binodan-smritir-studiopara-part-3

স্মৃতির ষ্টুডিওপাড়া – পর্ব ৩
ষ্টুডিওপাড়া
প্রিয়ব্রত দত্ত

গ্রেফতার হলেন দেবাংশু সেনগুপ্ত

আগেই বলেছি, যিশু সেনগুপ্তর সঙ্গে আমার সম্পর্কের শুরুয়াত সাংবাদিক-শিল্পীর গতানুগতিক রসায়নে নয়, ক্রিকেটের সূত্রে। ক্রিকেট ছিল যিশুর প্রথম প্রেম। এবং এখনও। হাজার ব্যস্ততা সত্ত্বেও ভারতের খেলা থাকলে হয় ও সঙ্গীসাথীদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলবে, না হয় যে কোনও ডিভাইসে ম্যাচ দেখতে বসে যাবে।

১৯৯৯-২০০০ সালে ভারতীয় ক্রিকেট দল অস্ট্রেলিয়ায় তিনটি টেস্ট ও পাঁচটি একদিনের ম্যাচ খেলতে গেছিল শচীন তেণ্ডুলকরের নেতৃত্বে। সহ অধিনায়ক ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। সেই সিরিজে তিনটি টেস্টেই ভারতের শোচনীয় পরাজয় ঘটে।

ভারতীয় ক্রিকেট দলের এই ন্যক্কারজনক পারফরমেন্সে স্বাভাবিকভাবেই যিশুর মন খারাপ। এতটাই মনমরা হয়ে গেছে যে তার ছাপ পড়ছে অভিনয়ে। জীবনে প্রথমবার ক্যামেরার সামনে অভিনয় করলেও সাধারণত যিশু একবারেই শট ওকে করে দিত। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট টিমের বিপর্যয় ওকে একেবারে বিদ্ধস্ত করে দিয়েছে। শট দিতে গিয়ে মাঝে মধ্যেই সংলাপ ভুলে যাচ্ছে। অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। দেবাংশুদা যেখান দিয়ে ওকে আসতে যেতে বলেছে, তার বিপরীত দিক দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। একেবারে বিরহী যক্ষের মতো অবস্থা। একটাই সুখের কথা, ওর প্রিয় খেলোয়াড় শচীন অত দুঃসময়েও ‘ফাটিয়ে খেলে চলেছে’। ওইটুকুই অক্সিজেন। অস্ট্রেলিয়ার ফাস্ট বোলার গ্লেন ম্যাকগ্রা আর স্পিনার শেন ওয়ার্ন-এর সঙ্গে শচীনের শেয়ানে শেয়ানে লড়াই যেন যিশুকে প্রাণবায়ু বিতরণ করে চলেছে।

রোজকার মতো সেদিনও গেছি এনটিওয়ান-এ ঢুঁ মারতে। দূর থেকে দেখি গৌরাঙ্গর কস্টিউমে আম গাছটার তলায় একা দাঁড়িয়ে আছে যিশু। পাশে মাঠের দিকে উদাসভাবে তাকিয়ে সিগারেট টানছে। ভাবলাম মনে মনে পাঠ মুখস্ত করছে হয়তো। বা আসন্ন সিনটা নিয়ে ভাবছে। এখন বিরক্ত করা ঠিক হবে না।

আমাকে দেখে হুঁস ফিরল যিশুর। একটা ভিন্ন ভুবনে যেন এতক্ষণ বিচরণ করছিল ও। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেটার টুকরোটাকে বিরক্তির সঙ্গে দু’আঙুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলে বলল, “সকালে শচীনের আউটটা দেখলে। ওটা আউট! বলটা পরিষ্কার ব্যাটে লেগেছিল। রিপ্লে তো তাই বলছে। ছি… ছি… ছি… এ টেস্টটাতেও ভারত নির্ঘাত হারবে। এরা সব আম্পায়ার না ভ্যাম্পায়ার? শচীনকে যেমন করে হোক প্যাভেলিয়ানে ফেরাতে পারলেই কেল্লা ফতে। ডাউটফুল কিছু হলেই আঙুল তুলে দাও!” হতাশায় ঘন ঘন মাথা নাড়তে লাগল ও। যেন নিজেই এই মাত্র আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হয়ে প্যাভেলিয়ানে ফিরে এসেছে। হঠাৎ এদিক সেদিক তাকিয়ে দু-তিন পা দূরে একটা শুকনো ভাঙা গাছের ডাল তুলে নিয়ে সেটাকে ব্যাটের মতো করে ধরে স্ট্যান্স নিয়ে দাঁড়াল যিশু। এটা বোঝাতে যে, ফ্রন্ট ফুটে শচীন যতটা পা বাড়িয়ে ছিল, তাতে ও কিছুতেই এলবিডাবলু হয় না। বল অফস্টাম্পের বাইরে পড়ে ভেতরে কাট করে উইকেটের মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল। প্যাডের ফ্ল্যাপে ‘ফেদার টাচ’ করে বলটা উইকেট কিপারের হাতে চলে গেছে। “আমার তো মনে হয় আম্পায়ার নিজেই জানেন না তিনি শচীনকে কী আউট দিয়েছেন, কট বিহাইণ্ড না এলবিডাবলু” বলে সেই ব্যাটিং অ্যাকশানটা পা বাড়িয়ে আমাকে আত্মমগ্ন হয়ে বোঝাতে শুরু করল যিশু। বুঝুন একবার। চোখ বুঝে ছবিটা মনে করা চেষ্টা করুন, পঞ্চদশ শতাব্দীর এক ঐতিহাসিক চরিত্রের অভিনেতা ধুতি-উত্তরীয় পরে, কপাল সহ শ্রীঅঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় চন্দনের তিলক কেটে, খড়ম পায়ে, শ্যুটিং ভুলে, বিংশ শতাব্দীর এক ক্রিকেটারের ভূমিকায়!

আমিও সমানভাবে মজে গেছি যিশুর সঙ্গে। কারণ, শচীনের আউটটা আমিও মেনে নিতে পারিনি। দু’জনেই উত্তেজিত। চলছে ভারতীয় ব্যাটিং বিপর্যয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। যিশু মাঝেমধ্যেই এক একজন ব্যাটসম্যানের ভুলত্রুটিগুলো ওই শুকনো ডাল দিয়ে ডেমনস্ট্রেশন করছে। ও দাঁড়িয়ে আছে ফ্লোরের দিকে পিঠ রেখে। আমি ওর সামনে, মানে ফ্লোরের দরজার দিকে মুখ করে হাত পা ছুঁড়ছি। আমার হাতে একটা ইটের টুকরো। যেটা আমি যিশুর দিকে হাত ঘুরিয়ে ছুঁড়বো। যিশু ‘বল’টা ফ্রন্ট ফুটে খেলে দেখাবে শচীন ঠিক আর কতখানি পা বাড়ালে সেটা ব্যাটে পেত। কোনও কনফিউশন থাকত না। ইটটা নিয়ে হাত ঘোরাতে গিয়ে দেখি ফ্লোরের ভেতর থেকে দেবাংশুদা বেরিয়ে আসছে। তোয়ালে দিয়ে ঘন ঘন মুখের ঘাম মুছতে মুছতে। আমাকে দেখেই এক হাত দিয়ে যা করছি তাই করে যেতে বলল। বলে নিজে নিঃশব্দে যিশুর পেছনে এসে হাঁটু ভাঁজ করে, কোমর নামিয়ে একেবারে নিখুঁতভাবে উইকেট কিপারের ভঙ্গিতে পোজ নিল। আমাকে চোখের ইশারায় ‘বল’ করতে বলল। করলাম। ডাল-এ বল-এ হল না। ফসকাল। ইটের টুকরোটাকে নিপুন দক্ষতায় তালু বন্দি করে ‘হাওজ্যাট’ বলে বিকট চিৎকার করে উঠল দেবাংশুদা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় যিশু গাছের ভাঙা ডাল হাতে চমকে ঘুরে দেখে শুধু দেবাংশুদা নয়, ইউনিটের বাকি সদস্যরাও বেজায় হাসছে আর হাততালি দিয়ে বলছে, “মহাপ্রভু আউট”।

“আচ্ছা… এর কোনও মানে আছে! আমি মানে… প্রিয়কে বোঝাচ্ছিলাম শচীনের আউটটা… সরি চল…” যিশুর প্রায় কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। ইটের টুকরোটা আমার দিকে আলতো করে ছুঁড়ে দিয়ে এগিয়ে এসে যিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরল দেবাংশুদা। আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে বলল, “ভাবছি সিরিয়ালটার নাম পাল্টে রাখব ময়দানে মহাপ্রভু।” “সরি দেবাদা… আর হবে না… এই আমি কান মুলছি…” যিশু নিজেকে আলিঙ্গন মুক্ত করে নিজের দু’কান ধরতে যাবে দেবাদা ওর হাত থেকে ডালটা ছিনিয়ে নিয়ে উঁচিয়ে বলল, “প্রিয়, কাল তোর হেড লাইন, বেধড়ক মার খেলেন মহাপ্রভু… এখনও তিনটে সিন বাকি… চল…” বলে এক হাতে ভাঙা ডাল আর অন্য হাতে যিশুকে টানতে টানতে ফ্লোরের দিকে এগোল পরিচালক। যিশুকে অসম্ভব ভালোবাসত দেবাংশুদা। তাতে যদি ভাবেন এহেন লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে নিজেকে সংযত করে নিয়েছিল যিশু, তাহলে ভুল করবেন। মহাজ্ঞানী মহাপ্রভুর ক্রিকেট প্রীতি তাতে এতটুকু টোল খায়নি। আজও না।

বেশ কাটছিল দিনগুলো। কিন্তু তার কয়েকমাস পর ওই মহপ্রভু সিরিয়ালকে ঘিরে এক বিরাট ডামাডোল ঘটে যাবে কে জানত?

সদ্য স্টুডিও পাড়ায় আনাগোনা শুরু করেছি। সাংবাদিক হিসেবে আমার প্রাথমিক কাজ সিরিয়াল বা সিনেমার খবর সংগ্রহ করা। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক পাতানো। বরেণ্য পরিচালকদের সান্নিধ্যে আসা। সেই সঙ্গে উঠতিদের সঙ্গেও মেলামেশা করা। এর বাইরে কোথায় কী হচ্ছে, কী ঘটছে সে নিয়ে আমার মাথা না ঘামালেও চলবে। বিভাগীয় সম্পাদকের (কমলদা) হুঁশিয়ারী, হ্যাংলামো আর আদেখলামো করলে ঘাড় ধরে নয় ছয় এর বাইরে বার করে দেওয়া হবে (আজকাল পত্রিকার তৎকালীন ঠিকানা ছিল ৯৬, রাজা রামমোহন সরণি। সেটাকে আজকাল-এর আগাপাশতলা নয় ছয় বলে সম্মোধন করত)। সুতরাং বেশি মাখামাখি না করাই ভালো।

বুঝিনি শ্যুটিং স্পটের বাইরে আনাচে কানাচে, আড়ালে আবডালে কী ঘটে চলেছে, দিনের শেষে বিভিন্ন ফিল্ম পার্টির রঙিন আলো আঁধারিতে কোন সম্পর্কের গসাগু ধূমায়িত হচ্ছে আর কোন সম্পর্কের লসাগু বুদবুদের মতো মিলিয়ে যাচ্ছে— তার মুখরোচক গল্পটাই আসলে ‘খবর’। পাঠক সেটাই পড়তে চায়, গিলতে চায় গোগ্রাসে। তখন নিউজ চ্যানেল কোথায়? ‘আজকাল’, ‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘স্টেটসম্যান’, ‘টেলিগ্রাফ’-এর মতো প্রথমসারির দৈনিক মাত্রেই সব রাজনীতি নির্ভর। বিনোদন পত্রিকা ‘প্রসাদ’, ‘উল্টোরথ’-এর দিন গেছে। টিমটিম করে টিকে আছে সিনে অ্যাডভান্স। বাজারে তখন বড় ও চালু সিনেমার ম্যাগাজিন বলতে একমাত্র ‘আনন্দলোক’। আজকালেরও একটা বিনোদন ম্যাগাজিন ছিল, ‘টেলিভিশন’। আমি যখন সান্ধ্য আজকালে কাজ শুরু করি (১৯৯৬) তখন সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। ‘টেলিভিশন’ শুধুমাত্র টিভির দুনিয়ারই খবর করত। তাও কঠোরভাবে শুদ্ধতা বজায় রেখে। সেই শুদ্ধতায় কালি লেগেছিল বলেই নাকি ‘টেলিভিশন’ পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আবার অনেকে বলেন, দুই সম্পাদকের ইগোর লড়াই-এর জন্যই নাকি বন্ধ হয়ে যায় টেলিভিশন পত্রিকা। তাই তখন একমাত্র আনন্দলোকই সেই অর্থে ‘বড়দের’ পত্রিকা। বাজারে দাদাগিরি করছে। সিনেমা জগতের ‘খারাপ খারাপ’ খবর ও ছবি ছাপা হয় তাতে। ‘আজকাল’ বাম মনোভাবাপন্ন কাগজ। সেখানে রুপোলি দুনিয়ার নষ্টামি, ন্যাকামি নৈব নৈব চ। কারোর ব্যাক্তিগত ব্যপারে নাক গলানো নিষিদ্ধ।

এদিকে আমিও বেড়ে উঠেছি সাধারণ মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ মাখা মানসিকতায়। আমাদের বাড়িতে একটা বয়স পর্যন্ত সিনেমা দেখাটাই নিষিদ্ধ ছিল। কোনও সিনেমা পত্রিকা বাড়ির চৌকাঠ কেন তার ছায়াও ডিঙোতে পারতো না। অথচ আমার ‘উত্তম ভক্ত’ বাবা সিনেমার পোকা ছিলেন। তাঁর সংগ্রহে প্রচুর সিনেমার বুকলেট ছিল। যেগুলো সিনেমা হলে তখন এক নয়া, দু নয়া পয়সায় বিক্রি হত। আজ বুঝি সেগুলোর আর্কাইভাল ভ্যালু কতখানি ছিল। কিন্তু এখন আফসোস করা ছাড়া উপায় নেই। কারণ, বহুকাল আগে সেগুলি উই-এর গর্ভে বিলীন হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে।


যাই হোক, লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশানের বাইরের খবর নিয়ে তাই আমার কোনও ইন্টারেস্ট ছিল না। ফলে কোন নায়িকা কোন ডিরেক্টার বা প্রোডিউসারের সঙ্গে শ্যুটিং ফেলে কোথায় উধাও হয়ে গেলেন, কোন নায়ক কেন অমুক নায়িকাকে ছবিতে নেওয়ার জন্য গোঁ ধরে বসে আছেন, কোন অভিনেত্রীর ক’টা বিয়ে, ক’জন প্রেমিক, কার সঙ্গে কার লটঘট এসব নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর দরকারও ছিল না। আর তাছাড়া এই ধরণের খবরকে তখনকার কোনও দৈনিক বা সাময়িক পত্রগুলি খুব একটা গুরুত্বও দিত না।

ফলে আমারও মেকআপ রুমে উঁকিঝুঁকি মারার বা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে অযথা মাখামাখি করারও প্রয়োজন পড়ত না। কিন্তু সেলিব্রিটিদের ব্যাক্তিগত পরিসরটাই যে বিনোদন বা এন্টারটেইনমেন্ট বিটের প্রধান লীলাভূমি শিখলাম ঠেকে। বলা যায় জোর ধাক্কা খেয়ে। এও শিখলাম, কুকুরের মতো কান ও শকুনের মতো চোখ না হলে সাংবাদিক হওয়া যায় না। নোংরা ঘাঁটো। পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য এক্সক্লুসিভ।

সিনেমার তথা বিনোদনের দুনিয়ার খবর পড়েন মূলত ঘরের মা-কাকিমা, মামি-মাসিমারা। তাদের আগ্রহ তারকাদের ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে। তারা কী খায়, কী পরে, কীভাবে শোয়, ওঠে, বসে, হাসে, কাঁদে সেই নিয়ে বিশ্বগ্রাসী কৌতূহল ওঁদের। তা না হলে আজও কেন বাঙালি ‘বিস্মিত’ সুচিত্রা উত্তমের মধ্যে সত্যিই বিয়েটা হল না বলে? ‘বিভ্রান্ত’, কেন প্রসেনজিৎ দেবশ্রীর মতো বউয়ের সঙ্গে ঘর করল না! এই কাল পেরোন কৌতূহলগুলো এখন অবশ্য অনেক খোলামেলা হয়েছে। মাঝেমধ্যে যা শালীনতার সীমা অতিক্রম করে যায়। সম্প্রতি নুসরত জাহানের সন্তান হওয়া নিয়ে মিডিয়া যা করল, কুড়ি বছর আগে সেটা ভাবাই যেত না। এহেন সংস্কৃতির আমদানি করে ‘টাইমস অফ ইণ্ডিয়া’ আর ‘হিন্দুস্থান টাইসম’। এই শতাব্দীর গোড়ায়। যার পোশাকি নাম দেওয়া হয় ‘পেজ থ্রি’। রুপোলি জগত নিয়ে এই আবহমানকালীন কৌতূহলের সংক্রামক প্রবৃত্তিটাকেই ক্যাশ করেছে আজকের সিরিয়ালওয়ালারা। কেচ্ছাকে ভালো করে কষিয়ে, তাতে মুখরোচক মশলা মিশিয়ে পরিবেশন করাটাই তো ‘গসিপ’। তাদেরও টার্গেট ওই মাঝবয়সী গৃহস্থ মহিলামহল।

মাসছয়েক যাতায়াতের সুবাদে জেনেছিলাম দেবাংশুদার প্রাক্তন স্ত্রী সেই ‘তেরো পার্বণ’খ্যাত খেয়ালি দস্তিদার। তাঁদের নাকি একটি ছেলেও আছে। নাম আদিত্য। তবে ইদানিং দুজনের সম্পর্ক একদম ভালো নয়। ছাড়াছাড়িও হয়ে গেছে। দেবাংশুদা বিয়ে করেছে মহাপ্রভু ধারাবাহিকেরই অন্যতম নায়িকা ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ রুমনি চ্যাটার্জিকে। তা সে করতেই পারে। তাতে আমার কি! কিন্তু ব্যক্তি আমি আর সাংবাদিক আমির যে আকাশ পাতাল তফাত, আদর্শ আর নীতিবোধের যে সেখানে সাংঘাতিক সংঘাত — সেটা হাড়ে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম কয়েকদিন পর। যা আমার সাংবাদিক জীবনের দৃষ্টিভঙ্গীটাই আমূল বদলে দিল।

সকাল বেলা পাড়ার স্টলে গিয়ে কাগজ হাতে নিতেই কেঁপে গেলাম। প্রথম পাতার খবর, যাদবপুরের ফ্ল্যাটে রহস্যজনকভাবে মৃত্যু মহাপ্রভু ধারাবাহিকের ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ রুমনি চ্যাটার্জির! ঘরের সিলিং ফ্যানে ওড়না জড়িয়ে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন তিনি। একটি সুইসাইড নোটও পাওয়া গেছে। স্বামী দেবাংশু সেনগুপ্ত সে সময় বাড়ি ছিলেন না। বাড়ি ফিরে তিনি রুমনিকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করেন। স্থানীয় নার্সিং হোমে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা অভিনেত্রীকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। দেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। পুলিশের প্রাথমিক অনুমান এটা আত্মহত্যার ঘটনা। তবে ওড়না ও বালিশে নাকি রক্তের দাগ পাওয়া গেছে। ফলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দেবাংশু সেনগুপ্তকে রাতেই থানায় ডেকে পাঠানো হয়। গভীর রাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ কার হয় ‘মহাপ্রভু’র পরিচালককে!

মানে কী!

সান্ধ্য কাগজের কাজ শুরু হয় সকাল থেকে। দুপুর বারোটা, খুব গুরুত্বপূর্ণ খবর থাকলে বড় জোর একটা — তার মধ্যে সব কাজ শেষ করে ফেলতে হবে। চার পাতা। ট্যাবলয়েড সাইজ। আগের দিন দুই নম্বর পাতার অর্ধেক আর তিনের পাতার পুরোটা রেডি করা থাকত। প্রথম পাতা, দ্বিতীয় পাতার অর্ধেক ও খেলার পাতার জন্য (যার বেশিরভাগটাই বিজ্ঞাপনে ভরা) ওই সময়ের মধ্যে খবর সংগ্রহ করে, লিখে, কম্পোজ করে, প্রুফ দেখে, মেকআপ করে মেশিনে পাঠিয়ে দেওয়া হত। দুপুর দেড়টার মধ্যে কাগজ ছেপে নিউজ ডেস্কে বিতরণ করা হয়ে যেত। বাজারে ও স্টেশনে চলে যেত দুটোর মধ্যে।

ফ্রিলান্সিং করলেও আমাকে রোজ সকাল ন’টার মধ্যে হাজিরা দিতে হতো দফতরে। কাগজ বেরিয়ে গেলে কিছু খেয়ে নিয়ে স্টুডিও পাড়ার দিকে রওনা দিতাম। যেদিন অ্যাসাইনমেন্ট থাকত সেদিন অবশ্য আলাদা শিডিউল। ইতিমধ্যে সান্ধ্য আজকাল-এর এডিটোরিয়াল ডেস্কেও বেশ বড়সড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। নতুন ইনচার্জ হয়ে এসেছেন সাম্প্রতিক সময়ের অত্যন্ত আলোচিত ও বিতর্কিত ব্যাক্তিত্ব, তৎকালীন সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম তরুন তুর্কি কুণাল ঘোষ। তাঁর ট্যাবলয়েড সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী একটু আলাদা। তিনি মনে করেন ট্যাবলয়েড মানেই গসিপের গর্ভগৃহ। পৃথিবীর সব ট্যাবলয়েডই তাই। দুনিয়া কাঁপানো ব্রেকিং নিউজগুলো ওই ট্যাবলয়েডগুলোতেই প্রথম ছাপা হয়েছে। ফলে কি রাজনীতি, কি খেলাধুলো, কি বিনোদনের দুনিয়া সর্বত্র মুখরোচক খবরের খোঁজ। তাকে মশলাদার করে পরিবেশন করো। লেখার স্টাইলে, লে আউটের নতুনত্বে এমন চমক থাকবে যাতে পাবলিক মানে পাঠক গপগপ করে গিলবে। কারণ, তাঁর মতে দৈনিক ও সান্ধ্য কাগজের পাঠক যেমন আলাদা, তাঁদের রুচিও ভিন্ন। সান্ধ্য কাগজ মানেই কেচ্ছার কারখানা।

রুমনি চ্যাটার্জির মৃত্যু রহস্য সেদিনের কাগজের হটেস্ট হাঙ্গামা। অজানা এক আশঙ্কা নিয়ে গুটিগুটি পায়ে আজকাল-এর ওই ট্রেনের বগির সাইজের নিউজ রুমে ঢুকলাম। টেবিল আলো করে বসে আছেন কুণালদা। উল্টোদিকে বর্ষিয়ান সাংবাদিক সনৎ রায়, পাশে সৌরভ, সব্যসাচী, কমলদা তখনও আসেননি। আমাকে দেখে কুণালদা বললেন, “এই যে স্টুডিও পাড়ার শাহেনশা, এসবের মানে কি? রুমনির ব্যাপার নিয়ে আপনার কি বক্তব্য?”

আমি চুপ। গলা শুকিয়ে কাঠ।
“আলাপ ছিল রুমনির সঙ্গে।”
আলতো করে ঘাড় নাড়লাম।
“কেমন মেয়ে?”
সেরেছে! বললাম, “কথা হয়েছিল দু একবার। ভলোই তো।”
“ওর সম্পর্কে আর কী জানিস?”
আমি আবার চুপ।
“একজন অভিনেত্রী। একটা হিট সিরিয়ালের ফিমেল প্রোটাগনিস্টের রোল করছিল। যে কিনা ডিরেক্টারের বউ। তার নাড়িনক্ষত্র তো তোর নখদর্পনে থাকার কথা। রুমনির এটা সেকেণ্ড ম্যারেজ তুই জানতিস?”
“না।”
“অপদার্থ।” এই শব্দটা কুণালদার সিগনেটার টিউন। আমি কয়েক কোটিবার শুনেছি।
“দেবাংশু?”
“উনি তো আগে খেয়ালি দস্তিদারকে বিয়ে করেছিলেন।” বুকে বাতাস ভরে বললাম। এতক্ষণে একটা কোশ্চেন কমন পেয়েছি।
“খেয়ালির সঙ্গে কেন ছাড়াছাড়ি হল? এত নায়িকা অভিনেত্রী থাকতে রুমনিকেই বা দেবাংশুর মনে ধরল কেন? রুমনি-দেবাংশুর সম্পর্ক কেমন ছিল? রুমনির মেকআপ রুম কি আলাদা ছিল? দেবাংশু কোথায় লাঞ্চ করত, কার সঙ্গে…”
এসিতেও কুলকুল করে ঘামছি।
“যিশুর সঙ্গে রুমনির সম্পর্ক কেমন? শটের বাইরে যিশুর কার কার সঙ্গে বেশি মাখামাখি?”
“আসলে… মানে…” আমি আমতা আমতা করছি।

“তোর বিটে একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে, আর তুই হেলতে দুলতে অফিসে ঢুকছিস? সান্ধ্যর একেবারে হট কেক। আগামী এক সপ্তাহ আর লিড নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। কি বলো সনৎদা?” সনৎদা মুচকি হেসে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন। কুণালদা আবার শুরু করলেন, “জনপ্রিয়তায় সিরিয়ালটা এক নম্বরে, সেই সিরিয়ালের নায়িকা সুইসাইড করেছে না মার্ডার হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। সেই ইউনিটের কোনও খবর তোর কাছে নেই? অপদার্থ!”

আমি মাথা চুলকোচ্ছি। চেয়ারে বসতে যাব কুণালদার হুঙ্কার, “বসছিস কি! এখনই এনটিওয়ান চলে যা। রুমনির মৃত্যুতে স্টুডিও পাড়ার রিঅ্যাকশান কী, বারোটার মধ্যে তার কিছু এক্সক্লুসিভ পয়েন্ট পাঠা। আমি গাড়ি বলে দিচ্ছি, বেরিয়ে পড়। গিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিবি। সারাদিন থেকে সমস্ত খবর কালেক্ট করে বিকেলে এখানে ফিরে আমায় ব্রিফ করবি, বুঝলি?”


সেই প্রথম কোনও সংবাদপত্রের গাড়িতে চেপে অ্যাসাইনমেন্ট যাচ্ছি। গোটা ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করলাম। অপমানটাও ধীরে ধীরে হজম করতে লাগলাম। স্টুডিও গিয়ে পৌঁছলাম সকাল দশটায়। আমার কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। এনটিওয়ান ঢোকার আগে স্কুলের সামনে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। এত সকালে আমাকে দেখে প্রদীপ্ত অবাক! সটান গিয়ে ঢুকলাম মহাপ্রভুর সেটে। সবাই আমাকে দেখে যেন ভূত দেখার মতো চমকে গেল। ওই এক মুহূর্ত। কিন্তু সবাইকে কেমন যেন অপিরিচিত মনে হতে লাগল। কাজ চলছে বটে, তবে যন্ত্রের মতো। দেবাংশুদার প্রধান সহকারী পার্থর (পদবিটা ভুলে গেছি) দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে পার্থ হাত জোড় করে বলল, “আমি কিছু বলতে পারব না। যা বলার প্রোডাকশানের তরফে বিকেলে বিবৃতি দেওয়া হবে।” সবাই কেমন যেন মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে। যিশুর তখন শট নেই। বেলা করে স্টুডিওয় আসবে। থমথমে পরিবেশ। বাইরে বেরিয়ে এলাম। মাথা ঘুরছে। আচ্ছা গ্যাঁড়াকল তো! খবর দিতে না পারলে যদি ‘নয় ছয়ে’ না ঢুকতে দেয়? গলা শুকিয়ে কাঠ। সিগারেট ধরিয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে জগ খালি করে জল খেলাম। শুনতে পেলাম জানলার দিকে একটা টেবিলে কয়েকজন দেবাংশু-রুমনিকে নিয়ে আলোচনা করছে। কান খাড়া করে পাশের টেবিলে গিয়ে বসলাম। এমন সময় ঘরে এসে ঢুকল মহাপ্রভু সিরিয়ালের ক্যাটারিং-এর দায়িত্বে থাকা একটি ছেলে। সে আমাকে দেখে চিনতে পেরে আমার টেবিলে এসে বসল। ওর জন্য চা বললাম। জিজ্ঞাসা করলাম, “আজকে লাঞ্চে কি মেনু?”

ছেলেটি বলল, “আজ তো লাঞ্চ হবে না। তার আগেই প্যাক আপ হয়ে যাবে।”

ঠিক সেই মুহুর্তে আমার ঠাকুমার কথা মনে পড়ল। পেট থেকে কথা বার করার বীভৎস কায়দা জানতেন তিনি। তাঁকে বলা হতো ‘কুরিং কুইন’। অর্থাৎ কুরুনি দিয়ে যেভাবে নারকেলের পেটের ভেতর থেকে আসল জিনিস বার করে আনা হয় সেই একইভাবে লোকের পেট থেকে গোপন কথা বার করে আনার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর।

“কেন?”
“জান না?”
“জানি। তার জন্য শ্যুটিং বন্ধ?”
“সবাইকে যে লালবাজারে ডেকেছে?”
“তোমাকেও?”
“না আমরা বেঁচে গেছি। কেস খাবে পার্থদা।”
“কেন?”
“ওই তো রুমনির সঙ্গে দেবাংশুদার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল।”
“সেরেছে। আচ্ছা তখন খেয়ালিদি…”
“খেয়ালিদি তো মহাপ্রভুতে আর অভিনয় করে না! তুমি জানো না?”

আর একটা সিগারেট ধরালাম। ওকেও দিলাম। আরও দু’গ্লাস চায়ের অর্ডার দিলাম। কাগজ পেন বার করা যাবে না। মগজে ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিতে থাকলাম ওর কথাগুলো।

ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে এগারোটা বাজে। এনটিওয়ান-এর গেটের উল্টো দিকে একটা চায়ের দোকান আছে। সেখান থেকে পয়সা দিয়ে ফোন করা যেত। ফোনে কুণালদাকে সব বললাম। শুনে কুণালদা বলল, “ফাটিয়ে দিয়েছিস! আজকের সান্ধ্যয় তোর বাইলাইন কেউ আটকাতে পারছে না।”

ফোন ছেড়ে এবার টেকনিশিয়ান, ইন্দ্রপুরিতেও ঢুঁ মারলাম। এতদিন আমার খবরের উৎস ছিল পর্দার সামনের সারির মানুষেরা। আমার চোখ খুলে গেল। বুঝলাম প্রোডাকশানের তৃণমূল স্তরের কর্মীরাই হচ্ছেন আসল সোর্স। ওঁরাই খবরের খনি। পুরো কপির আগাপাশতলা গুছিয়ে পোরা আছে ইলেকট্রিশিয়ান, সেট মেকার, স্পট বয়দের পকেটে। শুধু মনুষ্যত্ব ও সংবেদনশীলতার মূল্য দিয়ে ভিড়ে যাও ওঁদের সঙ্গে। এর বেশি কিছু চান না সামান্য অর্থের বিনিময়ে ওই ভূতের মতো খেটে চলা লোকগুলো।

রুমনি চ্যাটার্জিরও এটা দ্বিতীয় বিয়ে ছিল। প্রথম বিয়ে ১৯৯৩ সালে। পাড়ারই একটি ছেলেকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। প্রাক্তন স্বামীর নাম প্রসেনজিৎ পাল। ওরফে পচা। রুমনির বাপের বাড়ি নারকেলডাঙার কাছে। সেই বিয়ে ভেঙে যায় ২০০০ সালে জানুয়ারি মাসে। মডেলিং-এর কাজ দিয়ে গ্ল্যামারের জগতে পা রাখেন রুমনি। ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয়ের সুবাদে টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ায় আনাগোনা শুরু তাঁর। মহাপ্রভুই ছিল রুমনির বড় ব্রেক।

অন্যদিকে দেবাংশু সেনগুপ্তর সঙ্গে খেয়ালি দস্তিদারের সম্পর্ক সেই ‘তেরো পার্বণ’-এর সময় থেকে। ‘তেরো পার্বণ’ বাংলা ভাষায় সম্প্রচারিত প্রথম সিরিয়াল। খেয়ালি দস্তিদারের বাবা প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব জোছন দস্তিদার। তাঁর নাট্যদল ‘চার্বাক’। পরবর্তীকালে জোছন দস্তিদার বন্ধু শ্যামল সেনগুপ্তর সঙ্গে একটি অডিও ভিসুয়াল প্রোডাকশান হাউস খোলেন। নাম দেন ‘সোনেক্স’। এই ‘সোনেক্স’ই বাংলা টেলিভিশন জগতে বিপ্লব ঘটায়। সোনেক্স প্রযোজিত ও জোছন দস্তিদার পরিচালিত ‘তেরো পার্বণ’ বাংলা ধারাবাহিকের ইনিংসের সূচনা করে। যেটি দূরদর্শনে দেখানো হতো প্রতি সপ্তাহে। এই ধারাবাহিকেই আত্মপ্রকাশ ঘটে সব্যসাচী চক্রবর্তী, ইদ্রাণী হালদারদের। যাঁরা পরবর্তীকালে ছোট ও বড় পর্দার স্টার হয়ে ওঠেন। খেয়ালি দস্তিদার ছিলেন ধারাবাহিকটির নায়িকা। বেনুদা ওরফে সব্যসাচী ছিলেন নায়ক। দেবাংশুদা এই সিরিয়ালে সহকারী পরিচালক ও সম্পাদকের দায়িত্ব সামলাতেন। তিনি খুব ভালো সিনেমাটোগ্রাফারও ছিলেন। ক্যামেরা নিয়ে ছিল তাঁর অগাধ পড়শোনা। সিরিয়ালটির সম্প্রচার শুরু হয় ১৯৮৬ সালের ১ মার্চ। সেই ‘তেরো পার্বণ’-এর জমানা থেকেই দেবাংশু-খেয়ালির সম্পর্ক, প্রেম। দেবাংশু-খেয়ালির বিয়ে হয় ১৯৯১-৯২ সাল নাগাদ।

স্টুডিও পাড়ার দাবি, সেই সম্পর্কের সুর কাটল রুমনির অনুপ্রবেশে। প্রথমে সিরিয়াল। পরে দেবাংশুদার জীবন ছেড়ে চলে গেলেন খেয়ালি দস্তিদার। ২০০০ সালের ১০ মার্চ রুমনিকে বিয়ে করে যাদবপুর এলাকার প্রিন্স গুলাম হোসেন শাহ রোডের একটি ফ্ল্যাটে নতুন করে সংসার পাতে দেবাংশুদা।

দুজনেরই এই দ্বিতীয় দাম্পত্য সুখের হল না। স্টুডিও পাড়া ঘুরে এর পেছনে দুটো কারণ জানতে পারলাম। প্রথমত রুমনি ছিলেন খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে অভ্যস্ত। খেয়ালি দস্তিদারের একেবারে বিপরীত। তার ওপর প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গেও নাকি তাঁর যোগাযোগ ছিল। এটা দেবাংশুদা মেনে নিতে পারেনি। সেই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ লেগে থাকত। তার প্রভাব পড়ত শ্যুটিং-এও। এমনকি সেটেও প্রভাব খাটাতে শুরু করেছিলেন রুমনি। যেটা অন্য অভিনেতারা ভালো চোখে দেখতেন না।

আমি যতটুকু দেবাংশুদাকে চিনেছিলাম, তাতে মনে হত দিনের শেষে মানুষটি খানিকক্ষণ ব্যক্তিগত পরিসরে আবদ্ধ থাকতে পছন্দ করত। অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করত। কিন্তু একটা দোষ ছিল। মদ্যপান করলে ওই দেবাংশুদাই অন্য মানুষ হয়ে যেত। সেইসময় দেবাংশুদাকে ঠিক চিনতে পারতাম না। রুমনির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি শুরু হতে দেবাংশুদা মদ্যপানের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল। পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী রুমনি আত্মহত্যা করেন ১৭ মে, ২০০০, রাত ৮টা থেকে ৮.২০-র মধ্যে। ঘটনার কিছুক্ষণ আগে দেবাংশুদা একটা বারমুডা আর টি শার্ট পরে সিগারেট কিনতে বাড়ি থেকে বেরোয় পৌনে আটটা নাগাদ।

পুলিশি জেরার মুখে পড়ে আর ঘটনার আকস্মিকতায় আঘাতে দেবাংশুদা অসুস্থ হয়ে পড়ে। নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয় ওকে। পরিস্থিতি আরও খারাপ দিকে মোড় নেয়, যখন রুমনির মা সীমা চ্যাটার্জি ও প্রাক্তন স্বামী প্রসেনজিৎ পাল দেবাংশুদার বিরূদ্ধে থানায় রুমনিকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেবার লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া রুমনির একটি ডায়েরিতে দেবাংশুদার ওপর পুলিশের সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। দেখা যায় ডায়েরির পাতায় লেখা রয়েছে, “আমি তোমাকে ভালোবাসি। মা আর পচাদাকে নিয়ে যাই হোক, তুমি মিথ্যে সন্দেহ করো না। একদিন প্রমাণ করে দেব আমি কতটা ভালোবাসি।” বোঝাই যাচ্ছে রুমনি কথাগুলো দেবাংশুদার উদ্দেশ্যেই লিখেছিলেন। মহুয়া রায়চৌধুরীর রহস্যজনকভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর পর বাংলা ফিল্ম ও টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে এত বড় ঘটনা আর ঘটেনি। ফলে যেমন নড়েচড়ে বসেছিল লালবাজার, তেমনই জোর ঝাঁকুনি খেয়েছিল টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিও। তাই ঘটনার গুরুত্ব বিচার করে লালবাজার রুমনি মৃত্যুর তদন্তভার পরবর্তীকালে যাদবপুর থানার হাত থেকে নিয়ে সিআইডির হাতে তুলে দেয়।

তার আগে আবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। ময়নাতদন্তের পর রুমনির মরদেহে মুখাগ্নি করলেন তাঁর প্রাক্তন স্বামী প্রসেনজিৎ ওরফে পচা! শুধু মুখাগ্নি নয় রুমনির শ্রাদ্ধেও সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেল পচাকে। এই ব্যাপারে সেই সময়ে কমলদাকে দেওয়া এক এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে পচা দাবি করেন, রুমনির পরিবারের সদস্যরা দেবাংশু সেনগুপ্তর জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু শ্মশানেও যখন তিনি এলেন না, তখন বাধ্য হয়ে পচাকে মুখাগ্নি করতে বলা হয়। আফটার অল প্রাক্তন স্বামী তো! পচার এই অতিসক্রিয়তা কিন্তু পুলিশের নজর এড়াল না।

প্রাথমিক তদন্ত সেরে পুলিশ রিপোর্ট দিল, আইনগত ও সামাজিক সম্পর্কহীন প্রাক্তন স্বামী প্রসেনজিৎ পাল ও বর্তমান স্বামী দেবাংশু সেনগুপ্তর সঙ্গে একইসঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে পড়েছিলেন রুমনি। মানসিক অবসাদে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন তিনি।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল স্টুডিও পাড়া। আমিও। যাক এ যাত্রায় রেহাই পেল মানুষটা।

কিন্তু না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে রুমনির শেষকৃত্যর দু’দিন পরই ২১ শে মে ২০০০, স্ত্রীকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হল দেবাংশুদাকে!

(চলবে)

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *