তপন সিংহ এগিয়ে আসছেন আমার দিকে
প্রিয়ব্রত দত্ত
টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ায় আমার একটা ডাকনাম আছে। বদনামও বলা যেতে পারে। ‘হাঁ করা’। পুরনো পরিচালক, টেকনিশিয়ানদের কেউ কেউ ভালোবেসে এখনও ওই নামে ডাকেন আমায়। স্নেহ মেশানো ওই নামে ডাকার লোক কমে যাচ্ছে ক্রমশ।
‘হাঁ করা’ হয়ে যাবার সঙ্গত কারণও ছিল। টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ায় খবর করতে গিয়ে অবসর পেলেই হাঁ করে শুটিং দেখতাম। মূলত অভিনয়। তখনও গ্রুপ থিয়েটারের সক্রিয় কর্মী। মঞ্চ ও পর্দার দুর্ধর্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চোখের সামনে বিনে পয়সায় অভিনয় দেখার সুযোগ কে ছাড়ে বলুন তো! ফ্লোরের এক কোণায় চুপচাপ প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, নির্মলকুমার থেকে শুরু করে ভারতীদেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, সুপ্রিয়াদেবী, গীতা দে’র মতো দিগগজ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় দেখতাম হাঁ করে।
প্রথম সারির পরিচালকদের শুটিং দেখার জন্যও ছোঁক ছোঁক করতাম। কিন্তু মুশকিল হল, তরুণ মজুমদার, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অসিত সেন, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর মতো পরিচালকরা খুব একটা বেশি ছবিও করতেন না, করলেও শুটিং দেখার অনুমতি দিতেন না।
আমার সৌভাগ্য, নব্বইয়ের দশকে বা তার একটু পরে অসিত সেন ছাড়া প্রায় প্রত্যেক প্রথমসারির পরিচালকের সিনেমার শুটিং দেখার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। যেমন তরুণ মজুমদার ‘আলো’ সিনেমার শুটিং দেখার অনুমতি দিয়েছিলেন। মৃণাল সেনকে পরিচালনা করতে দেখেছি ‘আমার ভুবন’ ছবিতে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘উড়োজাহাজ’-এর শুটিং দেখতে গিয়েছিলাম জামশেদপুর। তেমনই ‘শতাব্দীর কন্যা’র শুটিং ফ্লোরে থাকতে পেরে স্বপ্নপূরণ হয়েছিল তপন সিংহর শুটিং দেখার।
২ অক্টোবর ২০২৪ তপন সিংহর জন্মশতবর্ষ। ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘ঝিন্দের বন্দি’, ‘আপনজন’ ছবির পরিচালকের গল্প শুনে আর ওঁর সম্বন্ধে লেখা পড়ে মনে হত উনি যেন কোনও এক দিকশূন্যপুরের বাসিন্দা। বিশেষ মন্ত্র জানা মানুষ ছাড়া আর কেউ তপন সিংহর সাম্রাজ্যে প্রবেশ করতে পারেন না। উনি কোনও সভা সমিতিতে যেতেন না। কোনও বিষয়ে আলটপকা মন্তব্য করে ‘খবর’ হওয়ার চেষ্টা করতেন না। সিনিয়রদের মুখে শুনতাম, বিলেত ফেরত মানুষটি নাকি খুব রাশভারী ও নাক উঁচু। চট করে কাউকে ইন্টারভিউও দেন না। দেখাও করেন না। খুব চুপচাপ ও অন্তর্মুখী মানুষ। কেউ কেউ বলতেন, খুব দেমাক!
টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ায় যখন আনাগোনা শুরু করি, তখন ওঁদের প্রত্যেকেরই বয়স হয়েছে। খুব কম কাজ করেন। বছরে কী দু’বছরে কী তারচেয়েও বেশি সময়ে একটা বা দুটো ছবি তৈরি করেন। সেই বর্ষীয়ানদের তালিকায় তপন সিংহও আছেন। উনি শেষ কাজ করেছেন সেই ১৯৮৪ সালে। দূরদর্শনের জাতীয় কার্যক্রমের জন্য একটি টেলিফিল্ম। ‘দিদি’।
বহু বছর পর ১৯৯৫-৯৬ সাল নাগাদ ফের সিনেমা বানানোর কাজে হাত দেন তপন সিংহ। বাংলা সাহিত্যের পাঁচ প্রখ্যাত নারী চরিত্রকে কেন্দ্র করে পাঁচটি ভিন্ন গল্প নিয়ে তৈরি ছবির নাম ‘শতাব্দীর কন্যা’। এই ছবিটিই তপন সিংহের শেষ কাহিনিচিত্র।
শুটিং কবে শুরু করেছিলেন, সঠিক সাল-তারিখ বলতে পারব না। তবে ধীরে ধীরে সময় নিয়ে ছবিটি তৈরি করছিলেন। খবরের কাগজ, ম্যাগাজিনে পড়ছি শতাব্দীর কন্যা’র নির্মাণ পর্বের ইতিবৃত্ত। রিপোর্ট করছেন তৎকালীন প্রখ্যাত ও বর্ষীয়ান সাংবাদিকরা। পড়ছি আর ভেতরে ভেতরে একটা অসম্ভব ইচ্ছা তৈরি হচ্ছে। যদি এক মিনিটের জন্য হলেও তপন সিংহর ‘শট নেওয়া’ দেখা যেত! কিন্তু ঠিক কাকে ধরলে তপন সিংহর শুটিং ফ্লোর পর্যন্ত পৌঁছনো যাবে কে বলে দেবে! সিনিয়র সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসা করলে ‘বাচালের প্রলাপ’ বলে উড়িয়ে দেন। ‘আজকাল’-এ কেউ কোনও কুল কিনারা দিলেন না। উল্টে শাসিয়ে দেওয়া হল, না জিজ্ঞাসা করে ‘তপন সিনহা’র সেটে’ পা দিলে নয়-ছয়ে আর ঢুকতে দেওয়া হবে না। নয়-ছয় মানে ৯৬, রাজা রামমোহন সরণি, আজকাল পত্রিকার তৎকালীন দফতর। আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি আগেই বলেছি, ওই আজকালে। সান্ধ্য আজকাল-এ ফ্রিল্যান্সিং করতাম। লিখতাম সংস্কৃতি ও ফিচার পেজে। সিনেমার পাতা দেখতেন প্রবীর রায়। তিনি নিজোই সিনেমার খবরাখবর করতেন। মূলত প্রেস রিলিজ আর ফোনের ভিত্তিতে। আমার তখন সাংবাদিকতার বয়স মাত্র কয়েক মাস। আমার মতো চুনোপুঁটিকে উনি পাত্তাই দিতেন না।
একদিন আমার বিভাগীয় সম্পাদক (সংস্কৃতি) কমলদাকে মনের ইচ্ছার কথা বলছিলাম। পাশ দিয়ে যাবার সময় প্রবীরদা শুনে বললেন, ‘খবরদার, আমাকে জিজ্ঞাসা না করে তপন সিনহার সেটে ঢুকবে না। একদম নয়।’
শুনে কমলদা তাঁর সহকর্মীকে রসিকতা করে বললেন, ‘কেন, গেলে কী হবে? তোদের সিংহবাবু ওকে এক কামড়ে গিলে ফেলবে?’
‘কী জানে ও তপনবাবু সম্পর্কে? আর উনি কাউকে সেটে অ্যালাও করেন না।’ বলে প্রবীরদা ডেস্কের কাজে মন দিলেন।
কমলদা বললেন, ‘এই জন্মে তোমার এই শখ পূরণ হবার নয়। বুড়ো যা টলমল করছে, তাতে ‘শতাব্দীর কন্যা’ শেষ করতে পারেন কিনা সন্দেহ। ছবিটা নিয়ে অনেকদিন রগড়াচ্ছেন।’
অথচ সুযোগ ঘটে গেল। তপন সিংহর ফ্লোরে ঢোকার। শুটিং দেখার। অকল্পনীয়ভাবে!
সাধারণত আমি স্টুডিও পাড়ায় ঢুঁ মারতাম ভর দুপুরে। দুটো কারণে। প্রথমত কোনও না কোনও প্রোডাকশনের লাঞ্চটা জুটে যেত ঠিক। দ্বিতীয়ত, তখনকার উঠতি আর্টিস্টদের সঙ্গে দেদার আড্ডার লোভ। ওরা সব একে একে জড়ো হতো দুপুর পড়ে যাওয়ার পর।
ততদিনে পরিচালক দেবাংশু সেনগুপ্তর দৌলতে আমি আমার ‘হাঁ করা’ উপাধিটি অর্জন করে ফেলেছি। সঠিক দিনটির কথা মনে নেই। সময়টা মে-জুন মাস। বীভৎস গরম। দেবাংশুদার অর্ডার করা বইগুলো ডেলিভারি দিতে সকাল সকাল এনটিওয়ান চলে গিয়েছি। কারণ, সেকেন্ড হাফে মানে লাঞ্চের পর দেবাংশুদা থাকবেন না। ‘মহাপ্রভু’র ফ্লোরে ঢুকতেই চোখের ইশারায় কাছে ডাকলেন দেবাংশুদা। বললেন, ‘বইগুলো আমার ঘরে রেখে এক্ষুনি দু’নম্বর ফ্লোরে যা। তপনবাবু ‘শতাব্দীর কন্যা’র শুটিং করছেন।’
‘সত্যি!’
‘তোর সঙ্গে কি আমি মসকরা করছি? ‘শতাব্দীর কন্যা’র কিছু প্যাচওয়ার্ক আছে। লাঞ্চ অবধি। তারপর প্যাকআপ কিন্তু।’
‘না… না… তা নয়… আমাকে অ্যালাও করবেন উনি?’
‘গিয়ে তো দ্যাখ। অত্যন্ত ভদ্রলোক। হয় তোকে ভদ্রভাবে দূর করে দেবেন। না হলে দেখার অনুমতি দেবেন। দেখ না, কী হয়। দৌড়ো এক্ষুনি’ বলে শটে মন দিলেন দেবাংশুদা। আসলে দেবাংশুদাও জানতেন আমার গোপন ইচ্ছের কথাটা।
এতদিন মনে মনে সুযোগ পেলে ময়দান কাঁপানোর কায়দা ফাঁদছিলাম। এখন দুয়ারে সুযোগ। অথচ কার্যত গলা শুকিয়ে কাঠ। দু’নম্বর ফ্লোরের দিকে এগোতে গিয়ে অনুভব করলাম টয়লেট যেতে হবে।
বড় লোহার গেটটা দু’হাট করে খোলা। সাধারণত বন্ধই থাকে। বাইরের আলো ভেতরে ঢোকে বলে। ছোট গেটটা খোলা থাকে। ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। বুক ঢিপঢিপ করছে। সম্ভবত আলো আর ক্যামেরার পজিশন চেঞ্জ হচ্ছিল। একজন লাইট অ্যাসিসটেন্টের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে দুগ্গা… দুগ্গা… বলে ঢুকে পড়লাম ফ্লোরে।
কোথায় তপন সিংহ! এপাশ ওপাশ চোখ ঘুরিয়ে খুঁজে পেলাম না। এমনভাবে খুঁজছিলাম যেন ওঁকে আমি খুব চিনি। তা তো নয়, যা দেখেছি ছবিতে। তপন সিংহকে এর আগে সামনাসামনি বা দূর থেকেও চোখে দেখিনি কখনও।
তাহলে কি শুটিং প্যাকআপ? গলার কণ্ঠাটা টনটন করে উঠল। তীরে এসে তরী ডুবলো! আর একটু যদি আগে আসতাম। চুল ছেঁড়ার মতো অবস্থা। হঠাৎ একজন চেনা টেকনিশিয়ান পেয়ে গেলাম। লাইটের স্ট্যান্ড ঘাড়ে করে এদিকেই আসছেন। চোখাচোখি হতেই চোখের ইশারায় বললেন, সরে একপাশে দাঁড়াতে।
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘শুটিং প্যাকআপ?’
‘না… না… আরও দুটো শট আছে।’
‘ডিরেক্টর কোথায় গো?’
‘এই তো ছিলেন।’ দাঁড়িয়ে পড়ে লাইটের স্ট্যান্ড কাঁধে নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে, গোটা ফ্লোরে চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘বাথরুম-টাথরুম গেছে বোধহয়। তুমি এইরকম ফ্লোরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। বার করে দেবে। সাইডে গিয়ে দাঁড়াও।’
‘আর্টিস্ট কে?’
‘ও সব বম্বের… তবে নাম করা কেউ নয়। ছেলেটার নাম মিলিন্দ গুনাজি, মেয়েটা বাঙালি, তবে এখানকার নয়।’
‘কি নাম?’
‘নন্দিতা না কি যেন… ওই যে ডিরেক্টর আসছে…, বাথরুমে গেছিল। এনার্জি বলিহারি! এই বুড়ো বয়সেও অজ্ঞান হয়ে যাবার মতো গরমের মধ্যে সমানে দাঁড়িয়ে আছে। বসতে বললে বলে, আপনারা গরমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করছেন, আমি বসে পড়ি কী করে! বোঝ কাণ্ড!’ বলে লাইটের স্টান্ড কাঁধে নিয়ে কেটে পড়লেন সেই টেকনিশিয়ান।
আমিও মেন গেট ছেড়ে একটু পিছিয়ে গিয়ে স্টুডিওর দেওয়ালে সেঁটে গেলাম। দেখলাম মাঝারি উচ্চতার ধবধবে ফর্সা, বিরল কেশ (যেটুকু আছে প্রায় সাদা), চোখে গাঢ় বাদামি রঙের সরু ফ্রেমের চশমা, সাদা হাফ শার্ট আর সাদা প্যান্ট, পায়ে সাদা কেডস্ জাতীয় জুতো পরা এক ভদ্রলোক ফ্লোরে ঢুকে ডান দিকে চলে গেলেন। ছবি দেখেছি। তাই বুঝতে অসুবিধা হল না, ইনিই তপন সিংহ। একজন এসে ঘড়ঘড় করে ফ্লোরে ঢোকার বড় গেটটা বন্ধ করে দিল। কোথায় টলমল করছেন! সটান গটগট করে হেঁটে শুটিং স্পটে গিয়ে দাঁড়ালেন।
এতক্ষণ খেয়াল করিনি, এইবার চোখে পড়ল। ফ্লোরের ডান দিকে একটা উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়ির সদর দরজার সেট। দরজাটা নিচের দিকে। সামনে দু’ধাপ পোডিয়াম। দরজার উপরে রঙিন কাচের (কাগজের) স্কাই লাইট। আলো তৈরি হচ্ছে।
শটটা নেওয়া হবে বাড়ির ভেতর থেকে। ক্যামেরা বসানো হচ্ছে দরজার দিকে মুখ করে। আলোর তদারক যিনি করছেন, তাঁকে বিলক্ষণ চিনি। প্রখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার সৌমেন্দু রায়।
দু’জন সহকারী পরিচালক স্ক্রিপ্ট হাতে তপন সিংহ’র দিকে এগিয়ে এলেন। খাতার পাতায় চোখ বুলিয়ে ক্যামেরার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন পরিচালক। ক্যামেরার পেছনে রাখা ছোট স্টুল থেকে উঠে পড়লেন সৌমেন্দু রায়। পাটাতনে উঠে ক্যামেরার লেন্সে লুক থ্রু করলেন তপন সিংহ। ওই অবস্থাতেই মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘কই চারু একবার পজিশনটা দাও তো মা।’
সেটের বাঁদিক থেকে নায়িকা বেরিয়ে এসে, কিছুটা হেঁটে, দু’ধাপ সিঁড়ি দিয়ে নেমে, সদর দরজা খুলতেই দেখা গেল বৃষ্টি ভেজা কালো ছাতাটা মুড়ে হাতে নিয়ে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে কালো চাপ দাড়িওয়ালা এক যুবক। পরনে সম্ভবত হালকা নীল পাঞ্জাবি আর সাদা ধুতি। নায়িকার কস্টিউম, আটপৌরে কায়দায় পরা শাড়ি।
নায়িকা যুবককে দেখে বিস্মিত। থমকে গেছে। কয়েক সেকেন্ড পজ, তারপর নায়ক কিছু বলতেই (অত দূর থেকে সংলাপ শোনা যাচ্ছিল না) লজ্জিত নায়িকা নায়ককে সদর পেরিয়ে ভেতরে আসতে বলে। হাসি হাসি মুখে নায়ক চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাড়ির ভিতর পা রাখে। এইটুকু সিন টেক হবে। মিড লঙ শট। নায়ক-নায়িকার মুখোমুখি দাঁড়ানোটা ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলে ঠিক হচ্ছে না। তপন সিংহ ক্যামেরা থেকে চোখ তুলে এগিয়ে গেলেন তাঁর হিরো-হিরোইনের কাছে। দু’জনকে ধরে দেখিয়ে দিলেন দাঁড়ানোর পজিশনটা। আর একবার রিহার্সাল হবে। ঘুরে ক্যামেরার দিকে আসতেই কেলেঙ্কারি!
সরাসরি চোখাচোখি আমার সঙ্গে। আমিও উজবুক। এবং হাঁ করা! অভিনয় আর পরিচালকের রিঅ্যাকশন দেখার জন্য দেওয়াল ছেড়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে এসেছিলাম।
দেখি ক্যামেরা পেরিয়ে সরাসরি আমার দিকে হেঁটে আসছেন তপন সিংহ। আমার হাঁটু আর হার্ট দুটোই কেমন যেন করতে শুরু করছে! নির্ঘাত এবার বেরিয়ে যেতে বলবেন।
এগিয়ে আসতে আসতে মৃদু কণ্ঠে, অত্যন্ত মার্জিত উচ্চারণে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি… কিছু বলবেন…?’
ঢোক গিলে কোনরকমে বললাম, ‘আমি কি আপনার শুটিং দেখতে পারি?’ দরদর করে ঘামছি আমি। রীতিমতো কথা আটকে গেছে। তোতলাচ্ছি। শরীরের স্নায়ুতে কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। এমন অবস্থাতেই মানুষ মনে হয় হিসি করে ফেলে।
মৃদু হাসলেন তপন সিংহ। বললেন, ‘আপনি কি প্রোডাকশনের…’
‘না… না… আমি রিপোর্টার। সান্ধ্য আজকালে ফ্রিলান্স করি।’
‘প্রেস আজ…ডাকিনি তো…’
‘জানি… শুধু আপনার শুটিং দেখব একটু। প্লিজ।’ হাতজোড় করে বললাম।
‘শুটিং-এ তো দেখার কিছু নেই। আর এটা তো একান্ত ঘরোয়া ব্যাপার। বাইরের কেউ…’ পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল বার করে মুখের ঘাম মুছলেন তপন সিংহ।
উনি পুনরায় কিছু বলার আগে হাতজোড় করে কাতর কণ্ঠে বললাম, ‘আমি জানি আমি আউটসাইডার। তবুও… প্লিজ অনুমতি দিন। আমি কোনও ডিস্টার্ব করব না, কথা দিচ্ছি। আপনার শুটিং কভার করার যোগ্যতা আমার নেই। দেখে ধন্য হতে চাই। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত করব না।’
উনি হেসে ফেললেন। কী মিষ্টি অমায়িক হাসি!
একজন অ্যাসিস্টেন্ট এগিয়ে বললেন, ‘কেন কথা বাড়াচ্ছেন… প্লিজ ফ্লোরের বাইরে যান…’
আমি অ্যাসিস্টেন্টকে পাত্তা না দিয়ে তপন সিংহর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ওই কোণে গিয়ে বসে থাকব। দূর একটু দেখব, ব্যস।’
সেই সহকারী আবার কী বলতে যাচ্ছিলেন। তপন সিংহ তাঁকে থামিয়ে বললেন, ‘এই গরমে… আপনি তো এখনই ঘেমে স্নান করে গেছেন। শুটিং চলাকালীন পাখা অফ থাকবে…
‘ওটা কোন ব্যাপার না, কথা দিচ্ছি নড়ব না, চড়ব না। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসও ফেলব না…’
উত্তমকুমারের ভুবনমোহিনী হাসিতে আজও আট থেকে আশির বাঙালি মোহিত। তপন সিংহ’র হাসি মুখের আবেদন ও ঐশ্বর্য্যও কম ছিল না। মিষ্টি হেসে বললেন, ‘না… না… দমটম বন্ধ করে কেলেঙ্কারি বাঁধাতে হবে না। দেখবেন যেন আর্টিস্টের ডিস্টার্ব না হয়। আপনি উল্টোদিক থেকে নড়াচড়া করলে ওদের অভিনয়ের অসুবিধা হতে পারে।’
‘আমি ওইখানটায় গিয়ে বসে থাকব।’ আঙুল দিয়ে ফ্লোরে উল্টো দিকে পড়ে থাকা একটা পরিত্যক্ত বাক্স দেখিয়ে বললাম।
‘আচ্ছা… আপনি বসুন। তবে আর্টিস্টের অসুবিধা হলে চলে যেতে হবে কিন্তু…’ বলে উনি ক্যামেরার দিকে হাঁটা লাগালেন।
বেড়ালের মতো সন্তর্পণে, আর সাপের মতো নিঃসাড়ে বাক্সটা আর দেওয়ালের মাঝে যেটুকু ফাঁক ছিল নিজেকে সেখানে গুঁজে দিলাম। জায়গাটা ফার্নেস বললে কম বলা হয়।
ততক্ষণে লাইট রেডি। মানে শটও রেডি। এখনকার মতো ক্যামেরা তো নয়ই, সেটা অন হলেই রিল ঘোরার কড়কড় করে হালকা শব্দ হতো। সবদিক দেখে নিয়ে ক্যামেরার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন তপন সিংহ। লুক থ্রু করে সৌমেন্দু রায়ই অর্ডার দিলেন, ‘ফ্যানস অফ।’ গোটা ফ্লোরের চারটে পেডিস্ট্রাল ফ্যান বন্ধ হয়ে যেতেই ঝপ করে এক জমাট নিস্তব্ধতা নেমে এলো ফ্লোর জুড়ে। তপন সিংহ মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, নন্দিতা, মিলিন্দ রেডি তো? দু’জনেই আড়াল থেকে বললেন, ‘রেডি’। নন্দিতা অবশ্য ক্যামেরার বাঁ পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। লেফট ফ্রেম ইন করবেন। তপন সিংহ বললেন, ‘সৌমেন্দুবাবু ক্যামেরা’ মৃদু কড়কড় শব্দ করে ক্যামেরা চলতে শুরু করল।
‘অ্যাকশন’ বলে খুব নম্র কণ্ঠে অর্ডার করলেন তপন সিংহ। প্রথমে নন্দিতার এন্ট্রি। কৌতুহলী হয়ে এগিয়ে যাওয়া। দু’ধাপ সিঁড়ি নেমে দরজার কাছে আসা, মাথার ঘোমটা ঠিক করে নিয়ে দরজা খোলা, চমক, অবাক, কয়েক মুহূর্ত স্থির, মিলিন্দ গুনাজির সংলাপ, বিহ্বল নন্দিতার লজ্জিতভাবে আগন্তুককে বাড়ির ভেতরে আসতে বলা, আগন্তুক চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলে তার হাত থেকে ভিজে ছাতাটি নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখা…
লম্বা শট। প্রচুর বিজনেস। তিনবারের চেষ্টায় শট ওকে হল। এবার, প্রতিটি বিজনেসের ক্লোজ শট। আর এস পি শট। কোনও হাঁকডাক নেই। সাধারণত আলোর স্ট্যান্ড সরাতে গিয়ে, কানেকশন দিতে গিয়ে, সেট প্রপস রিপ্লেস করতে গিয়ে টেকনিশিয়ানরা স্পটটিকে মোটামুটি যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে তোলেন। এক্ষেত্রে কোন মন্ত্র বলে সবাই সাইলেন্ট। সবকিছু ছন্দোবদ্ধ দ্রুততায় ঘটে চলেছে নিঃশব্দে। আর এতবার, এতরকম শট নেওয়া চলছে, তপন সিংহ ঠায় দাঁড়িয়ে।
প্রতিটি দৃশ্য প্রথমে তাঁর দুই অভিনেতাকে অভিনয় করে দেখিয়ে দিচ্ছেন। তারপর রিহার্সাল। একবার মনিটার। শেষে টেক। হাঁ করে গিলছি সমস্তটা। খেয়াল নেই কতক্ষণ শুটিং দেখছি। ক’টা বাজে। মানুষটাকে হাঁ করে দেখছি আর ভাবছি, ‘ঝিন্দের বন্দি’র শুটিং-এ উত্তম-সৌমিত্রর একসঙ্গে শট নেবার সময়ও কি এমন কুল ও কোয়াইট রাখতেন নিজেকে?
অবশেষে, পরিচালক বললেন, ‘কাট… অ্যান্ড কমপ্লিট… থ্যাংকস অল অফ ইউ… প্যাকআপ’। সকলে হাততালি দিয়ে উঠল। ‘শতাব্দীর কন্যা’ শুটিং পর্ব শেষ হল। নন্দিতা দাস আর মিলিন্দ গুনাজি দুজনেই এগিয়ে এসে তপন সিংহকে প্রণাম করতে গেলেন। নিলেন না। হ্যান্ডসেক করলেন। নন্দিতার মাথায় হাত রাখলেন। সৌমেন্দু রায় হ্যান্ডসেক করে জড়িয়ে ধরলেন। ঘড়ঘড় করে বড় লোহার গেটটা খুলে দিল কেউ। তপন সিংহ, সৌমেন্দু রায়, নন্দিতা দাস, মিলিন্দ গুনাজি আর তপন সিংহর আজন্মের প্রোডাকশন ফটোগ্রাফার সুকুমার রায় একসঙ্গে গল্প করতে করতে ফ্লোর থেকে বেরোচ্ছিলেন। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন তপন সিংহ।
অতক্ষণ খাঁজের মধ্যে পা মুড়ে বসে থেকে জয়েন্টে খিল ধরে গেছিল। বাক্সটায় ভর দিয়ে উঠতে যাব, সেটা গেলে ভেঙে। হুড়মুড়িয়ে আবার খাঁজেই ঢুকে গেলাম।
আবার উঠতে যাব, মুখ তুলে দেখি তপন সিংহ এগিয়ে আসছেন। কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। বিহ্বল আমি কী করব বুঝতে পারছি না। কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো বললাম, ‘না… না… ঠিক আছে…’
‘ঠিক যে নেই দেখতেই পাচ্ছি। উঠুন দেখি।‘
আরও খানিকটা এগিয়ে এসে নিচু হয়ে আমার ডান বাহুটা ধরলেন। ‘উঠুন। এইভাবে কেউ এতক্ষণ এখানে বসে থাকে!’
উনি বাহুটা ছুঁতেই সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। তপন সিংহর পেছন পেছন নন্দিতা আর মিলিন্দও হাজির।
‘ছোড়িয়ে স্যার ম্যায় দেখতা হুঁ…’ বলে সুপুরুষ মিলিন্দ এগিয়ে এসে বাঁ হাতটা ধরে মৃদু টান দিতেই উঠে দাঁড়ালাম।
ঘামে জামা চুপচুপে। নন্দিতা বলল, ‘কী অবস্থা আপনার! ঘেমে যে একেবারে স্নান করে গেছেন। শুটিং দেখার কী শখ! পাখার সামনের আসুন শিগগিরি।’
‘শখ নয়, শিক্ষা। অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল তপন সিংহ’র ছবির শুটিং দেখব। তাই এই কৃচ্ছ্রসাধন।’ উঠে দাঁড়িয়ে জামা-প্যান্ট-ব্যাগ সামলাতে সামলাতে বললাম।
‘এইসব জায়গায় সাপ খোপ থাকাও আশ্চর্যের কিছু নয়। ইঁদুরও তো কামড়ে দিতে পারতো… এই, প্রোডাকশনের কেউ আছেন, আগে একটু জল দাও, পাখাটা এদিকে ঘুরিয়ে দাও তো… একটা চেয়ার… তপন সিংহর নির্দেশে ছুটোছুটি পড়ে গেল। একজন জল। একজন চা… কে কী করবে বুঝতে পারছে না।
আমার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। তপন সিংহ আমাকে নিয়ে রীতিমতো ব্যস্ত। এর চেয়ে অস্বস্তিকর আর কী হতে পারে। নন্দিতা টেনে এনে পাখার সামনে চেয়ার দিয়ে আমাকে বসিয়ে দিল। ‘বসুন এখানে কিছুক্ষণ। ঘামটা আগে শুকোন…’
‘সর্দিগরমি লেগে জ্বর এসে যেতে পারে’ নন্দিতার কথার সঙ্গে তপন সিংহ মৃদু শাসন জুড়ে দিলেন।
চমকের তখনও বাকি।
একজন চা এগিয়ে দিল। তপন সিংহ কবজি উল্টে ঘড়ি দেখে, চোখ থেকে চশমা নামিয়ে সাদা জামার কোণ দিয়ে কাচ মুছতে মুছতে বললেন, ‘পৌনে তিনটে বাজে। এখন আর চা খেতে হবে না। আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করবেন চলুন।’
আমি কারেন্ট খাওয়ার মতো ছিটকে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘না…না… আমি…’
‘কোথায় নেমন্তন্ন আছে আপনার… আজ আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করবেন চলুন। আর ওই খাঁজে বসে কী দেখলেন বুঝলেন সেটাও শুনব। আমি কে জানেন তো…’ কলকল করে উঠল নন্দিতা।
তপন সিংহ বলে উঠলেন, ‘ওহো সরি… আপনার সঙ্গে তো আমার আর্টিস্টদের আলাপই তো করিয়ে দেওয়া হয়নি। চলুন… আমাদের সঙ্গে… উনি নন্দিতা দাস। দিল্লিতে থাকেন। হিন্দি ছবিতেই কাজ করেছেন মূলত। আমার ছবিতেই প্রথম বাংলায় অভিনয় করল।‘
‘ম্যায় মিলিন্দ গুনাজি।‘
‘ওর অনেক গুণ। লেখে, আঁকে, অভিনয় করে…’ ফ্লোর থেকে বেরোতে বেরোতে বললেন তপন সিংহ।
‘থোড়া কোশিশ করতা হুঁ’ মিলিন্দের বিনয় বচন।
‘নন্দিতাও অনেক কিছুতে জড়িয়ে আছে। উনি কিন্তু এক্টিভিস্ট।’ হাঁটতে হাঁটতে বললেন তপন সিংহ।
আমাদের গন্তব্য সুকুমারদার অফিস ঘর। এনটিওয়ান- এ ঢুকে সোজা বাগান পেরিয়ে বাঁ দিকে যে নতুন ফ্লোর হয়েছে, সেখানে আগে সুকুমারদার ডেরা ছিল। এনটিওয়ানে তপন সিংহ এলে ওখানেই বসতেন। বড় টেবিলের একদিকে দেখি সুকুমারদা ও সৌমেন্দু রায় বসে গল্প করছেন। তপন সিংহ ঢুকতেই ওঁরা উঠে দাঁড়ালেন।
‘আজ আমাদের মধ্যে একজন অতিথি আছেন। উনি সাংবাদিক। আজকাল পত্রিকার। শুটিং দেখতে এসেছিলেন। আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ করব।’ বসতে বসতে বললেন তপন সিংহ।
এই ঘোষণার মধ্যে ছোট্ট একটু রাজনীতিও ছিল। স্টুডিওতে একটা অলিখিত নিয়ম আছে। বলা যেতে পারে কদর্য শ্রেণি বিভাজন। পরিচালকের সঙ্গে তাঁর কোর টিম ও প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রী ছাড়া সচরাচর অন্য কেউ এক পঙক্তিতে বসে লাঞ্চ করতে পারেন না। অনেকের মধ্যে এই ক্লাসিফিকেশনটা অত্যন্ত প্রবল। আমার ধারণা তপন সিংহ সৌমেন্দু রায়কে উদ্দেশ্য করেই ঘোষণাটা করেছিলেন। কারণ উনি সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাটোগ্রাফার। সিনেমা জগতে এলিট ক্লাসে বিলং করেন। উনি আমার মতো সাধারণ সাংবাদিকের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ না-ই করতে পারেন। এটা আমার ব্যক্তিগত ধারণা। ভুলও হতে পারে। তবে এই জঘন্য শ্রেণি বিভাজনটা আজও আছে। আউটডোরে শুটিং কভার করতে গিয়েও দেখেছি।
মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে সৌমেন্দু রায় বললেন, ‘ওয়েলকাম। বি আওয়ার গেস্ট।’
তপন সিংহ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী খাবেন? মাছ না মটন?’
উত্তর দেবো কী! কান ফান লাল হয়ে যাচ্ছে। তপন সিংহ, সৌমেন্দু রায়, সুকুমার রায়ের সঙ্গে লাঞ্চ! গলা দিয়ে ভাত নামলে হয়!
নন্দিতা বলল, ‘আমি মটন, মাছ দুটোই খাব। তুমিও খাও। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব খিদে পেয়েছে। লজ্জা করতে হবে না।’
নন্দিতাকে দেখি আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে।
মিলিন্দ ‘মছলি, রাইস আর টক দই’।
তপন সিংহ বললেন, ‘আমার ভাই মাছের ঝোল ভাত।’
আমার সাংবাদিক জীবনের অন্যতম সম্মানের মধ্যাহ্নভোজ। এত বড় মাপের পরিচালক, অথচ কোনও পাষাণ কঠিন পারসোনালিটি দেখিয়ে বেড়ান না। কী অদ্ভুত নম্রস্বরে সমস্তটা সামলে নিচ্ছেন। মানুষটার মধ্যে এত স্নেহ, আমি মুগ্ধ। কে আমি? এক অর্বাচীন ফ্রিলান্সার। এত গুরুত্ব দেওয়ার কোনও কারণ ছিল না।
খেতে খেতে বললেন, ‘আমার ছবি দেখার বহু আগ্রহী দর্শক আছে। বহু সাংবাদিকের সঙ্গে আমার সখ্যতার সম্পর্ক বহুদিনের। তাঁরা কেউই আমার শুটিং দেখার জন্য এই রকম আগ্রহ দেখাননি। আপনি নতুন প্রজন্মের সাংবাদিক। আমার মতো প্রাচীন পরিচালকের কাজ নিয়ে কৌতুহল আর কাকুতিমিনতি দেখে অবাক হয়েছিলাম। একজন পরিচালককে তাঁর সিনেমা দেখে সবটা বোঝা যায় না, যতটা বোঝা যায় শুটিং ফ্লোরে তাঁর অ্যাক্টিভিটি দেখে। যদিও ওই সিক্রেটটা আমরা পরিচলকেরা গোপনই রাখতে চাই। তবুও আপনার পলিসিটাই ঠিক। এভাবেই আদাঢ় বাদাঢ় পেরিয়ে পৌঁছে যাবেন পরিচালকের সীমানায়।‘
কী অদ্ভুত অবজারভেশন! ওইটুকু সময়ের মধ্যে জাজ করে নিয়েছিলেন আমার ইনটেনশন। তপন সিংহর কথাগুলো আমার সাংবাদিক জীবনের সম্পদ। টেপ ছিল না। হৃদয়ের ফিতেতে গাঁথা হয়ে রয়েছে।
নন্দিতা দাসের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা তপন সিংহর সৌজন্যেই। তপন সিংহর সেদিন কম কথায় আমাকে যেভাবে বিশ্লেষণ করে ছিলেন, সেটা নন্দিতাও মনে রেখেছে আজও। মুম্বই, দিল্লি, কলকাতা যেখানেই নন্দিতার সঙ্গে দেখা হয়, ছুটে এসে কথা বলে। বাকিদের সঙ্গে পরিচয় করায়।
এরপর তপন সিংহ দূরদর্শনের জন্য তৈরি করেছিলেন ‘হুতোমের নকশা’। ১৩ পর্বের ধারাবাহিক। প্রেস কনফারেন্স ছিল সম্ভবত রুবির কাছে মালা সিনহার বাড়িতে।
গিয়েছিলাম। দেখে খুব অসুস্থ মনে হয়েছিল। কাছে ডাকলেন। অন্য সিনিয়ররা তো অবাক। বললেন, ‘একসঙ্গে চা খাব। হুট করে চলে যাবেন না যেন।’
বললাম, এখনও আমাকে আপনি বলবেন?
সেই মৃদু হাসি, ‘এটা আমার অভ্যাস।’
মানুষটাকে বোঝার সময়ই পেলাম না। তখন আমি মিঠুন চক্রবর্তীর সিগনাসে কালচারাল কো-অডিনেটর। তপন সিংহকে বলেছিলাম, ইন্টারভিউ করব। মৃদু হেসে বলেছিলেন, বেশ। সেই ইন্টারভিউ আর নেওয়া হয়নি। প্রশ্ন সাজিয়ে রেখেছিলাম। উত্তর আজও খুঁজে চলেছি।
তপন সিংহর যথার্থ মূল্যায়ন এখনও কেন শুরু করল না বাংলার সিনে সমাজ তা আমার জানা নেই।
জন্মশতবর্ষে মহান ও মহৎ অথচ মৃদুভাষী পরিচালক, লেখক, সুরকার এবং শব্দ বিজ্ঞানী তপন সিংহর প্রতি এক অকিঞ্চিৎকরের তর্পণে যদি কোনও ধৃষ্টতা দেখিয়ে থাকি, পাঠক মাপ করবেন।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন