micro-story-aamar-keu-nei

আমার কেউ নেই
মনজুর সাদ


অনাকাঙ্ক্ষিত ছুটির ঘোষণা এল। মুহূর্তের মধ্যেই পুরো ক্যাম্পাস ফাঁকা হয়ে গেল। শুধু আমি একাই রয়ে গেলাম। আমার কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। রুমের এক কোণে বসে এ-ফোর সাইজের খাতাটা নিলাম। যখন আমার ভালো না লাগে, সময় না কাটে, তখন এই খাতা নিই। আঁকিবুঁকি করি। শব্দের সঙ্গে খেলি। ছোট ছোট রম্যগল্প লিখি।

একটা ছেলে এল। আমার অনেক জুনিয়র। আমি তাকে আমার বিছানায় বসতে বললাম। সে খানিকটা সংকোচ বোধ করল। বসতে রাজি নয়। আমি হাত ধরে টেনে বসালাম। জড়সড় হয়ে বসল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ক্যাম্পাসে তো কেউ নেই। সবাই চলে গেছে। তুমি যাওনি ক্যান?’

‘আপনি আছেন যে তাই।’ বলে মুচকি হাসল।

‘আমি তো আছি বিশেষ প্রয়োজনে। কাল দিন পর আমার কাজটা শেষ হবে। আমিও চলে যাব। তুমি বাড়িতে যাবা কবে?’

ছেলেটা শুধু চোখ দিয়ে হাসে। আমি মানুষের চাহনি পড়তে পারি। চোখ দেখলেই বুঝতে পারি মানুষটা কেমন। ওর চোখে-মুখে বিষণ্নতার ছাপ। হাসলেও হাসিটা ঠিকমতো ফুটে উঠছে না।

‘বাড়ি থেকে গাড়িভাড়ার টাকা পাঠায় নাই। আমার হাতেও টাকা নাই। তাই যেতে পারছি না। কয়টা দিন থাকব। ঘোরাঘুরি করব। আশপাশে টিউশনি পাই কি না দেখব। আপনার কাছে কি কোনো টিউশনি আছে, আমাকে দিতে পারবেন?’

‘নাহ, আমার কাছে নেই।’

‘তোমার বাসায় কে কে আছে?’

‘সবাই আছে। কিন্তু আমার কেউ নেই।’

‘থেকেও নেই এমনটা বলছ কেন? অনেক অভিমান করে বলছ নিশ্চয়ই?’

ছেলেটা হাসল। হেসে বলল, ‘মা নেই। মা মারা যাওয়ার পর বাবা আরেকটা বিয়ে করেছেন। ঘরে সৎমা। আমাকে দেখতে পারেন না। বড় দুই ভাই বিবাহিত। ওদেরও সংসার আছে। কোনোরকমে চলছে। তার মধ্যে আমার পড়াশোনার খরচ দেওয়া ওদের অনেক কষ্ট হয়ে যায়। ওদের কষ্ট দিতে ইচ্ছা করে না। বড় ভাইয়া মাঝেমধ্যে ফোন দিয়ে বলে, তোর টাকাটুকা লাগলে বলিস। আমি জানি, টাকা চাইলে দিতে পারবে না। মনে কষ্ট পাবে। তাই বলি না। টাকা না থাকলেও বলি, টাকা আছে। পাঠাতে হবে না।’

ছয় মাস পর বাবা কল দিয়ে বলেন, ‘টেকা লাগলে কইস। টেকা পাঠামু নি। উপোস থাকিস না। গত মাসে ৫০০ টেকা পাঠাইছিলাম। পাইছোস নি? টেকা পাওয়ার পর জানানো লাগে না? ভালোমতো খাবি। ওই টেকা দিয়ে বিকালে বাইরের খাবার খাইস।’

বাবা হয়তো জানে না যে এটা চড়া মূল্যের বাজার। ৫০০ টাকায় মাস চলবে তো দূরের কথা, দিনই ঠিকমতো চলে না। ‘তুমি তাহলে বাড়িতে যাবা না?’

ছেলেটা উত্তর দিল না।

‘আচ্ছা ভাই, কন তো আল্লাহ আমারে এত কষ্ট দিচ্ছে কেন? কত বড়লোকের পোলাপান দেখি উরাধুরা টাকা উড়ায়। এখানে যায়, সেখানে যায়। তারপরও ওদের অভাব নাই। আর আমার…’

আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। এই উত্তর আমারও জানা নেই। আমি নিজেও একজন পাপী।

আমি ক্যাম্পাসের জানালার বাইরে তাকালাম। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করছি। ওর সামনে চোখের জল ফেলা ঠিক হবে না। পুরুষ মানুষের জল খুবই ভয়ংকর। সে উঠে দাঁড়িয়ে গেছে। আমি বললাম, ‘এই, একটু বসো। আমি তোমাকে একটা অনুরোধ করব। অনুরোধটা রাখবে?’

‘কী যেন কন না, ভাই। আপনি একটা কথা কইবেন আর আমি সেটা শুনব না, এটা কী করে হয়?’

‘তুমি এক কাজ করতে পারো। আমার কাছে কিছু টাকা আছে। কোনো কাজে লাগাতে পারছি না। তুমি এই টাকাগুলো রেখে দাও। আমি অনেক খুশি হব।’

সে নিতে রাজি হলো না। অনেক জোরাজুরি করলাম তারপরও। আমি বললাম, ‘আচ্ছা, আপাতত রাখো। যেদিন তোমার অনেক টাকা হবে সেদিন তোমার সামনে দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটা ছোরা বের করে বলব, এই ভদ্রলোক, ট্যাকা দিবি কি না বল? নাকি গ্যাচ করে ভুঁড়ি গালিয়ে দেব? তাড়াতাড়ি বের কর। কুইক। কেউ আসার আগেই। আমার হাতে কিন্তু একদমই টাইম নাই।’

ছেলেটা খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, ‘ভাই, আপনি এত সুন্দর সুন্দর কথা কই পান? আপনের ডায়ালগ শুনে মনে হইতাছে, আমি বিনা টিকিটে হলে আইসা সিনেমা দেখতাছি। হা হা।’

সে হাসি থামাতে পারছে না। পুরো ক্যাম্পাসের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল তার হাসি। আমি ওর হাসিমুখে তাকিয়ে আছি। হাসি দেখছি বারবার। বুকের মধ্যে এত ব্যথা নিয়েও মানুষ কী সুন্দর করে হাসতে জানে। তার হাসি দেখে মনে হচ্ছে, আমার সামনে এক টুকরা বাংলাদেশ হাসছে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *