ফিল্ম রিভিউ
প্রিয়ব্রত দত্ত
মহরতেই বিচ্ছেদ অঞ্জন রঞ্জিতের
সাফল্য, খ্যাতি, প্রতিপত্তির পরেও পরিচালক যিশু দাশগুপ্তর কোথাও একটা শূন্যতা ছিল। মানুষটা কোনওদিন নিজের অতীতকে ভুলতে পারেননি। যিশুদা যখন সব পেলেন, তখন অতীতের অমানুষিক পরিশ্রম তাঁর শরীরের অর্ধেকটা শুষে নিয়েছে। যেটুকু বাকি ছিল সেটাও গেল অস্বাভাবিক মদ্যপানে। অথচ ইচ্ছে করলেই ‘কুয়াশা যখন’, ‘তৃষ্ণা’র পরিচালক আর কিছুদিন হইহই করে বাঁচতেই পারতেন।
যিশুদা মৃত্যুশয্যায়। দেখা করতে গেছি। মরনোন্মুখ কোনও মানুষকে শেষ বার দেখার জন্য নয়, যিশুদা ছিলেন, আছেন, থাকবেন এই বিশ্বাস নিয়ে। কিডনি, লিভার নষ্ট করে উনি যে প্রায় মৃত্যুর দোরগোড়ায়, সেটা সেদিন বুঝতে পারিনি। ঘরে ঢুকে দেখি বিছানায় শুয়ে আছেন। ওঁরই ভাষায় ‘দাড়ি মাখা কিম্ভূত মুখ’টায় বিষণ্ণতার কালো ছায়া। করুণ, ক্লান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন আমার দিকে।
বিছানায় পায়ের গোড়ায় বসতে গেলাম।
বললেন, ‘কাছে আয়…’
গিয়ে বসলাম মাথার দিকে বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে।
‘কেমন আছ?’
ছাপার অযোগ্য চার অক্ষরের ‘বেদবাক্য’টি উগরে দিয়ে বললেন, ‘শালা রসিকতা করছিস!’
পাশেই ছোট্ট তেপায়ার উপর রাখা স্টিলের টাইমপিসটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এটায় ভোর তিনটেয় আলার্ম দিয়ে রাখতাম। ওটার প্রত্যেককটা টিকটিক শব্দ এখন আমাকে সমানে বলে যাচ্ছে আমার আর কত ঘন্টা বাকি আছে। চা খাবি তো…’
‘না… না… ওসবের দরকার নেই….’
‘তাহলে মদ খা… ভালো মাল আছে, শিভাসরিগাল… খাবি নাকি দু’পাত্তর… তুই খেলে আমিও একটু গলা ভেজানোর বাহানা পাই আর কি…’
‘তুমি এখনও…! আগে সেরে ওঠো… তারপর হবে ওসব…. আচ্ছা তুমি কী বলতো…!’
‘ক্যানসার সারে না রে… শুয়ারের বাচ্চাটা যখন শরীর ছাড়বেই না, তাহলে আমি কেন স্যাক্রিফাইস করি বলতো…কত কিছুর স্বাদ নেওয়া বাকি থেকে গেল রে… ওই ড্রয়ারের ভেতর আছে। বোতল গ্লাস রেডি কর… তোর সঙ্গে আমার শেষ চুমুক… হ্যাঁ রে মরে গেলে আমায় মনে রাখবি তো প্রিয়… ইন্ডাস্ট্রি আমায় মনে রাখবে?’
আচমকা শীর্ণ বাঁ হাতটা দিয়ে আমার ডান হাতটা চেপে ধরে প্রায় কাতর কন্ঠে শিশুর মতো বলে উঠলেন, ‘আমি আর একটু বাঁচতে চাই প্রিয়… বিশ্বাস কর…. এত তাড়াতাড়ি মরে যেতে চাই না…’ বলে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন যিশুদা।
কেন জানি না, ইন্দ্রপুরীতে ঢুকলে যিশুদার সেই কান্নার অনুরণন আজও আমার কানে বাজে। ঢুকেই বাঁদিকে বটগাছ ঘেরা লাল বেদিটায় ধপ করে বসে পড়ি… শুনতে পাই যিশুদার সেই আপ্রাণ আর্তি, ‘আমি মরতে চাই না রে প্রিয়!’
এক এক সময় মনে হয় যিশুদা তিলে তিলে নিজেকে শেষ করেছিলেন। কেন? তার উত্তর আজও খুঁজে বেড়াই আমি। এটা ঠিক যে কখন ওই মারণ রোগ ওঁর শরীরে বাসা বেঁধেছিল, টের পাননি। ধরা পড়েছিল শেষ মুহূর্তে। সেটা হয়েছিল যিশুদার বেপরোয়া জীবন যাপনের জন্যই।
সম্প্রতি ‘যমালয়ে জীবন্ত ভানু’র শুটিং কভার করতে এনটি ওয়ান স্টুডিওতে গিয়েছিলাম। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় কমেডি কিং ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রে অভিনয় করছেন। তার সেট কভারেজ করতে করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম সন্ধ্যে হয়ে গেছে, অথচ এনটি ওয়ান খাঁ খাঁ করছে। স্টুডিওর আগাপাশতলা তো বদলে গেছেই, বদল এসেছে পরিবেশেও। বিকেল থেকে স্টুডিও চত্বরের সামনের রাস্তাটায় একটি ধারাবাহিকের শুটিং চলছিল। সেটাও সন্ধ্যের মুখে প্যাক আপ হয়ে গেল। তার কিছুক্ষণ পর গোটা স্টুডিও চত্বর শুনশান! মানে কী! শাশ্বত কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী ব্যাপার… সন্ধ্যের এনটি ওয়ান শ্মশান?’
মুচকি হেসে শাশ্বত স্বভাব সিদ্ধ রসিকতায় বলল, ‘সে সব দিন আর নেই কাকা… এখন সব ফাঁকা! ইন্ডাস্ট্রির গ্লোবালাইজেশন হয়ে গেছে না! যত দিন যাচ্ছে আমরা সবাই আরও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি। আড্ডার দিন শেষ। স্টুডিও চত্বর থেকে সব অফিস তুলে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা ডিরেক্টর প্রজাতিটাই তো সিরিয়ালের সংসার থেকে ডিলিট হয়ে গেছে। এখন হচ্ছে ইপির (এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসার) জমানা। তেনারা তো সব চ্যানেলের চিলড রুমে বসে আছেন। ওখান থেকেই রিমোর্টে গোটা ব্যাপারটা কন্ট্রোল হচ্ছে। কার কাছে লোকে দেখা করতে আসবে বস! গোটা ব্যাপারটাই যে এখন ভরপুর ভারচুয়াল। ছবি আর বায়োডাটা মেল বা হোয়াটসঅ্যাপ করে দাও, ব্যস ল্যাটা চুকে গেল। যাও বা শুটিং-এর জন্য দু-চার জন জড়ো হলাম, প্রত্যেকে মোবাইলের দিকে চেয়ে বসে আছি।’
সিগারেট শেষ করে এক নম্বর ফ্লোরে সেঁধিয়ে গেলেন শাশ্বত।
তাকিয়ে দেখলাম গোটা স্টুডিও চত্বর যেন থমথম করছে। একটা অদ্ভুত আলো আঁধারির মধ্যে ঝিম মেরে আছে স্টুডিওটা। হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়ালাম চার নম্বর ফ্লোরের সামনে। দরজা বন্ধ। ভেতরে কোন একটা সিরিয়ালের শুটিং চলছে। একজন দরজা ফাঁক করে বাইরে বেরিয়ে এসে আমাকে ব্যোমভোলার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাউকে খুঁজছেন কাকু?’
কী আর উত্তর দেবো। বললাম, ‘না… এমনি ঘুরে দেখছিলাম।’
মনে মনে বললাম, খুঁজছি তো বটেই। অতীতকে! সেই রমরমা সন্ধ্যের শোরগোলকে।
‘আপনি কোত্থেকে আসছেন?’
ছেলেটির প্রশ্নের উত্তরে বর্তমানে ফিরলাম। বললাম, ‘প্রেস।’
‘অ…’ বলে ছেলেটি আমাকে আপাদমস্তক মেপে শিস শিস দিতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। যেন আমি কোনও ভিন্ন গ্রহের প্রাণী। আকাশ থেকে আছড়ে পড়েছি।
পেছন ঘুরতেই দেখলাম আগে যেখানটায় শুটিং চলার সময় প্রোডাকশনের অফিস ঘর ছিল, সেটা আর নেই। ভেঙে মাঠ। যার যখন সিরিয়াল বা সিনেমার শুটিং হতো, সেই প্রোডাকশনের অস্থায়ী অফিস ঘর হিসেবে ব্যবহার হতো ঘরগুলো। ওখানেই অ্যাসবেস্টরের ছাউনি দেওয়া দুটো অফিস ঘরের একটার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো যিশুদাকে আবিষ্কার করেছিলাম এমনই এক সন্ধ্যায়। কী গমগমে ছিল সেই সন্ধ্যেগুলো!
ওই ঘরগুলোর পেছনে ছিল সারি দিয়ে পরিচালকদের অফিস ঘর। কোনওটা প্রভাত রায়ের, কোনটা অঞ্জন চৌধুরীর। গ্ল্যামারের হাতছানিতে হ্যামলিনের বাঁশির সুরে মন্ত্রতাড়িতের মতো হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ছবি নিয়ে প্রতিদিন ছুটে আসতো টালিগঞ্জে। বিশেষ করে প্রযোজক পরিচালকদের সঙ্গে সন্ধ্যে বেলাতেই দেখা হওয়ার সুযোগ।
পাশেই একটা ছোট লন ছিল। কারোর সেদিনকার মতো প্যাক আপ হয়ে গেছে। কারোর টিফিন ব্রেক। স্টুডিওতে তাপস পালের শুটিং থাকলে কাউকে সান্ধ্য জলখাবারের চিন্তা করতে হত না। দু-তিন ধামা ভর্তি সরষের তেল, শশা, চানাচুর, পেঁয়াজ, ধনেপাতা, কাঁচালঙ্কা ইত্যাদি প্রভৃতি দিয়ে মাখা মুড়ি আর এক ধামা তেলেভাজা তাপস পালের সৌজন্যে হাজির। তাপসদার খাবারের প্রতি কোনও বাছবিচার ছিল না। অসম্ভব খেতে ভালোবাসতেন, খাওয়াতেও। সেই মুড়ি মেহেফিলে কে না থাকতেন! সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে প্রসেনজিৎ, চিরঞ্জিৎ, অভিষেক, রঞ্জিত মল্লিক, দীপঙ্কর দে, মুনমুন সেন, ঋতুপর্ণা, রচনা, ইন্দ্রাণী হালদার, অনামিকা সাহা, তনিমা সেন, গীতা দে, বর্ষীয়ান মেক আপ আর্টিস্ট দেবী হালদার, গাম্ভীর্য ভেঙে তরুন মজুমদার, প্রভাত রায়… কত নাম বলব! দৃশ্যত নক্ষত্র সমাবেশ। মুঠো মুঠো মুড়ি-তেলেভাজা আর তুমুল আড্ডা। মহাকরণ থেকে মোহনবাগান, পটল থেকে পাটনা… বিচিত্র বিষয় আর বিষম লেগে যাওয়া রসিকতা। তার মধ্যেই কেউ শট দিতে উঠে যাচ্ছেন। ফিরে এসে আবার মজে যাচ্ছেন মুখরোচক রসনা আর রসিকতায়।
‘কাবেরী অন্তর্ধান’ এর জন্য প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির লনে বসে গৃহস্বামীর ইন্টারভিউ নিচ্ছি, কথা প্রসঙ্গে প্রসেনজিৎ বললেন, ‘সত্যি সেই আড্ডাটা কোথায় হারিয়ে গেল! সে যেন ছিল শিল্পী সাংবাদিকদের সান্ধ্য মিলন মেলা। আমি ভীষণ মিস করি ওই দিনগুলো। আমরা কেমন যেন সব অন্তর্মুখী হয়ে যাচ্ছি। নিজের কাজ শেষ। প্যাক আপ কর। স্টুডিও থেকে বেরিয়ে যাও। এতে কী হচ্ছে বলতো, দেওয়া নেওয়া, আদান প্রদানটা কমে যাচ্ছে।’
সেদিন সন্ধ্যায় ধু ধু এনটি ওয়ানে পায়চারি করতে করতে বড্ড বেশি মনে পড়ছিল দেবাংশু সেনগুপ্ত, যিশু দাশগুপ্তদের কথা। বিরাট প্রতিশ্রুতি আর সম্ভাবনা নিয়ে স্টুডিও পাড়ায় পা রেখেছিলেন ওঁরা। ওঁদের অকাল মৃত্যু প্রতিভার অপচয়, না সময়ের সৃষ্টি ছাড়া খামখেয়ালিপনা জানি না। এই সেদিন চলে গেলেন আর এক একান্নবর্তী পরিচালক, জগন্নাথ গুহ। জগাদা। সীমিত সামর্থ আর সুযোগ নিয়ে ওঁরা বাংলা ফিল্ম ও টেলিভিশনের সংজ্ঞাটাই বদলে দিয়েছিলেন। উত্তম পরবর্তী যুগে অঞ্জন চৌধুরীর ‘শত্রু’ যদি হয় বাংলা ছবির নতুন অধ্যায়, তবে যিশু দাশগুপ্তর ‘কুয়াশা যখন’ ছিল বাংলা টেলি ইন্ডাস্ট্রির মাইলস্টোন। ‘জননী’র কথা মাথায় রেখেও বলছি। যিশুদা দেখিয়ে দিয়েছিলেন আবেগ আর টিআরপিকে আমল না দিয়ে, গল্পকে অযথা ইলাস্টিকের মতো না বাড়িয়ে কীভাবে ধারাবাহিকের শেষ এপিসোড বুনতে হয়। হায়, ব্যাক্তিগত জীবনে যিশুদা যদি তাঁর এপিসোডগুলোর চিত্রনাট্য নিজে না লিখে বিশেষ বিশ্বাসভাজনদের ওপর ভরসা করতেন!
আরও একটা জিনিস হারিয়ে যেতে বসেছে স্টুডিও পাড়া থেকে। সেটা হল পয়লা বৈশাখে নতুন ছবির মহরৎ। এক একটা ফ্লোরে লক্ষ্মী গণেশের মূর্তি বসিয়ে, ঘটা করে ক্যামেরা আর ক্ল্যাপস্টিক, সম্ভব হলে চিত্রনাট্যর খাতা পুজো করে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির দাপুটে ও প্রথম সারির পরিচালক, প্রযোজকরা আগামী বাংলা বর্ষের ছবির তালিকা ঘোষণা করতেন। নায়ক-নায়িকারাও সেজেগুজে মহরৎ শট দিতেন। আর থাকতো এলাহী মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন। বিশেষ করে পরিচালক অঞ্জন চৌধুরীর মহরতে। জুঁই, রজনীগন্ধা, বেলফুলের মিশ্র গন্ধে ম ম করতো গোটা স্টুডিও পাড়া। সকাল থেকে সবার নিমন্ত্রণ। সিনেমা সিরিয়ালের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি মানুষের। বাংলা নববর্ষের দিনটি ছিল যেন বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বাজেট অধিবেশন। আসন্ন বাংলা অর্থবর্ষে সিনেমার পেছনে কত টাকা লগ্নি হতে চলেছে তার একটা আগাম আভাস পাওয়া যেত। বড় ভক্তি, শ্রদ্ধা আর আবেগের সঙ্গে স্টুডিওগুলোতে পালন করা হতো মহরৎ উৎসব।
তবু এত আতিশয্য, আয়োজন, উপাচার, নিয়ম নিষ্ঠা সত্ত্বেও এক মারাত্মক রকমের ছন্দপতন ঘটে গেল সেই পয়লা বৈশাখেই, অঞ্জন চৌধুরীর ‘সন্ত্রাস’ ছবির মহরৎকে কেন্দ্র করে।
চিরঞ্জিত-প্রসেনজিৎ-তাপস তখন পর্দা কাঁপালেও, বাংলা ছবির মেগাস্টার হিসেবে রঞ্জিত মল্লিককেই চিনত তখন গোটা ইন্ডাস্ট্রি। অঞ্জন-রঞ্জিত জুটির রসায়ন ছিল সুপার-ডুপার হিট। ওঁরা যে ছবিতে হাত দেন, সেই ছবিই সুপারহিট। বাংলা ছবির ‘কাদের খান’ অঞ্জন চৌধুরি চিত্রনাট্য শুরু ও শেষ করতেন রঞ্জিত মল্লিককে মাথায় রেখে। সংলাপের শাহেনশা অঞ্জন চৌধুরি রঞ্জিত মল্লিক ছাড়া ছবি তৈরির কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতেন না।
২০০৩ সাল। পয়লা বৈশাখ আসন্ন। তার এক মাস আগে একটা ব্রেকিং নিউজ আছড়ে দিলাম বাংলা বাজারে। আগের বছর ‘বাঙালি বাবু’ সুপার ডুপার হিটের পর অঞ্জন-মিঠুন জুটির পরবর্তী ছবি ‘সন্ত্রাস’। বলা বাহুল্য ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্রে রয়েছেন রঞ্জিত মল্লিক। প্রযোজক নারায়ণ রায়। নারায়ণ মূলত তোচন ঘোষের মতো বাংলার গ্রামে গঞ্জের মাচা অনুষ্ঠানে মুম্বইয়ের শিল্পী সাপ্লায়ার। সেই সূত্রে মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে নারায়ণের গলায় গলায় ভাব। ছবি মহরৎ হবে পয়লা বৈশাখ এনটি ওয়ান স্টুডিওতে। অঞ্জনদার ব্যাক্তিগত আমন্ত্রণে সক্কাল সক্কাল এনটি ওয়ানে হাজির। মহরৎ হবে দু’নম্বর ফ্লোরে। গোটা স্টুডিও ঢেকে গিয়েছে ‘সন্ত্রাস’এর হোর্ডিং ব্যানারে। স্টুডিওর গেট থেকেই ফুলের ফোয়ারা। মাইকে বিসমিল্লা খানের সানাই। প্রতিটি হোর্ডিং ব্যানারে বড় বড় করে মিঠুন চক্রবর্তীর নাম জ্বলজ্বল করছে। আমার কোথায় যেন গোটা ব্যাপারটায় বেসুর লাগছিল। তবে অতটা গুরুত্ব দিইনি। ফ্লোরে গনেশ, লক্ষ্মীর মূর্তি, মা কালীর ছবি, ক্যামেরা ক্ল্যাপস্টিক, এলাহি ফল মূল নৈবেদ্য সাজিয়ে পুজোয় বসেছেন অঞ্জনদা। রঞ্জিত মল্লিক এসে পৌঁছলেই মহরৎ শট টেক করা হবে। সাড়ে এগারোটা নাগাদ রব উঠল রঞ্জিতদার গাড়ি স্টুডিও ঢুকছে। আমি দৌড়লাম রঞ্জিতদার আগমনের সাক্ষী হতে। ফ্লোরের বাইরে বেরিয়ে দেখি রঞ্জিতদা গাড়ি থেকে নেমে ফ্লোরের গেটে সাজানো ‘সন্ত্রাস’ এর হোর্ডিং দেখছেন বিস্ফারিত চোখে।
বিস্ফোরণ ঘটল তার পরের মুহূর্তে!
এ কী আমার নাম… !
পলকে বেসুরো বৈসাদৃশটা বোধগম্য হল। নজরেও এলো। হোর্ডিং-এ মিঠুন চক্রবর্তীর নাম যদি পাঁচশো পয়েন্টে লেখা হয়, রঞ্জিত মল্লিকের নাম পঞ্চাশ পয়েন্টে!
ফেটে পড়লেন রঞ্জিত মল্লিক। ‘অঞ্জন চৌধুরির ছবিতে আমি কি এতই এলেবেলে আর্টিস্ট নাকি! দরকার নেই আমার ছবি করার।’ বলে ফের গাড়িতে উঠে বসলেন রঞ্জিত মল্লিক। অঞ্জনদার সব ছবিতে কিছু না কিছু চরিত্রে অভিনয় করা চাঁদু চৌধুরি ভেতরে ছুটলেন অঞ্জনদাকে খবরটা দিতে। রঞ্জিতদার গাড়ির চারপাশে তখন স্তাবকদের ভিড়… ছিঃ ছিঃ… রঞ্জিতদার এত ছোট হরফে নাম! এটা মেনে নেওয়া যায় না! মিঠুন চক্রবর্তীকে পেয়ে অঞ্জনবাবু রঞ্জিতদাকে ভুলে গেলেন… এই সব ডায়লগ যত কানে ঢুকছে তত মেজাজ চড়ছে রঞ্জিতদার।
গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে এমন সময় ফ্লোরের ভেতর থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন অঞ্জনদা। তাঁকে দেখেই হাসিমুখে রঞ্জিতদা হাতজোড় করে বলে উঠলেন, “সন্ত্রাস’ এর জন্য শুভেচ্ছা রইল। আমি চলি অঞ্জনবাবু।’ অঞ্জনদাকে কার্যত কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রঞ্জিতদার গাড়ি বেরিয়ে গেল এনটি ওয়ান এর ফটক পেরিয়ে।
হতভম্বের মতো চেয়ে থাকলেন অঞ্জনদা। সেই মুহূর্তে টুকরো টুকরো হয়ে গেল অঞ্জন-রঞ্জিত জুটির তিন দশকের গাঁটছড়া।
আমি দৌড়লাম এনটি ওয়ানের গেটের উল্টো দিকে চায়ের দোকানে ফোন করতে।
সেদিন সিগনাস এর ‘সান্ধ্য খবরের কাগজ’এর হেড লাইন ‘মহরতেই বিচ্ছেদ অঞ্জন-রঞ্জিতের’।
সেই সম্পর্ক আর কোনওদিন জোড়া লাগেনি।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন