binodan-nonta-swad

নোনতা স্বাদেই জীবনের রেসিপি শেখালেন শর্মাজী
ফিল্ম রিভিউ
স্বাতী চট্টোপাধ্যায় ভৌমিক


ছবি: শর্মাজী নমকিন
মাধ্যম: আমাজন প্রাইম
পরিচালনা: হিতেশ ভাটিয়া
অভিনয়ে: ঋষি কাপুর, পরেশ রাওয়াল, জুহি চাওলা, সুহেল নায়ার, ঈশা তলওয়ার, সুলগ্না পানিগ্রাহী, গুফি পেন্টাল, পরমিত শেট্টি, সতীশ কৌশিক, শিবা চাড্ডা, আয়েশা রাজা, শিশির শর্মা।

শেষ কিছু বছরে একটি বিশেষ ঘরানার ছবি হিন্দি ইন্ডাস্ট্রির দর্শকদের কাছে জায়গা করে নিয়েছে, একে লাইট কমেডি বলা চলে। ৭০-৮০র দশকের বাসু চ্যাটার্জী বা সাই পরাঞ্জপের ছবিগুলোর সঙ্গে কিছুটা মিল থাকলেও বর্তমানে আর্থ সামাজিক চিত্র সে যুগের থেকে পাল্টে গেছে অনেকটাই। তাই আজকের ছবিতে এ যুগের মধ্যবিত্ত সমাজের ছাপ স্পষ্ট, তবে সেই সঙ্গে প্রতিদিনের কঠিন থেকে কঠিনতম লড়াইয়ের মোকাবিলা করতে করতেও জীবন থেকে হাস্যরস সংগ্রহ করতে ভোলে না এই ঘরানার ছবি। আবার হাসতে হাসতেই শিখিয়ে যায় জীবনের কিছু অমোঘ সত্য। ঋষি কাপুর অভিনীত ‘দো দুনি চার’ বা পরেশ রাওয়াল অভিনীত ‘হাম দো হামারে দো’ ছবিগুলি এই গোত্রের ছিল।

এই দুটি ছবির নাম নেওয়ার কারণ হলো এই দুজন অভিনেতার অভিনয়ের রেঞ্জ নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠতে পারে না। দুজনেই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রেও যতটা সাবলীল আবার আমাদের খুব চেনা পাড়ার যে কোনও কাকা জ্যাঠার চরিত্রেও মানিয়ে যান প্রশ্নাতীতভাবে। এই ছবিতে রয়েছেন এই দুজনেই, আর জেনে বা না জেনে ভারতীয় ছবির ইতিহাসে এ ছবির নাম তুলে দিয়েছেন সার্থকভাবে। কারণ বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসেও এমন খুব কমই হয়েছে যে একই ছবিতে একই চরিত্রে দুজন অভিনেতা কাজ করেছেন। এই ছবিতে ঋষি ছিলেন শর্মাজির চরিত্রে। কিন্তু অকালমৃত্যু তাঁকে কেড়ে নিল দর্শকদের থেকে। অসুস্থ অবস্থাতেও তিনি বার বার চেয়েছেন একটু সুস্থ হয়ে উঠে শুটিং শেষ করবেন। কিন্তু মানুষের চাওয়ার ওপর কিছুই নির্ভর করে না। যা হয় মূল অভিনেতার মৃত্যু হলে, তেমনটা ভেবে নিয়েই এই ছবিটিও বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তবু শেষ চেষ্টা হিসেবে পরেশ রাওয়ালকে একবার প্রস্তাব দেওয়া হয়, এটা ধরে নিয়েই যে তিনি রাজি হবেন না। সুপারস্টার অভিনেতার জুতোয় পা গলানোর সাহস সকলের থাকে না। কিন্তু মিরাক্যলের মতো রাজি হলেন পরেশ। শেষ হলো ছবিটি। এ ছবির আলোচনায় এই গল্প আসতে বাধ্য। কারণ এই ঘটনাই ছবিটিকে এক আলাদা উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।

ব্রিজ গোপাল শর্মা চাকরি থেকে অবসর নেন। বা বলা যায় তাকে জোর করেই অবসর দিয়ে দেওয়া হয়, সময়ের আগেই। শর্মাজী লোকটি সাদাসিধে, আমুদে প্রকৃতির। সব অবস্থা থেকে ভালটাই বার করে নেন তিনি। কারোর বিরুদ্ধে মনে কোন ক্ষোভ জমিয়ে রাখেন না। তাই অবসরের ব্যাপারটাও ভালো মনেই মেনে নেন তিনি। ভেবেছিলেন আরামে ছুটি কাটাবেন আর ভালোমন্দ রান্না করবেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে একাই মানুষ করেছেন তিনি দুই ছেলেকে। রান্নাবান্নাও একাই সামলান, এবং নিত্য নতুন রান্না করতে ভালবাসেন শর্মাজী। কিন্তু ছুটি জিনিসটা বেশিদিন কারই বা ভালো লাগে। শর্মাজীরও লাগলো না। অগত্যা সময় কাটানোর হরেক পদ্ধতি পরীক্ষা করে দেখলেন তিনি। কিন্তু টিভি সিরিয়াল থেকে ফেসবুক বা ওয়াটসঅ্যাপ কোনও কিছুই তাকে বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারে না। এমন এক সময়ে বন্ধু চাড্ডা তাকে পরামর্শ দেন নিজের রান্নার ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি স্টার শেফ হয়ে যেতে পারেন। প্রয়োজন শুধু সঠিক লোকের সঙ্গে যোগাযোগের। সম্ভ্রান্ত মহিলাদের কিটি পার্টিতে ভালো শেফের কদর রয়েছে। শুরুটা সেখান থেকেই করা যায়। সেই একদিনের রান্নার ফলস্বরূপ পাল্টে যায় শর্মাজীর জীবন। আবার এতদিনের সাজিয়ে রাখা ছোট ছোট ভরসা আর ভালবাসার জায়গাগুলোও নড়ে যায় যেন। কীভাবে, তা জানতে গেলে ছবিটা দেখে ফেলুন। আমরা বরং সেই ফাঁকে একটু আলোচনায় যাই।

সমাজের অগ্রগতি আমাদের মতো তথাকথিত শিক্ষিতদের কিছু ফাঁকা বুলি শিখিয়েছে যেগুলো আমরা হামেশাই আওড়ে থাকি, কিন্তু মন থেকে বিশ্বাস করি না। যেমন ‘বয়স একটা সংখ্যা মাত্র’ বা ‘কোনও কাজই ছোট নয়’ এমন আরও কত আছে। অন্যকে বলার সময় আমরা বড় মুখ করে নিজের উদারতার পরিচয় দিলেও একই ঘটনা নিজের বাড়িতে ঘটলে ভেতরের নখ দাঁত বেরিয়ে আসতে সময় লাগে না। এই ছবি সেই প্রবাদ বাক্যগুলোকেই সত্যি করে দেখায়। চাকরিতে অবসর মানেই একটা মানুষকে খরচের খাতায় ফেলে দেওয়ার সময় আমরা ভেবেও দেখি না চাকরির পরের জীবনটা কীভাবে আরও সুন্দর হতে পারে। শর্মাজী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেলেন নিজের আনন্দর থেকে বড় জীবনে আর কিছুই হতে পারে না।

ছবি দেখতে শুরু করার আগে ভয় ছিল একই চরিত্রে দু’জনকে দেখতে কেমন লাগবে। কিন্তু এত ঘন ঘন প্রায় প্রতি দৃশ্যে দুই অভিনেতা বদল হয়েছেন যে ব্যাপারটা প্রথম দু-একটা দৃশ্যের পরেই গা সওয়া হয়ে যায়। আরও একটা জিনিস গা সয়ে যায়, বরং বলা ভালো দেখতে ভালোই লাগে, সেটা হলো দুই অভিজ্ঞ অভিনেতার নিজস্ব স্টাইলের অভিনয়। ঋষির অভিনয়ে বরাবরের মতোই সেই দুষ্টু মিষ্টি প্রাণবন্ত মেজাজ দেখা গেছে শুরু থেকে শেষ অবধি। অন্যদিকে পরেশ অভিনয় করেছেন তাঁর সহজ সাবলীল ছন্দে। কোথাও তিনি ঋষির শর্মাজী হয়ে উঠতে চাননি। বরং নিজস্ব স্বাভাবিক অভিনয়কে কাজে লাগিয়ে অবলীলায় এক অন্য শর্মাজীর সৃষ্টি করেছেন। অথচ একফোঁটা চোখে লাগেনি, তালও কাটেনি। দুঃখের বিষয় হলেও সত্যি, ঋষির অভিনীত অংশ এ ছবিতে পরেশের অংশের চেয়ে অনেকটাই কম। তবু ছবি শেষে দুজনেই স্বমহিমায় বিরাজ করবেন দর্শকের মনে। শর্মাজীর এই দ্বৈত সত্বাকে ঘিরে যারা ছিলেন সেই জুহি, সুলগ্না, শিবা, আয়েশারা প্রত্যেকেই চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে গেছেন সুন্দরভাবে। জুহি আর ঋষির কেমিস্ট্রি চোখকে আরাম দেয়, ফিরিয়ে দেয় নব্বই দশকের স্মৃতি। অন্যান্য অভিনেতারাও যথাযথ।

হালকা মজার ছবি হলেও এ ছবি একদিক দিয়ে ফুড ফিল্মও। খুব যত্নের সঙ্গে প্রতিটি রান্না দেখানো হয়েছে। আর সেই সঙ্গে গার্নিশিংও। প্রতিটা রান্নাই দেখতে অত্যন্ত লোভনীয় লাগে। ভালো রাঁধতে জানা যে একটা আর্ট সে কথাও এই ছবি মনে করিয়ে দিয়েছে বার বার। সে যতই শর্মাজীর ছেলে সন্দীপ সেই নিয়ে তাচ্ছিল্য করুক, দর্শক কিছুতেই তার সঙ্গে সহমত হতে পারবেন না।

এই ধরণের ছবিগুলি প্রেক্ষাগৃহে না আসুক ডিজিট্যাল মাধ্যমে ভালো ব্যবসা দেওয়া শুরু করেছে। তার কারণ সম্ভবত প্রাত্যহিক জীবনে নানা টেনশন স্ট্রেস সামলাতে গিয়ে মানুষ জেরবার। তাই কাজ সেরে সন্ধেবেলার চা জলখাবার হাতে এরকম এক ‘ফিল গুড’ ছবি আনন্দ দেয় বইকি! চারদিক দিয়ে প্রলোভন দেখানো ঝাঁ চকচকে বড় বাজেটের ছবিকে সরিয়ে রেখে একটা দিন এই ছাপোষা মধ্যবিত্ত জীবনের গল্পকে আপন করে নিলে বলা বাহুল্য খারাপ কাটবে না সময়টা।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *