binodan-smritir-studiopara-part-11

স্মৃতির স্টুডিওপাড়া — ভূতই ভবিষ্যৎ
ফিল্ম রিভিউ
প্রিয়ব্রত দত্ত

স্বপন সাহা

নিজের ক্ষমতা আর ক্যারিশমার উপর পূর্ণ আস্থা ছিল অঞ্জন চৌধুরির। হারানোর কোনও ভয় ছিল না তাঁর। তাই ইন্ডাস্ট্রিকে একটার পর একটা পরিচালক উপহার দিয়েও দিনের শেষে তিনিই ছিলেন সম্রাট। হরনাথ চক্রবর্তী, সুজিত গুহ, অনুপ সেনগুপ্ত, বাবলু সমাদ্দার, বাবু রায়, প্রত্যেকেই একসময় অঞ্জন চৌধুরির সহকারী ছিলেন। পরবর্তীকালে ওঁরা স্বাধীন পরিচালক হিসেবে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে স্বকীয়তার ছাপ রেখেছেন। হরনাথ চক্রবর্তীর ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘সাথী’ তো ইতিহাস। পরিচালকরা প্রধানত অভিনেতা, অভিনেত্রী আবিষ্কার করে থাকেন। অঞ্জনদা ছিলেন ডিরেক্টর তৈরির কারখানা। হরনাথ, সুজিত গুহ, অনুপ সেনগুপ্তদের প্রতিষ্ঠার পেছনে অঞ্জনদার অবদান ছিল দ্রোণাচার্যের মতো। চিত্রনাট্য পরিমার্জনা থেকে শুরু করে শিল্পী নির্বাচন, কী করে কম বাজেটে ছবিটা তৈরি হবে, তার জন্য প্রভাব খাটিয়ে সস্তার লোকেশন জোগাড় করা, চেনা হোটেলে কম খরচে শিল্পী কলাকুশলীদের থাকার বন্দোবস্ত করে দেওয়া এবং শুটিং ফ্লোরে নিজে উপস্থিত থেকে ছাত্রদের উৎসাহ দেওয়া, সবেতেই অঞ্জনদা যেন পিতৃতুল্য। যথার্থ অভিভাবকের মতো মাথার উপর হাত দিয়ে থাকতেন।

অঞ্জন চৌধুরি ছিলেন যুগ সন্ধিক্ষণ। উত্তম-উত্তর সময়ের হাহুতাশ, উদ্বেগ, আশঙ্কাকে মুছে দিয়ে বাংলা ছবির নব জোয়ার এনে দিয়েছিলেন তিনি। তবুও নিজেকে কখনওই জাহির করতে না অঞ্জনদা। তাঁর সময়ে আরও দুজন পরিচালক নিজেদের আলাদা করে চিনিয়ে ছিলেন। তাঁরা হলেন প্রভাত রায় ও স্বপন সাহা। বরেণ্য পরিচালক তরুণ মজুমদারের প্রবল উপস্থিতির কথা মাথায় রেখেই বলছি। তনুবাবু প্রবলভাবে বাণিজ্যিক ধারার পরিচালক হয়েও, কোথাও এঁদের থেকে অনেকটাই স্বতন্ত্র ছিলেন। প্রভাত রায়ের ‘শ্বেতপাথরের থালা’ ফের প্রমাণ করে দিয়েছিল, বাংলা ছবির সাফল্য লুকিয়ে আছে ঐশ্বর্যশালী সাহিত্যে। স্বপন সাহা দেখিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে কম বাজেটে বাজিমাত করতে হয়। ১৯৯৬ সালে তাঁর পরিচালিত ছবির সংখ্যা ছিল দশ। ‘৯৭ তেও প্রায় ওই দশের কাছাকাছি। ‘৯৮ তেও তাই। এত দ্রুত ও সংখ্যায় আজ পর্যন্ত টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিতে কোনও পরিচালকই ছবি বানাতে পারেননি। এই সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড- এ নাম উঠেছিল স্বপন সাহার। দ্রুত ছবির তৈরির তাড়নায় একবার একটা অভিনব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললেন স্বপনদা। পরে তা নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়েছিল।

এনটি ওয়ান স্টুডিওয় স্বপন সাহার ছবির শুটিং চলছে। ফ্লোরে দাঁড়িয়ে শুটিং দেখছি। শট দিচ্ছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, অনামিকা সাহা, সম্ভবত দুলাল লাহিড়ী প্রমুখ। ছবির নাম আজ আর মনে নেই। ঘরের দৃশ্য। দু’ তিন বারে শট ওকে হতেই স্বপনদা বলে উঠলেন, ‘নেক্সট শট তিন নম্বর স্ক্রিপ্টের।’ শুরু হয়ে গেল যুদ্ধকালীন তৎপরতা। শিল্পীরা সব যে যাঁর মেকআপ রুমে। দেখছি ঘরের জানালা দরজার পর্দা পাল্টে গেল। বিছানা ঘুরে গেল উত্তর থেকে পূর্ব দিকে। ড্রেসিং টেবিল, দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডার, আয়না সব এদিক- ওদিক হয়ে গেল। সেই মতো আলোর অবস্থান বদলানো হলো। সব রেডি হতেই আর্টিস্ট কল করা হল। ফ্লোরে এসে পৌঁছলেন প্রসেনজিৎ, অনামিকা, দুলাল। সম্পূর্ণ ভিন্ন লুক। অ্যাকশন বলতেই শট শুরু হল। একি! আগের শটে তো অনামিকা সাহাকে বুম্বাদা মা বলে সম্বোধন করছিল। এখানে দিদি বলছে কেন? ব্যাপারটি বোধগম্য হল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুটিং দেখছি আর ঘামছি। ভাবছি, তাহলে ছবিতে অনামিকাদির ডবল রোল? মা আর মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করছেন?

প্রভাত রায়

চমকের তখনও শেষ হয়নি। আগের শটে প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জির চরিত্রের নাম ছিল বাদশা। এখন দেখছি বাবলু! কেসটা কী? শট শেষ হল প্রায় ঘন্টা খানেক পরে। কী ভুলভাল ব্যাপার। ‘কাট… নেক্সট আমরা এক নম্বরে যাব।’ এই তিন নম্বর, এক নম্বরের চক্করটা ঠিক ধরতে পারছি না। সামনেই দেখি স্পটবয় পল্টু। ওকে জিজ্ঞাসা করতেই ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে হেসে চোখ মেরে স্বপনদাকে দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল। অগত্যা পরিচালকের পাশে গিয়েই দাঁড়ালাম।

‘এইটা বুইতে পারলেন না, একসঙ্গে তিনটে সিনেমার শুটিং করসি!’

‘মানে!’

‘একই সেটের খরচায় তিনটে সিনেমা। খালি পর্দার কাপড়ের রঙ আর চেয়ার টেবিলগুলার পজিশন অদল বদল করে দিলেই হল। প্রোডিউসার একজন। তাঁর একটা ছবির খরচে তিনটে ছবি হয়ে যাচ্ছে। একই সেট একই লোকেশন, একই আর্টিস্ট আর টেকনিশিয়ান… লাইট, ক্যামেরা, প্রপস সব এক। শুধু আর্টিস্ট আর টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে একটা প্যাকেজ করে নিলেই ল্যাটা চুকে গেল।’

সেদিন ফিরে খবরের হেডিং করেছিলাম, ‘স্বপনের এক ঢিলে তিন সিনেমা।’ স্বপন সাহার এই সস্তায় বাজিমাত করার পদ্ধতিটাকে সেদিন স্টুডিও পাড়ায় কেউ ভালো চোখে দেখেননি। প্রভাতদা টিপ্পনী কেটে বলেছিলেন, ‘বাবা কেন চাকর এবার বোঝা গেল।’

জানতো সবাই। আমার খবরটা একটা লিখিত প্রামান্য দলিল হয়ে দাঁড়ালো। তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল টেকনিশিয়ান গিল্ডে। তখন প্রবল বাম জমানা। আসরে নেমে পড়ল ফেডারেশন ও ব্রোটা। দুটোই টেকনিশিয়ানদের সংগঠন। তখন আর্টিস্ট ফোরামের অতটা দাপট ছিল না। তবে সিনিয়র অভিনেতাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রতিবাদ জানাতে শুরু করলেন।

হরনাথ চক্রবর্তী

এরই মধ্যে একদিন স্টুডিও পাড়ায় ঢুকতেই একজন খবর দিল, স্বপন সাহা আমাকে খুঁজছেন। স্বপনদার অফিস ছিল টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে। এখন সে সবের আর চিহ্ন নেই। যাইহোক, আমি টেকনিশিয়ান না গিয়ে সোজা বেহালার বাস ধরলাম। অঞ্জনদা বেশ বিরক্ত। বললেন, ‘যাই দেখবি সব খবর করতে হবে? এখন এসেছিস, খবরটা করার আগে আমাকে একটা ফোন করতে পারলি না?’

আমি বললাম, ‘তাহলে কি আমি ভুল করলাম অঞ্জনদা?’

‘একটু তো করেইছিস। এখন যদি তিনটে ছবির কাজই বন্ধ হয়ে যায়, টেকনিশিয়ানগুলোর পেমেন্ট কে করবে? তুই?’ ধমক নয়, একটু অপ্রসন্ন গলায় বললেন অঞ্জনদা।

‘তাহলে আমি এখন কী করবো?’

‘স্বপনবাবুর সঙ্গে দেখা কর।’

‘যা বলবেন সেটাই তো খবর। কি করবো?’

‘আমাকে আর কমলকে বলবি। বুঝেশুনে লিখবি।’

‘আপনার কি মত? আপনি কি এইভাবে একসেটে তিনটে ছবির শুটিংকে সমর্থন করেন’।

‘কেন, আমাকেও কোট করবি নাকি?’

‘অবশ্যই।’

চুপ করে দু’তিন মিনিট ভাবলেন অঞ্জনদা। বললেন, ‘আমার কাছেও এমন প্রস্তাব এসেছিল। রাজি হইনি।

কেন?

কেন?

সিনেমাটা আমার কাছে আগে শিল্প পরে ব্যবসা। আমি, অঞ্জন চৌধুরি, টালিগঞ্জের একমাত্র পরিচালক, যে প্রত্যেক টেকনিশিয়ানকে মাস মাইনে দেয়। আমি ওই রকম প্যাকেজে ছবি করতেই পারতাম। কারোর কিছু বলার ছিল না। তবুও আমি করবো না। একসঙ্গে একহাতে পাঁচটা ল্যাটামাছ ধরা যায় না। বোঝাতে পেরেছি?’

বুঝেছি বলে উঠে পড়লাম। অঞ্জনদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা টেকনিশিয়ান। সন্ধ্যে হয় হয়।

অনুপ সেনগুপ্ত

এখন যেটাকে মেন গেট বলা হয়, ঠিক সেইখানেই ছিল স্বপনদার ছোট অফিস। ভারী চেহারা। ততধিক ভারী কাঁচা-পাকা গোঁফ। বসে আছেন পারিষদ পরিবৃত হয়ে। গিয়ে দাঁড়াতে একটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, ‘বসেন। আপনার খবরে আমার কুনো আপত্তি নাই। আমি চাইছিলাম আমার এই শর্টকাট প্রসেসটার ব্যাপারে সবাই জানুক। আমি একটা পথ দেখাতে চেয়েছি মাত্র। মুদ্রাটাকে উল্টাইয়া ফেলেন। আপনি যেটা বোঝেন নাই বা লেখেন নাই, সেটা হল কম সময়ে তিন তিনটা ছবির শুটিং। রিলিজ কি আমি একসঙ্গে করুম নাকি। এটা আমার একটা এক্সপেরিমেন্ট বলতে পারেন। দেখতে চাই এইভাবে আদৌ সিনেমা বানানো যায় কিনা। আপনি যুবা পুরুষ। উৎসাহে টগবগ করে ফুটছেন। যা দেখসেন সেটাই লিখে দিয়াসেন। বেশ করসেন। আসুন, চা সিঙাড়া খান।’

আমি সম্ভাব্য বিপর্যয়ের দু’একটা পয়েন্ট বললাম। একটা সিঙাড়ায় কামড় বসিয়ে স্বপনদার বললেন, ‘সবটা এই সিঙাড়ার মতো। ওপর দেখে ভেতর বোঝা যায় না। টেকনিশিয়ান গিল্ডের সভাপতি প্রণব চৌধুরি আমাকে ফোন করেছিলেন। আপনাকে যা বললাম, ওঁকেও একই কথা বলেছি। ছবিগুলোর আর তিনদিনের শুটিং বাকি আছে। পারলে এর মধ্যে আর একদিন সেটে আসুন।’

টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ার অনেক বোদ্ধার মতে বাঙলা ছবির অধঃপতনের শুরু স্বপন সাহার হাত ধরেই। আমি তা মনে করি না। ওই স্বপন সাহাই পরবর্তীকালে যদি খুব ভুল না করি ‘রাজমহল’ নামে একটা ছবি করেছিলেন। আদ্যন্ত হরর সাসপেন্স থ্রিলার। আমি তখন সানন্দায় লিখি। সম্পাদক ছিলেন অপর্ণা সেন। বিভাগীয় সম্পাদক সুমিত দে আমাকে দিয়ে একটি স্টোরি লিখিয়েছিলেন। শিরোনাম ছিল ভূতই ভবিষ্যৎ। নতুন শতাব্দীতে ভূতই যে বাঙলা ছবির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠতে চলেছে, তার সলতে পাকানোর কাজটা ড. স্বপন সাহাই করেছিলেন।

চিকিৎসক নন, গবেষক স্বপন সাহার পাণ্ডিত্যের তুলনা হয় না। কথার মধ্যে পূর্ব বঙ্গীয় টান থাকলেও ব্যক্তিত্বে ছিলেন রাশভারী। ‘রাজমহল’ নিয়ে সানন্দায় লিখব বলে গেলাম ওঁর কাছে। টেকনিশিয়ান স্টুডিওয়। সিঙাড়ায় কামড় দিয়ে বললেন, ‘আর কমার্শিয়াল ছবি করব না। জনার একটু পাল্টাবো বলেই সাসপেন্স থ্রিলার করছি।’ প্রশ্ন করলাম, তার মধ্যে ভূতের মতো অলৌকিক বিষয় মেশাচ্ছেন কেন? উত্তরে স্বপনদা যেটা বললেন, এখন সব পরিচালকের মুখে মন্ত্রের মতো সেটা শোনা যায়, আসলে মানুষ ভূত প্রিয়। ভয় পেতে খুব ভালোবাসে। এই নিয়ে আমি অনেক গবেষণাও করেছি। কথা বলেছি মনোবিদদের সঙ্গেও। আমার তো অনেক বদনাম। বাংলা ছবিকে নাকি রসাতলে পাঠিয়েছি। এবার মানুষ অন্য স্বপন সাহাকে দেখবে। পড়াশোনা করে দেখলাম, ভূতই বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ।’

রাজমহল বাণিজ্য সফল ছবি। এখন যখন অনীক দত্তর ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ দেখি তখন স্বপনদার কথাগুলো মনে পড়ে। বাঙালির মুখে উঠতে বসতে টিপ্পনী শোনা স্বপনদা ২০১৭ সালে শ্রেষ্ঠ বাঙালির শিরোপা পেয়েছিলেন।

আশি-নব্বইয়ের দশকে অঞ্জন চৌধুরি, প্রভাত রায়, স্বপন সাহা সহ অঞ্জন-শিষ্যরা বাংলা ছবিকে যা দিয়ে গেছেন, আজকের পরিচালকরা সেটা কল্পনাই করতে পারবেন না। তখন অপ্রতুল প্রযুক্তি ও সীমিত পুঁজি নিয়েও পরিচালকরা বিনোদনের কোনও খামতি রাখেননি। টেলিভিশন এসে গেলেও মানুষ হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছে। আসলে স্বপন-অঞ্জনদের রসায়নের রহস্যটাই ছিল মফস্বলের মানুষের ম্যানিফেস্টো। কৌশিক গাঙ্গুলির ‘অর্ধাঙ্গিনী’র অর্ধেক বক্তব্য বনগাঁর বর্ডারে থাকা ক’জন মানুষ বুঝবে! মাল্টিপ্লেক্স মহাকাশে ফুরফুরে ডিওর সুবাস মেলে, মাটির সোঁদা গন্ধ সেখানে নিষিদ্ধ।

কেন?

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *