binodan-smritir-studiopara-part-4

স্মৃতির স্টুডিওপাড়া – – পর্ব ৪
ফিল্ম রিভিউ
প্রিয়ব্রত দত্ত


রুমনির হাতের লেখা

যে বাইশগজকে বিদায় জানিয়ে আমি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম, সেই সবুজের সংসারই আমার কেরিয়ারে এক নয়া মোড় এনে দিল। কীভাবে তা বলার আগে আমার ক্লাব সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়।

আগেই বলেছি, আমি ক্রিকেট খেলতাম ভবানীপুর ক্লাবে। আজকের ভবানীপুর ক্লাবের সঙ্গে নব্বইয়ের দশকের ভবানীপুর ক্লাবকে মেলানো যাবে না। স্বর্গ আর নরকের মধ্যে যা তফাত, এখনকার ভাবনীপুর ক্লাবের সঙ্গে তখনকার ক্লাবের সেই ফারাকও অনেকটা সেইরকম।

অতীতে এক সময় ফিল্ড স্পোর্টসে শতাব্দী প্রাচীন ভবানীপুর ক্লাব ময়দানের অন্যতম প্রধান শক্তি ছিল। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, অ্যাথলেটিক সবেতেই সেরা ছিল ভবানীপুর। সময়ের সঙ্গে সেই গরিমায় পলেস্তারা পড়তে শুরু করে। ১৯৯১ সালে আমি যখন ভবানীপুর ক্লাবের তাঁবুতে পা রাখি, তখন সেটা ছিল ক্রিকেটে দ্বিতীয় ডিভিশন, ফুটবলে পঞ্চম ডিভিশন ক্লাব। ভবানীপুর ক্লাবের তাঁবুর ঠিক উল্টো দিকে, মাঠের ওপারে স্পোর্টিং ইউনিয়ন ক্লাব। ধারে ও ভারে নামী স্পোর্টিং ইউনিয়ন তখন ক্রিকেট, ফুটবল দুটোতেই ফার্স্ট ডিভিশনে খেলে। শহীদ মিনারের ঠিক তলায় সবুজ গালিচা বিছানো মাঠটার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এই দুটি ক্লাবেরই। যেহেতু স্পোর্টিং ইউনিয়ন ফার্স্ট ডিভিশন ক্লাব, তাই ক্রিকেটের বাইশ গজটাও তৈরি হত উঁচু মানের। মাঠটাও ছিল মখমলের মতো। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডানের পর ময়দানের চতুর্থ ঘেরা মাঠ। মাঠের দু’দিক ঘিরে সরকারি ও বেসরকারি বাস গুমটি। তার ওপর ধর্মতলার হাতার মধ্যে। অসংখ্য মানুষের আনাগোনা। ফলে ম্যাচ থাকলে প্রচুর লোক রেলিং-এর সামনে বসে, দাঁড়িয়ে খেলা দেখত। এত লোকের মাঝে বল বা ব্যাট করার থ্রিলটাই আলাদা ছিল। ক্লাব লন বলতে ছিল ঢুকেই সামনের অংশটুকু। ডান দিকে একটা অজ পাড়া-গাঁয়ের চায়ের দোকানের মতো ক্যান্টিন। সেখানকার বাঁশের মাচায় কয়েকটা গার্ডেন চেয়ার অতি সতর্কতার সঙ্গে তুলে রাখা থাকতো। ক্লাব প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারির ম্যাচ বা কখনও সখনও প্র্যাকটিস দেখতে আসলে সেগুলিতে বসার জন্য। লন জুড়ে সারা বছরই শীতের শৈথিল্য। স্তূপাকার ঝরা পাতা। পরিষ্কার করা লোক নেই। আমরাই ঠেলেঠুলে যাতায়াতের পথ তৈরি করে নিতাম। ক্যান্টিনটা ছিল ক্লাবের গেট দিয়ে ঢুকেই ডান ধারে। বছরের পর বছর উনুনের ধোঁয়ায় কষ্টি পাথরের মতো আগাপাশতলা কালো হয়ে যাওয়া ক্যান্টিনটা ময়দানে পরিচিত ছিল ‘আলোদার ক্যান্টিন’ নামে। ভাতের মাড় দিয়ে তৈরি ঘুঘনি, ডিমের অমলেট বা পোচ, আলুরদম, পাউরুটি, টোস্ট আর ভেজিটেবিল চপ ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যেত না ক্যান্টিনটায়। আলো নামের এক ভদ্রলোক এই ক্যান্টিনটার স্থপতি। তিনি অকাল প্রয়াত। তাঁর একটি ফ্রেমে বাঁধানো ছবি রাস্তার দিকের দরমার গায়ে উঁচুতে বাঁশের খুঁটির গায়ে ঝোলানো থাকতো। আবক্ষ ছবি। চাপ দাড়িওয়ালা সুদর্শন মুখ। ভদ্রলোক সুপুরুষ ছিলেন, ছবি দেখে অনুমান করা যেত। তিনি নাকি কংগ্রেসের একজন বড় মাপের কর্তাব্যাক্তি ছিলেন। আলোদার অবর্তমানে ক্যান্টিনটা চালাতেন ওঁর স্ত্রী। তিনি বিকালের দিকে আসতেন। সকাল থেকে যে দুজন কর্মী ক্যান্টিনটা চালাতেন তাঁদের গায়ের রঙও ছিল ওই ক্যান্টিনের মতো। একমাত্র আলোদার ছবি আর তাঁর মধ্যবয়সিনী বিধবা পত্নী ছিলেন ওই কৃষ্ণ গহ্বরে পরিচ্ছন্নতার দুই ফ্রেম। একটি অচল, অন্যটি সচল।

তখন কাঠ বেকার। ট্রাম ভাড়া পঁচিশ পয়সা। পকেটে যাতায়াতের আট আনা আর আপদকালীন পরিস্থিতির জন্য আট আনা, সাকুল্যে একটাকা। হাড়ভাঙা প্র্যাকিটিশের পর আগুন জ্বলা পেটে এক ফোঁটা জলের সমান। ধর্মতলা থেকে কলেজ স্ট্রিট হেঁটে বাড়ি ফিরলেও প্রায়ই বারো আনা, আট আনা ধার বাকি পড়ে যেত ক্যান্টিনে। বউদি কেন জানি না আমার ওপর কিঞ্চিৎ দয়ালু ছিলেন। অনেক সময় এমনিতেই এক প্লেট ঘুগনি বা একটা ভেজিটেবিল চপ হাতে গুঁজে দিতেন। সাধ্য মতো শোধ করতাম। বেশিরভাগটাই বাকি থেকে যেত।


বউদির একটি কন্যা রত্ন ছিল। সুন্দরী এবং সেক্সি। (তখন অবশ্য এই সেক্সি শব্দটা এত সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি। মনে মনে উচ্চারণ করে বুক নেংড়ানো দীর্ঘশ্বাস ফেলতো হতো। নয়তো বা খুব বিশ্বস্ত বন্ধুর কানের কাছে ফিসফিস, ব্যস ওই পর্যন্ত। যাকে বললাম সে আবার শুনে চার পাশটা ভালো করে দেখে নিত।) তা সেই লাস্যময়ী যখন মাঝে সাঝে ক্লাবের দোর আর আমাদের ঘোর ঠেলে উদয় হত, তখন ব্যাটসম্যানরা (এখন অবশ্য ব্যাটার বলা উচিত) বলের লাইন ঠিকঠাক খুঁজে পেত না। বোলাররাও একটার পর একটা ওয়াইড বল করে যেত। আমিও ব্যতিক্রম ছিলাম না। কী করব বলুন! তখনকার বয়সটার কথা ভাবুন! তার ওপর খেলোয়াড়ি কেতা। বউদির কন্যার কৌলীন্যে সকলের দৌড় ঝাঁপটা একটু বেড়ে যেত। তাঁর পরমা সুন্দরী কিশোরী কন্যাটির চলনে-বলনে, সাজে-পোশাকে, ওঠা-বসায় আলোদার অন্ধকার ক্যান্টিনে তখন হাজার ওয়াটের মার্কারি জ্বলে উঠত। প্র্যাকটিশের মাঝে আচমকা সবার খিদে পেয়ে যেত। সিগারেটের দশ পয়সা যার পকেট থেকে গলত না, সেও সেদিন গোটা দুই টাকার ডিম, ঘুগনি টোস্ট অর্ডার করে বসত। এক ধাক্কায় বেড়ে যেত বউদির নগদে বিক্রিবাটা। কিন্তু কন্যাটি ছিল ওই দামিনীর মতোই। ঝলক দিয়ে আবার কয়েক সপ্তাহ বেপাত্তা। আমার দৌড় ওই খান কয়েক ওয়াইড বল আর লাইন মিস করে ক্লিন ব্লোড হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। আমি কন্যাটির নাম দিয়েছিলাম ‘অপ্সরা’ অর্থাৎ ‘উফ সরা’। কী করে জানি না আমার দেওয়া নামটাই এখনকার ভাষায় ‘ভাইরাল’ হয়ে গেছিল। এমন কী ক্লাব প্রেসিডেন্ট সাহাবাবুও দেখি ম্যাচ হারার পর এক সন্ধেবেলায় অতনুকে কড়কাচ্ছেন, ‘বারো বলে কুড়ি রান! কেন তোকেও কি ওই অপ্সরায় পেয়েছে নাকি?’ আমি সাকুল্যে একটাকা পকেটে নিয়ে প্র্যাকটিশে আসা দলিত শ্রেণিভুক্ত ক্রিকেটার। সাধ ও সাধ্যের বিস্তর ফারাক। ফলে ‘অপ্সরা’কে নিয়ে অন্যদের আদিখ্যেতা দূর থেকেই দেখতাম আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম।

ওই দূরে থাকতে থাকতেই ওই আস্ত ভবানীপুর ক্লাবটা ক্যান্টিন সমেত একসময় আমার জীবন থেকে কেমন করে যেন দূরে সরে গেল। তারপর মোহনলাল, সিটি ক্লাবে দু-এক সিজিন। মাঝে বেঙ্গল আণ্ডার ফিফটিন, সেভেন্টিন স্কোয়াড। ডিস্ট্রিক্ট, কলেজ, ইউনিভার্সিটি সঙ্গে রাজ্যজুড়ে বিভিন্ন প্রকারের প্রচুর খেপ ইত্যাদি-প্রভৃতি খেলে কিসুই হবার নয় দেখে রণে ভঙ্গ দিলাম। তার ওপর হাতের চোট আমার ক্রিকেট কেরিয়ারে ইতি টেনে দিল। যে চোটের বোঝা আজও বহন করে চলেছি। ক্রিকেটটাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতাম বলে তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আর ব্যাট-বলে হাত দিইনি। ময়দানের পাশ দিয়ে শ্যুটিং কভার করতে যাওয়ার সময় এখনও কেন যেন মনটা হুহু করে ওঠে।

সেদিনও ইণ্ডিয়া-অস্ট্রেলিয়ার একটা ক্রিকেট ম্যাচ ছিল। ওয়ান ডে। নয়-ছয় রাজা রামমোহন সরণির ‘আজকাল’ দফতরের ট্রেনের বগির মতো রিপোর্টিং রুমে বসে টেবিলের শেষ প্রান্তে রাখা পোর্টেবল টিভিতে জমিয়ে খেলা দেখছি। হাতে তেমন কপি নেই। এমন সময় শিস দিতে দিতে কুণালদার প্রবেশ। তখন সকাল দশটা।

‘এই যে স্টুডিওপাড়ার শাহেনশা’… নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বলল কুণালদা, ‘হাতে কোনও কপি আছে?’

‘না’, খেলা দেখতে দেখতেই মাথা নাড়লাম আমি।

‘একটা ঠিকানা দিচ্ছি। একটা গাড়ি নে। টুক করে গিয়ে এই ছবিগুলো দিয়ে আসবি।’

আমি মাথা নাড়লাম। ছবিগুলো খামে ঢোকানো। খামটা তুলে নিয়ে বেরোতে যাব, কুণালদার বেদবাক্য, ‘এই যে নদের চাঁদ, ঠিকানাটা কার, ছবিগুলোই বা কার মনে একবারও প্রশ্ন জাগলো না?’

আমি মাথা চুলকোচ্ছি।

‘এই কিউরিওসিটি নিয়ে তুই রিপোর্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখিস… অপদার্থ’, খেলাম ধমক।

আমি সামনের চেয়ারে বসে পড়লাম।

‘ঠিকানাটা রুমনি চ্যাটার্জির। ছবিগুলো ওর আগের বিয়ের। এগুলো ওর মায়ের হাতে দিবি। আর পারলে রুমনির হাতের লেখা কোনও কাগজের টুকরো নিয়ে আসবি। চিরকুট হলেও চলবে। বলবি আমি চেয়েছি। আজকের সান্ধ্যয় রুমনির একটা স্টোরি যাবে। মেয়েটার এক লাইন হাতের লেখা দরকার।’

আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘হাতের লেখা… মানে… ঠিক কী ধরণের?’

‘হাতের লেখা বলতে আপনি কি ধরণ বোঝেন?’ পাল্টা প্রশ্ন কুণালদার।

‘চিঠি জাতীয় কিছু বলছ কি?’

‘হ্যাঁ তাই তো… আজকাল-এর মহান রিপোর্টার একদিন তার মরণোত্তর স্টোরি করবে বলে, মরার আগে প্রিয়ব্রত দত্তর নামে এপিটাফ লিখে রেখে গেছেন রুমনি চ্যাটার্জি। যাও গিয়ে নিয়ে এসো।’

কুণালদার পাশেই কমলদা। তাঁর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘উফ অপদার্থটাকে নিয়ে তো আর পারা যায় না। একটা কুড়ি বাইশ বছরের মেয়ে। জীবনের আঠারো উনিশটা বছর একটা বাড়িতে বসবাস করেছে। পড়াশোনা করেছে, বড় হয়েছে… স্কুল বা কলেজের পুরনো খাতাটাতাও তো থাকতে পারে। বা কোনও বই। যেখানে দু-এক টুকরো নোট লিখে রেখেছে। নিদেনপক্ষে কোনও আণ্ডারলাইন… যদি না পারিস তো বল, আমি অন্য কাউকে পাঠাচ্ছি। অপদার্থ…!’

ঝট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। ঠিকানা লেখা কাগজ আর ছবির প্যাকেটটা নিয়ে পা বাড়ালাম।

কুণালদার তাও ঠিক আমার একার ওপর ভরসা হল না। সঙ্গে একজন সিনিয়ার ফটোগ্রাফারকে জুড়ে দিল।


রুমনি মামলাটা ততদিনে অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। ইতিমধ্যে মামলার তদন্তভার যাদবপুর থানার হাত থেকে সিআইডি নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। দেবাংশুদা জেলে। কিছুতেই তার জামিন মঞ্জুর হচ্ছে না, তথ্য প্রমাণ লোপাট হয়ে যাবে এই যুক্তিতে। স্টুডিওপাড়া অবশ্য ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। ‘মহাপ্রভু’ ধারাবাহিকের কাজ চালাচ্ছে দেবাংশুদার সহকারী পার্থ। সেটে আর কেউ আমার সঙ্গে তেমন একটা কথা বলে না। এমন কি যিশুও না। আমার রিপোর্টিং দেখে ও আরও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। ক্রিকেটের টোপও কাজে লাগছে না। যিশুরই বা করণীয় কী! কেরিয়ারের শুরুতেই এমন একটা ধাক্কা। তার প্রথম নায়িকার অপমৃত্যু। যিশু নিজেকে তো গুটিয়ে নেবেই। ততদিনে রুমনির স্থলাভিষিক্ত হয়েছে আর একজন নতুন মুখ। নাম ময়না মুখার্জি। নিয়মিত সম্প্রচারিত হচ্ছে ধারাবাহিকটি। জনপ্রিয়তাতেও ঘাটতি নেই। নেই শুধু আগের খোলামেলা পরিবেশটা। সবই চলছে। যন্ত্রের মতো।

কথায় কথায় পার্থ একদিন শুধু জানাল, ‘যা হচ্ছে সব দেবাদার তৈরি স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী। আমার কাজ শুধু ছেপে যাওয়া।’

‘তাহলে কি তুমি জেলে গিয়ে ইন্সট্রাকশান নিয়ে আসছ?’

নীরবে ঘাড় নাড়ল পার্থ। নেড়েই আমার দু’হাত জড়িয়ে ধরে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘প্লিজ লিখো না। কেস খেয়ে যেতে পারি। জানি না বেআইনি কোনও কাজ করছি কি না।’

আমি ওর অনুরোধ রেখেছিলাম। ও-ও তো সবে কেরিয়ার শুরু করেছে। যদি ফেঁসে যায় আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। কমলদাকে বলেছিলাম। কমলদা বলেছিলেন, ‘চেপে যাও।’ বিষয়টা যে কুণালদার নজরে বা মগজে আসেনি তা নয়। জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘হ্যাঁ রে এখন মহাপ্রভুর স্ক্রিপ্ট, শট ডিভিশন এগুলো করছে কে?’ বলেছিলাম আগামী পঞ্চাশ পর্ব পর্যন্ত দেবাংশুদার স্ক্রিপ্ট রেডি করা আছে। ব্যাপারটা নিয়ে কুণালদা আর মাথা ঘামায়নি।

ঠিকানাটা নারকেলডাঙার। রুমনির বাপের বাড়ির। গাড়ি নিয়ে পৌঁছতে বেশি সময় লাগল না। দু’একজনকে বলতেই অতি উৎসাহে তাঁরা বাড়ি দেখিয়ে দিলেন। পুরনো বাড়ি। ভাঙা চোরা নড়বড়ে সিঁড়ি। দেওয়ালে পলেস্তারার চিহ্ন মাত্র নেই। নিচ থেকে হাঁকাহাঁকি করতেই ওপরে দোতলার সিঁড়ির মাথা থেকে যে মুখটা বেরিয়ে এলো সেটা দেখে আমি রীতিমতো ঘেঁটে গেলাম। আরে! এ তো সেই চাঁদু! (প্রকৃত নামটা সঙ্গত কারণেই উল্লেখ করলাম না) ভবানীপুর ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সাহাবাবুর কেয়ারটেকার। পোলিওতে বিকলাঙ্গ সাহাবাবুর ফাইফরমাশ খাটতো আর চরগিরি করতো। ধূর্ত শিয়াল। মাথায় পাতলা চুল। তাতে জবজবে তেল লেপা। পাতা কাটা সিঁথে। ফর্সা, রোগা চিমড়ে চেহারা। মাঝরি উচ্চতা। চোখে একটা সোনালি ফ্রেমের গোল চশমা। ছাঁটা গোঁফ। হাফ হাতা শার্ট। ঢোলা প্যান্ট। আর বগলে একটা ফোলিওর ব্যাগ সর্বক্ষণের সঙ্গী। একদম ‘যেমন বলবেন স্যার’ টাইপ লুক। আস্ত শয়তান! প্র্যাকটিশে ভিড়ে গিয়ে ক্রিকেট কিট রাখার ট্রাঙ্কের ওপর বসে আমরা কে কী করছি নজর করত, আর সাহাবাবুকে গিয়ে লাগাত।

আমি তো চাঁদুকে দেখে হাঁ। লুকটা একই আছে। এ ব্যাটা এখানে কী করছে? রুমনির কেউ হয় নাকি? চাঁদুও আমাকে দেখে ভিরমি খেয়ে গেছে। সেটা কয়েক মুহুর্তের জন্য। পরক্ষণেই সেই কুখ্যাত ফিচেল হাসি। ‘তুমি!’ বলে হুড়মুড় করে সিঁড়ির কয়েক ধাপ নিচে নেমে এলো। কেটে কেটে বললাম, ‘আজকাল থেকে আসছি। কুণালদা পাঠিয়েছেন। রুমনির মায়ের সঙ্গে একটু দেখা করব। একটা জিনিস দেওয়ার আছে। কুণালদা সেটা ওঁর হাতেই দিতে বলেছেন। আপনি রুমনির…’, কথা শেষ হল না। খপ করে আমার ডান হাতের কবজি খামচে ধরল চাঁদুদা। প্রায় টানতে টানতে আমাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সেই ঘড়ঘড়ে গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘দেখো কে এসেছে। উরিব্বাপ ভাবতেই পারছি না। কী কাণ্ড! এত বছর পর… তুমি এখন সাংবাদিকতা করছ? আজকাল-এ? কী দারুণ ব্যাপার… এসো এসো…’ বলে আমাকে টানতে টানতে দোতলার চাতালে উঠে হাতটা ছেড়ে, ‘কোথায়’ বলে এক হাতে ঘরের পর্দা সরিয়ে বাঁ হাতে আবার আমার হাতটা ধরে হেঁচকা টান মারল। আমি থমকে দাঁড়ালাম চৌকাঠের সামনে। আমার অবস্থাটা তখন বলি দিতে নিয়ে যাওয়া পাঁঠার মতো। পেছনে আমাদের সিনিয়র ফটোগ্রাফার। তিনিও কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। চাঁদু আমাকে চৌকাঠের সামনে দাঁড় করিয়ে ধাঁ করে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। ঝপাং করে মুখের সামনে পর্দাটা পড়ে যেতেই আমি আর ফটোগ্রাফার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। দু’এক সেকেণ্ড পরেই আচমকা পর্দাটা চোখের সামনে থেকে সরে গেল। মুখ তুলে তাকাতেই চমকে উঠলাম। চাঁদুর পাশে ঘোমটা মাথায় দিয়ে দাঁড়ানো ভদ্রমহিলাকে দেখে। ভবানীপুর ক্লাবের ক্যান্টিনের বউদি!

পাশে দাঁড়িয়ে গদগদ মুখে চাঁদুর সংলাপ, ‘চিনতে পারছো, আমাদের সেই অলরাউণ্ডার প্রিয়!’

বিস্ফারিত চোখে আমি তাকিয়ে আছি বউদির দিকে। তিনিও আমার দিকে। আমার হাঁ করা মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘বউদি আপনি… মানে রুমনি…’

হঠাৎ মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন বউদি। ‘হ্যাঁ, আমিই তোমার অপ্সরার মা! রুমনি আমারই মেয়ে!’

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *