট চমতকার। কেবল পরিচালক যদি আর একটু বাস্তবধর্মী উপায়ে চিত্রনাট্য রচনা করতেন এবং নীরবতাকে যথাযথ গুরুত্ব দিতেন তাহলে মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সাস নরওয়ে ভারতীয় ছবির মাইলস্টোন হিসেবে বিবেচিত হতে পারত নিঃসন্দেহে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *