কুন্তী ও ভারতবর্ষ
মহারানী কুন্তী, মহাভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। বলা যায় মহাভারতের যুদ্ধ হবার পিছনে তাঁর মস্তিষ্ক কাজ করেছিল সবচেয়ে বেশি। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্তম্ভ ছিলেন তিনি। অসীম ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী এই নারী কুন্তী আমাদের অবাক করেন। যৌনতা, ক্ষমতা, মানসিক টানাপোড়েন নিয়ে কুন্তী , আজকের যুগেও সমান আধুনিক। লৌহ মানবী এই নারী নিজেকে কখনো মহিয়সী প্রমাণ করার চেষ্টা করেন নি। অথচ, নিত্য স্মরণীয় পঞ্চকন্যার মধ্যে তিনি একজন। তিনটি পর্যায়ে লেখা উপন্যাস কুন্তী ও ভারতবর্ষ। ১. বিবাহ পূর্ব ২. বিবাহ পরবর্তী ৩. রাজ্য রাজনীতি
মথুরা অঞ্চল। সংঘ অধিপতি আর্যশূরের সভাগৃহে পাশা খেলা চলছে। খেলছেন রাজা আর্যশূর আর তাঁর পিসতুতো ভাই তথা প্রিয় বন্ধু, অন্য এক সংঘের অধিপতি কুন্তিভোজের সঙ্গে। বিপত্নীক এবং সন্তানহীন বলে, আর্যশূর , প্রায়শই তাঁর বন্ধুকে ডেকে ডেকে পাশা খেলে , নানাবিধ আনন্দ দেবার চেষ্টা করেন। আজকের পাশা খেলাও জমে উঠেছে। খেলার মধ্যে মধ্যে দাস দাসী এসে এসে মদ্য, ঘৃতে ভাজা পশু মাংস ছাড়াও টুকরো টুকরো খাবার পরিবেশন করেই চলেছে। দুই রাজা নিমগ্ন চোখ নিবদ্ধ । এই সভাগৃহের এক কোণে বসে আপন মনে খেলছিল রাজা আর্যশুরের একমাত্র কন্যা পৃথা। বছর পাঁচেকের এই বালিকা অতীব সুন্দরী। মাতা পিতার প্রথম সন্তান। পিতার কোল ছাড়া হতে চায়না। খেলতে খেলতে কৌতুহলী চোখ দিচ্ছিল পিতার দিকে। খেলা যাই চলুক, কোনো মতেই যেন তাঁর পিতা হেরে না যায়! খেলা শেষ হবার পরে হল এক কাণ্ড। কুন্তিভোজ আর আর্য শূর __ দুই রাজা পরস্পরের কাছে বিদায় নেবার জন্য তৈরি, নানা রকম কথাবার্তা চলছে। তার মধ্যে রাজা কুন্তীভোজ অভিমান ভরে বললেন “তোমার প্রতিজ্ঞা ভুলে গেলে? বলেছিলে, প্রথম যে সন্তানটি জন্মাবে, তাকে দান করে দেবে আমাকে? আমি দত্তক নেব। সে প্রতিজ্ঞার আর বুঝি কোনো দাম নেই?” রাজা আর্যশূর নিতান্ত লজ্জিত হয়ে মাথা চুলকে, ক্ষমা ভিক্ষা করে, নিজের মহারানী কে আদেশ দিলেন এখুনি পৃথা কে তুলে দাও রাজা ভোজের রথে। এখন থেকে ওখানেই প্রতিপালিত হবে সে।” ছিটকে এলো মহারানী। অসহায় ক্রোধে চিৎকার করে বলে উঠল প্রথম সন্তান। তাঁকে তুমি দান করে দেবে? কোনো অধিকার নেই আমার? তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে রাজা বললেন: প্রথম সন্তান? কন্যা সন্তানের আবার প্রথম দ্বিতীয় কিসের? কন্যা সন্তান দানের যোগ্য। অর্থ যেমন দান করা যায় বন্ধুকে, কন্যাও তেমনি দান করা যায়।” পৃথা নিতান্ত শিশু হলেও খুব বুদ্ধিমতি। সংবেদনশীল। কচি মনে এক বিরাট ধাক্কা লাগল তাঁর। সে একটুও কাঁদল না। ঘাড় শক্ত করে, চলে গেল অন্য এক বাড়িতে। পিছনে পড়ে রইল প্রিয় খেলনা, তাঁকে পরিচর্যা করার প্রিয় দাসী, মায়ের শরীরের গন্ধ। পৃথা নাম মুছে গেল প্রায়। কুন্তিভোজের দত্তক কন্যা কুন্তী বলে পরিচিত হল এরপর থেকে। সেদিন রাতে, অপরিচিত মহলে, একলা শয্যায় সে উচ্চরণ করল এক ভীষণ প্রতিজ্ঞা “পুত্র নই বলে দান করা হল আমাকে। ইতিহাস একদিন বলবে, পৃথা কোনো অংশে কম ছিল না কোনো পুরুষের চাইতে।”
জন্মদাতার নাম বদলে গেল পৃথার। সে এখন রাজা কুন্তীভোজের কন্যা কুন্তী। নাম বদল করার এই নোংরা খেলা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে, নিজেকে তৈরি করতে লাগল নিঃশব্দে। বিদ্যা শিক্ষা, রাজনীতির জ্ঞান, গৃহ কর্ম, পূজা-অর্চনা, প্রজাদের সুখ সুবিধা দেখা, মাত্র চোদ্দ বছর বয়সের মধ্যেই কুন্তী রাজ্যের ভরসা হয়ে উঠল। সর্বোপরি কুন্তী কখনো উত্তেজিত হত না। তাঁর মাথা ছিল খুব ঠাণ্ডা। যে কোনো জটিল সমস্যার সমাধান সে ভেবে ভেবে ঠিক উপায় বার করে ফেলত। শুধু গুণ না, রূপে তার তুলনা নেই। শ্বেত চন্দনের মত গায়ের রং, নাতিদীর্ঘ শরীর। টানা কালো বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। এক ঢাল কালো চুল। চিবুক কঠিন। চাপা। সেখানে একটি বড় কালো জ্বলজ্বল তিল। তবে, সে হাসে কম। স্বভাবত গম্ভীর। চোদ্দ বছরের তুলনায় তাঁর সৌন্দর্যে কিশোরীর লাবন্য চোখে পড়ে কম। বরং তার ব্যক্তিত্ব স্নেহের চাইতে সমীহ আদায় করে বেশি। দিন এমন করেই কাটত। কিন্তু, যে নারী ইতিহাস রচনা করবে বলে জন্ম নিয়েছে, তার জীবনের আকাশে ঘটনার মেঘের আনাগোনা চলতে থাকবে, এ জানা কথা। ঠিক তাই হল। হঠাৎ করেই রাজবাড়ীর আতিথ্য গ্রহণ করতে এলেন, মহারাগী, মহাতেজী ঋষি দুর্বাসা। সঙ্গে তাঁর যত চ্যালা চামুণ্ডা। সে এক দেখবার মত দৃশ্য! রাজপ্রাসাদের সিংহ দরজার সামনে, পঞ্চাশ জন ঋষি মুনির দল। মাথায় জটা, হাতে কমন্ডুল। পরণে গেরুয়া বস্ত্র। সকলের মুখে কেমন রাগ রাগ ভাব। সবার মাঝে দুর্বাসা। তাঁর হাতে আবার এক ত্রিশূল! কপালে লাল সিঁদুর। সেই সময়, ভারতবর্ষে, দুর্বাসা মুনির দাপট ছিল দেখার মত। যত বড় রাজাই হোক না কেন, তাঁর ভয়ে সব রাজাই দূরে থাকত। তিনি যখন ইচ্ছে, যে কোনো রাজার ঘরে অতিথি হবেন এবং রেগে গেলে অভিশাপে তাঁর রাজ্য ধ্বংস করে দেবেন। এ হেন দুর্বাসা মুনি সদলবলে চলে এলেন কুন্তীভোজের রাজ্যে। রাজার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল! তাড়াতাড়ি কোন রকমে মুনির দলকে একটা বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে, কুন্তী কে ডেকে পাঠালেন। কুন্তী এসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মুখ গম্ভীর। এমনিতে তাঁর পালক পিতা লোক খারাপ না। তাঁকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছেন। কিন্তু, তবু কোথায় যেন একটা বাধা কাজ করে। পিতা, বলতে যে আবেগ, যে আদর সেটা কিন্তু এই পালক পিতার মধ্যে দেখে না! বরং, কেমন কৌশলী মনে হয়! এই মুহূর্তে কুন্তীর যেমন মনে হচ্ছে, কিছু একটা বিপদে তাঁকে ফেলবে এই রাজা! খুব ছোট বেলায় প্রায় জোর করে তাঁকে অন্য আশ্রয়ে যেতে হল বলে কি না জানে না , কুন্তীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব প্রখর। বিপদের গন্ধ পায় আগে থেকেই। সে সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রাজা মিহি চিকন সুরে বলল: “পৃথা! তুমি রাজা আর্যশুরের কন্যা। এখন আমার প্রাসাদে মহাতেজা মুনি দুর্বাসা উপস্থিত। তোমাকে তাঁর সেবা যত্নের ভার নিতে হবে। কোনো জটিলতা হলে, আমার কিছু হবে না। তোমার বংশের বদনাম হবে! ঋষির অভিশাপে সব ধ্বংস হয়ে যাবে!” কুন্তীর কান মাথা থেকে আগুন ছুটতে লাগল। এই ব্যাপার! সিংহের মুখে তাঁকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন এই রাজা? এই সময় তাঁকে কুন্তী বলেও ডাকছেন না! কি অদ্ভুত এনার চরিত্র! সে একটুও ভয় পেলো না। বরং ঘৃণা হল তাঁর। মাথা উচুঁ করে দীপ্ত চোখ দুটি রাজার উপর ফেলে, চিবুক সোজা করে বলল: “হে রাজন! আপনি আমাকে যে কাজ দেবেন, আমি করব। আমি আপনার পালিতা। আজ্ঞাবহ। চিন্তা করবেন না। আপনার কোনো অসুবিধে হবে না।” “আমাকে পিতা সম্বোধন করতে পারো পৃথা!” বিষ তেতো হাসি হেসে কুন্তী বলল: “কাজের ক্ষেত্রে রাজা প্রজার সম্পর্কই সুবিধা জনক। পিতা কন্যার সম্পর্কের নরম ভাব এখানে শোভা দেবে না মহারাজ!” রাজা কুন্তীর ভাবান্তর লক্ষ্যই করলেন না। মহা উল্লসিত হয়ে, নধর হরিণীর মত কুন্তী কে সঙ্গে করে, নিয়ে এলেন দুর্বাসা মুনির প্রকোষ্ঠে। কুন্তীর বুক কেঁপে উঠল। তাঁর সামনে যিনি বসে আছেন, তাঁর সর্ব অঙ্গ দিয়ে যেন আগুনের হল্কা বেরুচ্ছে। লাল লাল জটা, রক্ত জমা দুই চোখ। হাত পা সরু সরু। কর্কশ শরীরে সাদা ভস্ম, চোখ দুটি অতিশয় ধূর্ত। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে, ত্রিশূল সজোরে ঠুকে মুনিবর বললেন: “এ তোমার কন্যা? পালিতা! মুনিবর। পালিতা কন্যা। কিন্তু খুব সেবাপরায়ণ। আপনি চিন্তা করবেন না!” ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠলেন ঋষি: দুর্বাসা চিন্তা করে না মূর্খরাজা। চিন্তার কারণ হয় সে। যদি পারে, তবে তো ভালই, না পারলে…? যে শাস্তি হয় দেবেন ঋষিবর। অভিশাপ দেবেন এঁকে। আপনার চরণে এঁকে উৎসর্গ করলাম। যেমন আপনার ইচ্ছে, এঁকে ব্যবহার করুন। বলে, দুই হাত ঘষতে ঘষতে বেরিয়ে গেলেন রাজা। চিন্তা মুক্ত রোদ্দুরে ঝলমল মুখ! যাক বাবা! বন্ধু কন্যার উপর দিয়ে বিপদ উদ্ধার হলেই ভালো। বাঁচা গেল! **** দুর্বাসা স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন সামনে বসা নত মুখী কন্যাটির দিকে। মাটির দিকে চোখ রেখে, হাঁটু মুড়ে বসে আছে। ভঙ্গিটি ভারি সুন্দর। শান্ত। পাশের কক্ষে তাঁর চ্যালা চামুণ্ডা হৈ হৈ করছে। তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন “কল্যাণী! আমাদের ভোজনের ব্যবস্থা করো। আমরা এখন বাইরে যাব। কখন আসব ঠিক নেই। আশা করি অসুবিধে হবে না।” মুখ নিচু করে ছিল বলে কুন্তী, তাঁর চোখ দেখেন নি দেখলে চমকে উঠতেন। সে চোখে আর ভয় নেই। পরিবর্তে খেলা করছে ভয়ানক আত্মবিশ্বাস। সামনের অটল পাহাড় বাধা চূর্ণ করতে পারে এই আত্মবিশ্বাস। এ চোখের অধিকারী হারতে জানে না। প্রতিদ্বন্দ্বী যত কঠিন হোক না কেন, পিছন ফিরে চলে যাবার জন্যে এ কন্যার জন্ম হয় নি।
নিজ মহলে ফিরে এলো কুন্তী। ডেকে পাঠাল তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর শঙ্খচূড় কে। নিজের নামের মত হিংস্র আর চতুর এই পাহাড়ী যুবক, কুন্তীর একটা শব্দ উচ্চারণ মাত্র, সব কিছু করতে পারে। এদের একটা দল আছে। পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। ধনুক বাণ বর্শা এদের অস্ত্র। ছোট দল টিতে মহিলা পুরুষ মিলিয়ে আছে জনা দশেক। গিরগিটির মত নিঃশব্দে কাজ করে। রাজ্যের সব খবর কুন্তী পায় এদের কাছ হতে। তার হাতে তৈরি এই দল। এমন ছোট ছোট দল সে তৈরি করেছে, গত তিন বছর ধরে। রাজ্য জুড়ে এরা মিশে থাকে বাতাসের মত। বাইরে থেকে দেখলে, সাধারণ খেটে খাওয়া গ্রামবাসী মনে হবে। ভিতরে ভিতরে এদের একটা সংগঠন কাজ করে। রাজা কুন্তীভোজ তেমন জনপ্রিয় রাজা নন। রাজ্যের বহু সমস্যায় তিনি উদাসীন থাকেন। পাশা খেলা, শিকার আর পানভোজনে মত্ত থাকেন বলে সীমান্তে বিদেশী শত্রুর আক্রমণ করছে বার বার। রাজ পুরোহিত, আচার্য নরোত্তমভট্ট, রাজার উপর বিরক্ত। তিনি পণ্ডিত মানুষ। মহর্ষি ব্যাসদেবের সঙ্গে মিলে অনেক কাজ করেছেন। নরোত্তম ভট্ট, কুন্তীর শিক্ষকও বটে। শিক্ষকতার ফাঁকে ফাঁকে, রাজনীতির পাঠ দিতেন আচার্য্য। কুন্তীর তীক্ষ্ণ মেধা তাঁকে মুগ্ধ করত। দিনে দিনে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার সুবাদে, কুন্তী পরিচিত হয় তাঁর কাজের সঙ্গে। আচার্য নেতৃত্ব দ্যান এই গুপ্ত সংগঠনের। বাইরে তিনি রাজার পুরোহিত। ভিতরে রাজ বিদ্রোহী। রাজকুমারীর মনের ভিতরের অবসাদ তাঁর চোখ এড়ায় নি। কারণ জেনেছেন অল্প অল্প করে। লক্ষ্য করেছেন মেয়ের আছে ছাইচাপা আগুন। দরকার উপযুক্ত শিক্ষা। কুন্তী ধীরে ধীরে শিখছে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস। অস্ত্র বিদ্যা শিখছে। গোপনে চলে গেছে গভীর অরণ্যে। মিশেছে আদিবাসীদের সঙ্গে। সহজাত নেতৃত্ব তাঁর স্বভাবে। তাঁকে দেখে মুগ্ধ হয় সরল লোকগুলি। রাজকুমারী তাদের কাছে দেবীর মত। এই আদিবাসীদের নেতা হল বছর আঠারোর শঙ্খচূড়। কালো কষ্টিপাথরে কুঁদে তোলা শরীর। ছোট ছোট চোখে অপার সারল্য। হাতে বর্শা থাকে একটা। চটপটে। ক্ষিপ্র। কুন্তীর সব কাজে শঙ্খচূড় গোপনে হাজিরা দেয়। ***** সন্ধ্যা সমাগত। দুর্বাসা দল বল নিয়ে বেরিয়ে গেছে। কালো ছায়ার মত কুন্তীর ঘরে ঢুকে এলো শঙ্খচূড়। “আদেশ রাজকুমারী।” “লোক ঢুকিয়ে দাও, ঋষিদের সঙ্গে। যেখানে যেখানে ওনারা যাচ্ছেন, সব খবর পলকের মধ্যে চাই। কি কথা বলছেন, সেটাও জানা চাই। ওনারা দেব ভাষায় কথা বলবেন। তাই সঙ্গে রেখো শিক্ষিত কিছু লোক। রণপা ব্যবহার করে, খবর জানাবে দ্রুত।” “আপনার আজ্ঞা পালন হবে। চিন্তা করবেন না।” কুন্তী স্মিত হাসল। খুব কম হাসে সে। আজ হাসল। কারণ তাঁর সামনে কেউ শর্ত রেখেছে। বাজি রেখেছে। এই সব সময় তাঁর হাসি পায়। সামনের পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখ মনে করে হাসি পায় তাঁর। ****** আর্যাবর্ত ভারতবর্ষে ঋষিরা ছিলেন প্রবল প্রতাপশালী। একথা মনে করা ভুল, যে, ওনারা তপোবন বানিয়ে, জপ ধ্যান করতেন! প্রতিটি আশ্রমে রাজ্য রাজনীতি আলোচনা হত। সক্রিয় ভূমিকা থাকত এদের। কোনো কোনো আশ্রমে অস্ত্র থাকত। জপ ধ্যান হত অবশ্যই, কারণ ও ছিল তার। সমাজ বিজ্ঞান, দর্শন শাস্ত্র, রাজনীতি__সবেতেই ঋষিরা নাক গলাতে ভালোবাসতেন। ক্ষত্রিয় রাজারা সমীহ করতেন ঋষিদের যথেষ্ট। এর মধ্যে ঋষি দুর্বাসা আরো এক কাঠি উপরে। ওনার মন কখনো ভালো। কখনো খারাপ। মানুষকে নানা ভাবে জব্দ করতে খুব ভালোবাসেন। যখন তখন ক্ষ্যাপার মত অভিশাপ দিয়ে বসেন! ওনার বেশ কিছু শিষ্য আছে। তাদের নিয়ে ” বম বম” করতে করতে ঘুরে বেড়ান। ঋষিদের দলটি পাহাড়ের পাশ দিয়ে সংকীর্ণ পথ ধরে এগোচ্ছিল। গন্তব্য নদীর ধার। ওখানে বসে নানারকম আলোচনা করে, প্রাসাদে ফিরবেন। ওনারা লক্ষ্য করলেন না, দু একটি ছায়া তাদের সঙ্গে ঘুরছে ফিরছে। নিজের মনে মত্ত ঋষির দল, নদীর দিকে এগোতে লাগল। ****** প্রায় এক বছর হতে চলল, দুর্বাসা আছেন কুন্তীর সঙ্গে। এক বছর! এত দিন ঋষি দুর্বাসা থাকেনি কারো সঙ্গে। ঋষি হলেও, তিনি মোটেও বৃদ্ধ নন। অতি অল্প বয়সে সিদ্ধি লাভ করেন, এখন তাঁর চল্লিশ বছর। তবে কি রূপসী রাজকুমারীর মোহে বাঁধা হলেন ঋষি? এমন প্রশ্ন দুর্বাসা কে মুখের উপর করতে কেউ সাহস পায় না, কিন্তু সকলে অবাক হচ্ছে। অবাক নিজেও হচ্ছেন ঋষি ! এ কন্যা কোন ধাতুতে তৈরী? প্রতিদিন নতুন নতুন আদেশ করেন, খেতে বসে সব খাবার ফেলে দিয়ে একেবারে অদ্ভুত খাবারের নাম করেন, মৃদু হেসে সে সব হাজির করে কুন্তী! যা চাইছেন, যা ভাবছেন সব পাচ্ছেন হাতের কাছে! কি করে সম্ভব? এত টুকু কিশোরী ! দুর্বাসা উত্তরোত্তর অবাক! মুখে হম্বি তম্বি করছেন বটে, কিন্তু তেজ আগের চাইতে অনেক কম। বরং সুযোগ পেলে গল্প করেন রাজকন্যার সঙ্গে। খুব পরিণত বুদ্ধির, আধ্যাত্মিক জ্ঞান প্রচুর, ধীর কন্যাটির সাহচর্য মুগ্ধ করছে তাঁকে। তিনি কি ভালোবাসছেন ? কঠোর দূর্মুখ ঋষির মনে আসছে প্রেম? শিউরে উঠলেন দুর্বাসা! এ কি ভাবছেন তিনি? যে আশ্রয় দেয়,তাঁর কন্যা নিজ কন্যা সম। এমন ভাবনা অন্যায়! নাহ্। এবার যাবার সময় হলো তাঁর। চলে যেতে হবে এবার। দুর্বাসা মনস্থির করলেন। কিন্তু তার আগে কুন্তীকে দান করবেন এক মহামন্ত্র। সেই মন্ত্র, যা পৃথিবীতে কেউ কোনোদিন লাভ করবে না। করতে পারবে না। কুন্তীর সেবার উত্তরে কালজয়ী মন্ত্রটি হবে তাঁর পুরস্কার। হাতে জল আর ফুল নিয়ে বসলেন দুর্বাসা। কুন্তী কাছে এসে বসল। সাদা বস্ত্র পরিধানে পূর্ণিমার চাঁদের মত দেখাচ্ছে তাঁকে। গম্ভীর গলায় দুর্বাসা বললেন: তোমার সেবায় তুষ্ট আমি রাজনন্দিনী। বর দিচ্ছি তোমাকে। গ্রহণ করো।
সহায়তা: কালী প্রসন্ন সিংহ – মহাভারত মহাভারতের একশটি দুর্লভ মুহূর্ত – ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য কৃষ্ণা কুন্তী এবং কৌন্তেয় – নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী
Very good story….