micro-story-amghumanta-goutamke

ঘুমন্ত গৌতমকে ডেকে দিন, হাত ধরে পালাবো
কামরুল হাসান


‘এই যে শুনুন।’

চমকে ওঠে রুদ্র। তাকিয়ে দেখে বেতস লতার মতো ছিপছিপে একটি মেয়ে পথের ধারেই একটি ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ওকে ডাকছে। মেয়েটির হলুদবরণ ত্বকের সাথে মিশে গেছে হলুদ শাড়ির রঙ। একদম হলুদবরণ পাখি!

এই কুয়াশামাখা শীতের ভোরে ঈশ্বর এত দয়াময়? রুদ্র নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারে না।

সে প্রসন্ন এগিয়ে যায়। কী কথা বলিতে চায় বনভূমের ভেতর হৃদস্পন্দন বাজিয়ে চলা ঐ পাখির মতো হলুদ পরীটি?

মেয়েটি অপ্রতিভ নয় মোটেই। সে রুদ্রর চোখের দিকে তাকায় মায়াময় দুই চোখ মেলে। রুদ্রর আর বাক সরে না।

‘ঐ জানালায় একটু টোকা দিন না। গুণে গুণে তিনবার। প্লিজ!’

রুদ্র এর রহস্যভেদ করতে পারে না। তার শুধু মনে পড়ে আবুল হাসানের সেই কবিতা যাতে কাকের মুখে গুণে গুণে তিন নয়, সাতটি চাল ফেলে দেবার অনুরোধ আছে, যেন বিপদ উড়ে চলে যায়। রুদ্রর বিপদ ঘনাচ্ছে কি না বুঝতে পারে না। সে ভেবেছিল হলুদ পরী তাকে জিজ্ঞেস করবে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’

সে প্রশ্নবোধক চোখে তাকায়। দেবী দুর্গা এই পত্রমর্মরিত বনে অসুরের সাথে কী কথা বলিতে চায়? মেয়েটি বল্ল, ‘ওখানে একজন ঘুমিয়ে আছে, তাকে একটু জাগিয়ে দিন।’

বিদ্যুৎপৃষ্ঠ নয়, এক মন্ত্রতাড়িত সাধুর মতো রুদ্র এগিয়ে যায় জানালাটির দিকে। কাঠের পিঠে গুণে গুণে তিনটে টোকা দেয়। মৃদু কিন্তু সুস্পষ্ট।

জানালার কপাট খুলে এক ঝাঁকড়া চুলের মাথা ঘুমজড়ানো চোখে বাইরে তাকায়। মুখ ফুটে কিছু বলে না সে, কিন্তু অনুচ্চারণের অর্থ হলো, কী? রুদ্র তখন একটু আড়ালে থাকা হলুদ পরীকে ইশারায় দেখিয়ে দেয়। ’আপনাকে ডাকছে’ নিচুগলায় বলে।

‘ও বুঝেছি।’ ঝাঁকড়া চুলের মাথা কপাট দুটো ভেজিয়ে দেয়।

‘ধন্যবাদ, আপনাকে।’

কে বল্ল কথাটা? হলুদ মেয়েটি, নাকি ছেলেটা? রুদ্র তখন হাঁটছে। সামনের পথটা কি আরো বেশি কুয়াশাময় হয়ে উঠল?


ভেজা বেড়াল


একবার বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থার লোকদের ট্রেনিং দিতে শিশির নওগাঁ শহরে গিয়েছে। সঙ্গে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির তরুণ শিক্ষক ফয়সাল। সেসময়ে নওগাঁয় কোন ভালো হোটেল ছিলো না। তারা কোনরকম চলনসই এক হোটেলে উঠেছে। পরদিন হোটেল থেকে ট্রেনিং ভেন্যুতে যাচ্ছিল রিকশায় চড়ে, দেখে নওগাঁ শহরের দেয়ালে দেয়ালে এক সিনেমার পোস্টার। ছবির নাম ‘ভেজা বেড়াল’। নিচে লেখা ‘এরা কিন্তু আপনার আশেপাশেই আছে।’যাওয়া-আসার পথে যতবার ঐ পোস্টারে চোখ পড়ে, ততবার ফয়সাল বলে, ‘শিশির ভাই, দেখেছেন ভেজা বেড়াল? এরা কিন্তু আপনার আশেপাশেই আছে।’তৃতীয়দিনে একটু বিরক্ত হয়েই শিশির ফয়সালকে বলে, ‘তোমার আশেপাশে তো আমাকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।’ফয়সাল অমায়িক হাসে।

ট্রেনিং যেদিন শেষ হলো, সেদিন কৃষি উন্নয়ন সংস্থার স্থানীয় ব্যবস্থাপক তাদের চাইনিজ (ফুড, মানুষ নয়) খাওয়াতে নিয়ে গেল এক রেস্তোরাঁয়। ডিনার শেষে ফয়সাল একটি সিনেমা দেখার আবদার জানালে তারা ‘ভেজা বেড়াল’ছবিটি দেখতে স্থানীয় এক সিনেমাহলে যায়। শিশিরের মনে পড়ে বহুকাল সে সিনেমাহলে গিয়ে কোন বাংলা সিনেমা দেখেনি। মফস্বল শহরে এসে সিনেমা দেখার ভেতর রোমাঞ্চ খুঁজে পায়। নাইট শো ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। এতটাই দেরি যে কাউন্টারে টিকেটবিক্রেতা পর্যন্ত পরামর্শ দেয় টিকেট ‘না’কেনার। তারা নাছোড়বান্দা, সিনেমা দেখবেই। এতদিন পরে সিনেমা দেখার মওকা ছাড়তে রাজি নয়। ব্যালকনির তিনটি টিকেট কিনে সদর্পে প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করে।

তাদের মধুচন্দ্রিমা অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। এমন অখাদ্য সিনেমা যে বড়জোর ত্রিশ মিনিট কোনক্রমে দমবন্ধ হয়ে প্রেক্ষাগৃহে থাকতে পারে। ছটফট করে বাইরে বেরিয়ে মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নিল তিনজনেই। টিকেটের পয়সা গচ্চা গেছে যাক, প্রাণ তো ধড়ে আছে। সিনেমা হলের গেটম্যান খুব অবাক। তিনজন লোক সিনেমা শুরু হবার আধঘণ্টা পরে হলে ঢুকল, আর বেরিয়ে গেল সিনেমা শেষ হবার দেড় ঘণ্টা আগেই!

সেবছরই বাংলাদেশ প্রযোজক সমিতি আয়োজিত বার্ষিক চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতার পুরস্কার দেবার অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পায় শিশির। হোটেল শেরাটনের উইন্টার গার্ডেনে অনুষ্ঠিত জমজমাট আসরে তাকে নিয়ে যায় তার ছোট ভাই শিহাব। আমন্ত্রণপত্র সে-ই পেয়েছিল। দেখে একজন লোক বারংবার স্টেজে উঠছে আর নামছে। বেশ সক্রিয় মানুষটিকে দেখে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না সে সংগঠকদেরই একজন। শিহাবকে জিজ্ঞেস করে, ‘কে রে, লোকটা, চিনিস নাকি?’ শিহাব মাথা নাড়ে, সে চেনে না। ওর পাশে বসে থাকা ভদ্রলোক জানান, ‘উনি এ সময়কার একজন প্রতিভাবান চলচ্চিত্র পরিচালক।’শিশির জিজ্ঞেস করে, ‘তাই নাকি? তার পরিচালিত দু-একটা ভালো ছবির নাম বলতে পারবেন?’

ভদ্রলোক অম্লানবদনে উত্তর দিলেন, ‘ভেজা বেড়াল।’

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *