মাসাবা, ‘মেস’ এবং মা

মাসাবা, ‘মেস’ এবং মা
অদিতি বসুরায়

নেটফ্লিক্সে ছটি এপিসোডে ‘মাসাবা মাসাবা’-র স্ট্রিমিং হয়েছে।

মা ভালবাসেন ঘরের রাজমা-চাউল, মেয়ের পছন্দ নয়! মেয়ে কাজে ব্যস্ত – মায়ের ফোন আসতে থাকে, একবার-দুবার-তিনবার! মেয়েকে ইনভেস্টর তাড়া দিচ্ছে – মা ফোন কেড়ে নিয়ে ধমকে দিলেন। মাকে চেনা লাগছে ? লাগবেই! আমাদের মায়েরা এই রকমই হন। নীনা গুপ্তা চলচ্চিত্র তারকা, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী – কিন্তু মাসাবার মা, নীনা এক্কেবারে আমাদের ঘরের চেনাশোনা মা। যিনি মেয়ের জন্য অপেক্ষা করেন, মেয়ের জামা-কাপড় ইস্ত্রি করিয়ে রাখেন, মেয়ের ডায়েটের যত্ন নেন – এই ষাট ছুঁই-ছুঁই নীনাকে দুনিয়া এক্কেবারে অন্যভাবে জানে। আঠাশ বছর বয়েসে, ভারতীয় রক্ষণশীলতাকে এক ফুঁইয়ে উড়িয়ে দিয়ে নীনা গুপ্তা মেয়ে মাসাবাকে জন্ম দেন। প্রবাদপ্রতীম ক্রিকেটার ভিভ রিচার্ড এবং তাঁর প্রেমের ফসল এই কন্যা। কিন্তু ভিভ ও নীনা বিয়ে করেন নি। যদিও সে প্রসঙ্গ তেমন ভাবে আসে নি ‘মাসাবা মাসাবা’ নামের তুমুল জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজটিতে। এই সিরিজ মূলত মা-মেয়ের গল্প বলে। মা বিগত-যৌবনা অভিনেত্রী, যিনি এক কালে জাতীয় পুরষ্কার পেলেও এখন আর সেভাবে কাজ পান না। মেয়ে অসামান্য প্রতিভাশালী ফ্যাসান ডিজাইনার। কিন্তু সেও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে জেরবার ! ডিভোর্স, মায়ের সঙ্গে তর্কাতর্কি, বন্ধুদের সাথে ঝামেলা, কাজের জায়গায় মনোযোগ দিতে না পারা এক দিশেহারা যুবতী, মাসাবা! উচ্চকোটি এবং বিলাসবহুল লাইফ-স্টাইলে অভ্যস্ত সে! নিজেকে প্রশ্ন করতে শেখেনি কোনওকালে। ফলে বন্ধুর সঙ্গে তো দূরের কথা, ডিভোর্স নিয়ে চিন্তিত মাকে পর্যন্ত সে ডিভোর্সের ব্যাপারে কিছু বলে না – অথচ পুরো ব্যাপারটা ইন্সট্রাগ্রামের পোস্ট দিয়ে ঘোষণা করে। আবার মায়ের সঙ্গে কথা-কাটাকাটির পর মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা সোজাসুজি না বলে সেই ইন্সট্রাগ্রামের পোস্ট দেয়। এই প্রজন্মের ইন্টারনেট সর্বস্ব জীবনের বেশ কিছুটা বাস্তব ছবি এই ওয়েব সিরিজ তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে উঠে এসেছে, দূরদর্শিতার অভাব ও স্বার্থপরতার চিত্রও। মাসাবা ডিভোর্সের পর প্রাক্তন প্রেমিককে ডাকে শুধু যৌনতার জন্য – সামান্য তর্কের পরিপ্রেক্ষিতে নিঃসঙ্গ মায়ের কথা না ভেবে আলাদা বাসা খুঁজে নেয় –যেখানেই নিজের বুদ্ধি খাটানোর প্রয়োজন হয়, সে ছোটে থেরাপিস্টের কাছে। এদিকে সম্পর্ক বা কাজ – যেখানেই সমস্যার মুখোমুখি হয়, সে ভাবে ইন্টারনেট-এ সব সামলে নেবে! তার প্রাণের বন্ধু জিয়া একই ভাবে ইন্টারনেটের মাসাবার জন্যে বয়-ফ্রেন্ড খুঁজতে থাকে। শুধু মাসাবা আর জিয়াই নয়, মা নীনাও মোটামুটি ভাবে এই ইন্সট্রাগ্রাম নিয়েই আছন্ন থাকেন। তবে ব্যক্তিগত পরিসর উন্মোচনের জন্য নয় – কাজের জন্য! মেয়ের ইন্সট্রাগ্রাম পোস্ট তাঁর কেরিয়ারকে নবজীবন দান করে। তিনি এই বয়েসে এসে মূল চরিত্রে কাজ করার সুযোগও পেয়ে যান !

পরিচালক সোনম নায়ার অত্যন্ত আন্তরিক ভঙ্গিতে কাজ করেছেন। ছবির গল্প লিখেছেন তিনি এবং নন্দিনী গুপ্তা, অনুপমা রামচন্দ্রন। নীনা ও মাসাবাকে নিয়ে কাহিনী নির্মাণ যদিও গোড়াতেই ডিক্লেইমার দিয়ে দেওয়া হয়েছে, ছবির গল্প কাল্পনিক। তবে ফারহা খান বা কিয়ারা আদবানি ছবিতে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্যভাবেই এসেছেন। ছবি হিসেবে এই ওয়েব সিরিজের বেশ কিছু ত্রুটি আছে। প্রথমত, নীনা গুপ্তার মতো অভিনেত্রীকে যেভাবে কাজ পাওয়ার জন্য ছোটাছুটি করতে দেখা গেল, তাতে দর্শকের কমিক রিলিফ জুটলেও, বাস্তবে তা ঘটে বলে মনে হয় না। একই ব্যাপার নজরে আসে মাসাবার কাজের ক্ষেত্রে। একজন ফ্যাশান ডিজাইনার শুধু স্টারবাকস-এর কফি খেতে খেতে স্টোরে আসে এবং সেখানে বন্ধু জিয়া বিয়ারের ক্রেট নিয়ে উপস্থিত হয়, যদিও মাসাবা তা প্রত্যাখ্যান করে – কিন্তু কিভাবে তিনি কাজ করেন, কোন পদ্ধতিতে স্টুডিও চলে – কিছুই দেখানো হল না। শুধু ইনভেস্টরের তাড়া দিতে স্টোর ভিজিট এবং গহেনা ও দলবলের ছোটাছুটি – ব্যস! এটুকুই। পরিচালক মাসাবার এবং নীনার ‘মেসি লাইফস্টাইল’ দেখাতে এতো ব্যস্ত ছিলেন যে মা এবং মেয়ের সম্পর্কের গভীরতা, তাদের অন্য রকম বাঁচাকে দেখলেনই না। ফলে নীনা-মাসাবার কেমিস্ট্রিটা মিস করে গেল, এই ওয়েব সিরিজ। মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি দৃশ্যে, মা-মেয়ের গহীন আত্মিক যোগাযোগকে দেখা যায়! বিশেষ করে, যেখানে নীনা, মেয়েকে বলেন আপাত গোলমেলে ব্যাপার-স্যাপারই জীবনকে প্রস্ফুটিত করে এবং উপভোগের সুযোগ করে দেয় কারণ ‘মেস ইজ বিউটিফুল’। এবং ঠিক এই মুহুর্ত থেকেই মাসাবা তার নতুন পোশাক-কালেকশন তৈরি করার আইডিয়া পেয়ে যায়। শুরু হয় আর একটা জার্নি। নীনার জীবনেও ব্রেক আসে।

নীনা গুপ্তার অভিনয় ক্ষমতা নিয়ে কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। অবাক করেছেন মাসাবা! অসামান্য কাজ করেছেন তিনি। প্রতিটি ফ্রেমেই তাঁকে দেখতেও দুর্দান্ত লেগেছে। অনেক তারকা কন্যাদের থেকে পরিণত তাঁর অভিনয়। যদিও মাসাবা একটি ইন্টারভিউতে জানিয়েছেন, নীনা চান না তিনি ছবিতে অভিনয় করুন। তবে প্রথম ছবিতেই এতো যথাযথ কাজ খুব কম অভিনেত্রীই করতে পারেন।

উচ্ছল, কাজ পাগল, আত্মনির্ভর মেয়েদের কেন্দ্রে রেখে নির্মিত এই ওয়েব সিরিজ জনপ্রিয়তার নিরিখে অনেকখানি পেছনে ফেলে দিয়েছে বাকি সিরিজগুলোকে। এখানে মাতৃশক্তির জয়!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *