অমিতা মজুমদার
মিনারা বেগমের আজ সকালটা কেমন অন্যরকম লাগছে।
অন্যদিনগুলোতে মিনারা বেগমের দিনের শুরু হয় ফজরের নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষে কিছু সময় পবিত্র কুরআন শরীফ পাঠ করেন। এরপরে শুরু করেন জাগতিক কাজ।
সত্তরোর্ধ মিনারা বেগম বেশ শক্ত সমর্থ শরীর নিয়ে ভালোই আছেন। সেরকম রোগ-বালাই নাই। ঢাকার লালামাটিয়ায় সুদৃশ্য তিনতলা একটি বাড়িতে একাই থাকেন বলা যায়। আশির দশকে করা বাড়িটি মিনারা বেগম নিজের মনের মতো করে করেছেন। পাঁচিল ঘেরা বাড়িতে রয়েছে ছোট্ট একটা ফুলের বাগান, মৌসুমি সবজির ক্ষেত। পাঁচিল লাগোয়া বেশ কিছু দেশি ফলফলাদির গাছ। আজকের সময়ে হলে সবটাই হয়তো আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকায় ভরা থাকত। দোতলায় খাবার ঘর, বসার ঘর, একটা গেস্ট রুম আর মিনারা বেগমের ঘর। তিনতলায় মিনারা বেগমের দুই ছেলের ঘর। এখন খালিই থাকে। কারণ দুই ছেলেই উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা। তারা সেনাবাহিনীর নির্ধারিত আবাসনে থাকে।
সকালে মিনারা বেগম কিছুটা সময় নিচে হাঁটাহাঁটি করেন, বাগানের পরিচর্যা করেন মালির সাথে হাত মিলিয়ে। এটা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস।
কিন্তু আজ সবকিছু বদলে গেছে। মিনারা বেগম উঠেছেন সকালে, ওজু শেষে নামাজে বসেছেন, নামাজ আদায় করেছেন কিন্তু অন্যদিনের মতো মন বসাতে পারেনি।
তাই নামাজ শেষে নিজের শোবার ঘরের বড়ো আয়নাটার সামনে দাঁড়ায়। মাথার রুপালি চুল, কপালের বলিরেখা গালের ঝুলে পড়া চামড়া দেখতে দেখতে কেমন আনমনা হয়ে যায়। নিজের মুখে যেন র্যাডক্লিফের পেন্সিলের আঁকা মানচিত্র দেখতে পায়। সাতচল্লিশে যে পেন্সিলের রেখায় সীমানা নির্ধারিত হয়েছিল দুটি দেশের, যা পরবর্তীতে তিনটি দেশে পরিণত হয়।
এক লহমায় মিনারা বেগম চলে যায় খুলনার ব্রাহ্মনপাড়ায়। মণিমোহন ভট্চায খুলনা শহরের নামকরা উকিল তখন। এক নামে সবাই চেনে। শহরের বুকে দু’’বিঘা জমির উপরে বাড়ি। কাছারি বাড়ি, ঠাকুর দালান, তুলসী মঞ্চ, গাছ-গাছালি ঘেরা বাড়িটা দূর থেকে সবার চোখে পড়ে। বাড়িতে সবসময় লোকে গমগম করে। পালা-পার্বণ লেগেই থাকে। সাতচল্লিশের পরে বাড়ির কিছু সদস্য ভারতে চলে যায়, কিন্তু মণিমোহন বাবু দাপটের সাথেই খুলনা শহরে বসবাস করেন। এ বাড়ির বড়ো ছেলে সমরেন্দ্র ভট্টাচার্যর সাথে মৃন্ময়ীর বিয়ে হয়। মৃন্ময়ী সবে স্কুল ফাইনাল দিয়েছে। খুব ধুমধাম হয় সে বিয়েতে। সালটা ছিল ১৯৬৫। বিয়ের মাসখানেকের মধ্যে শহরে কেমন একটা চাপা উত্তেজনা টের পাওয়া যাচ্ছিল। একদিন শহরের অবাঙ্গালি পাড়া থেকে কিছু মানুষ হঠাৎ রাস্তায় নেমে আসে, হাতে নানারকম অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে। তাদের সামনে পড়ে যায় সমরেন্দ্র। রাস্তায়ই তারা সমরেন্দ্রকে কুপিয়ে মেরে ফেলে। মণিবাবু কেমন চুপ হয়ে যান সমরেন্দ্র’র ক্ষত-বিক্ষত দেহটা দেখে। দু-তিনদিন কারও সাথে কোন কথা বলেননি। এরমধ্যে মনে হচ্ছিল শহরে কেমন একটা ভুতুরে নীরবতা নেমে এসেছে। পাড়া-প্রতিবেশিরা এসে যার যার মতো করে কেউ বলছে আমরা আছি কোন ভয় নেই উকিলবাবু, আবার একদল রাতের অন্ধকারে নীরবে দেশ ত্যাগ করছে। এরকম অবস্থায় কয়েকটা দিন কেটে যায়। সমরেন্দ্র’র পারলৌকিক ক্রিয়া কোনমতে শেষ করে।
যে’দিন সমরেন্দ্র’র পারলৌকিক ক্রিয়া শেষ হয়, সারা দিনের ক্লান্তি শেষে সমস্ত বাড়িটা সন্ধ্যা না হতেই যেন ঝিমিয়ে পড়ে। সকলেই যার যার ঘরে ঘুমাতে যায়। মৃন্ময়ীও নিজের ঘরে যায়, আর কেমন যেন আচ্ছন্নের মতো শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।
একটু বেলা হলে ঘুম ভাঙে মৃন্ময়ীর, তাড়াতাড়ি উঠে ঘরের বাইরে আসে। কিন্তু বেরিয়ে মনে হয় বাড়িটা শূন্য খাঁ খাঁ করছে। সে ছুটে এঘর ওঘর করে কোথাও কাউকে দেখতে পায় না।
একসময় বাড়ির ফাই ফরমাস খাটত যে রহিম শেখ সে এসে সামনে দাঁড়ায়, বলে বাবুদের সবাইকে নিরাপদে নদী পার করে ওপারে পৌঁছে দিয়েছি। বাবুরা এই বাড়িঘর সম্পত্তি আর তোমারে দেখার ভার আমারে দিয়া গেছে। যদি কখনও ফিরে আসে —।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন