Micro Story – Ami to Achi

আমি তো আছি
জয়তী রায়

জীবনে অনেক কিছু করেছেন তাপসবাবু। জুতো সেলাই থেকে চন্ডী পাঠ। আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট। স্ত্রী মীরা মারা যাবার পর থেকে ছেলে তপনকে বড় করার সঙ্গে সঙ্গে  ব্যবসা সামলানো। শুনতে যত সোজা, কার্যক্ষেত্রে বেশ কঠিন। ওয়ান ম্যান ফ্যামিলি… হুঁ হুঁ বাবা। সোজা না কি?

শুধু লেখাপড়া দেখলে তো চলে না। বাচ্চার জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার বানানোই হল আসল কাজ।  যদিও তপন তার মায়ের মত। পাতলা ধাতুর। তাপসবাবুর মত হাড্ডা গড্ডা  নয়। তাই, জ্যান্ত মাছের পাতলা ঝোল, টেংরি জুস, স-অ-ব থাকত সময় মত। এর পরে আবার টিউশন নিয়ে যাওয়া, এককথায় তপনের দিন রাত, বাবা নামক সূর্যের চারদিকে ঘূর্ণিত হত। তপন তেমন করে মায়ের অভাব টের পেল না। কিছু হলেই তাপস বাবু অভয় দিতেন, “চিন্তা নেই। আমি তো আছি।”

 

 

তপন প্রেম থেকে দূরে রইল। কো এড কলেজ হলেও প্রেমে পড়েনি, এটা এমন কোনো বড় ব্যাপার না। জগতে সবাইকে প্রেম করতেই হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। তাপসবাবু ফুৎকারে উড়িয়ে দ্যান।

“লেখা পড়া কর। চাকরি নে। মেয়েছেলে নিয়ে চিন্তা করিস না। বিয়ে? ওতো আমি আছি।”

 

পাশ করে চাকরি পাবার পরেই, তাপস বাবু উঠে পড়ে লেগেছেন। খবরের কাগজ রে, বিজ্ঞাপন রে, যাবতীয় সব কিছু করে তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে এলেন নীলার ব্যাপারে।

তপন একটু  নিমরাজি।  মেয়ে চাকরি করে না। সারাদিন বসে বসে কি করবে? তাপস বাবু বললেন, “ভালোই হল। বাড়ির বউ ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে অফিস যাবে, এ ভালো লাগবে না। এতদিন বাড়িতে তোর মা ছিল না। এখন কেউ থাক। চুড়ির ঠিনঠিন শব্দ বাজুক ঘরে। ঘুরুক ফিরুক আলহাদ করুক!”

 

বিয়ে হল ধূমধাম করে। তাপস বাবু মনের সুখে বাজার করলেন। নীলাকে সঙ্গে নিয়ে তার পছন্দের শাড়ি, ব্যাগ, জুতো–বহুদিন পরে মহিলাদের জিনিস কিনতে ভারি ভালো লাগছিল তার। তপন সঙ্গে থাকতে চায়, কিন্তু তার আবার আফিস আছে। তাতে কি! তাপস বাবু বললেন, “তুই চিন্তা করিস না। আমি তো আছি। আমার ব্যবসা তো নিজের।”

 

মহা উৎসাহে , গাড়ী বার করে নীলাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন হই হই করে। নীলার মায়ের কোমরে ব্যথা। তিনি কাতর কণ্ঠে বললেন, “দাদা। আমি না গেলে চলবে?”

“খুব চলবে। বরং আপনার কোনো কাজ যদি থাকে, বলুন করে দিচ্ছি।”

নীলার মায়ের হাতে স্বর্গ ।

বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন মুগ্ধ। শাশুড়ির ঝামেলা নেই, তার উপরে শ্বশুর এমন মাই ডিয়ার। তুই তো রাজ করবি রে নীলা! আমাদের কপাল দ্যাখ।

 

 

বিয়ের পর তপন বলল, “শোনো, তুমি চাকরি বাকরি করো না। সারাদিন করবে কি? তার চেয়ে সকালে আমার সঙ্গে বেরিয়ে বাড়ি যাবে। সন্ধ্যে বেলা নিয়ে আসব।”

“কি করব বাড়ি গিয়ে?”

“মায়ের কাছে থাকবে।”

“মায়ের কাছে!”

 

নীলা মুখ বেঁকিয়ে বলল, “মা কেবল ঘ্যান ঘ্যান করে। ভালো লাগে না।”

“কিন্তু এখানে যে একলা!” তপন শেষ চেষ্টা করে।

“কেন? বাবা আছেন তো। বাবা ইচ্ছে মত ব্যবসায় যান। কাজেই অসুবিধে হবে না।”

 

নাহ্। অসুবিধে কিছুই হল না। তাপস বাবু যেন ম্যাজিক জানেন। নীলা ঘুম থেকে ওঠার আগেই কফি রেডি। ব্রেকফাস্ট রোজ নতুন নতুন। পছন্দের সব খাবার।  এ যেন আলাদিনের  খেলা।

 

এই এসে গেল সর্ষে ইলিশ। এই এলো নতুন সিনেমার টিকিট। এই এলো নতুন ফোন।

নীলা আহ্লাদে গলে যায়।

“চলো ছাদে। নতুন গাছ লাগাব।”

কি উৎসাহ। কি প্রাণবন্ত। রোজ জীবন যেন নতুন খবর নিয়ে আসে।

তপন ম্রিয়মাণ হতে হতে গুণ গুণ করে প্রশ্ন করে, “তোমার অসুবিধে হচ্ছে না তো। বলো নীলা! অসুবিধে হলে না হয় তোমাকে বাপের বাড়ি… মানে এখানে মা নেই তো!”

নীলা অবাক। চোখ বড় বড় করে। আজ পরনে লাল ঢাকাই। গতকাল শ্বশুরের সারপ্রাইজ গিফট। এখন মসৃণ বিকেল। সে যাবে বন্ধুর বাড়ি। তাপসবাবু পৌঁছে দেবেন। এমন সুরেলা গতিময় জীবনে  তপন হঠাৎ হঠাৎ ব্যাঘাত ঘটায়। সে তিরিক্ষে মেজাজে বলে, “মা তো সেই কবের থেকে নেই। কিছু আটকেছে বলে তো মনে হয় না! তবে আজ এত কিসের কথা?”

বাইরে থেকে গাড়ির অধৈর্য হর্ন শোনা গেল। নীলা হিল জুতোর শব্দ তুলে বেরিয়ে গেল।

 

এর মধ্যে আফিসের কাজে তপনকে বাইরে যেতে হবে দিন কতকের জন্য। খবরটা শোনা মাত্র আফিস থেকেই ফোন করল নীলার মোবাইলে, “শোনো। জিনিসপত্র প্যাক করে নাও। আমি বাইরে যাচ্ছি । তুমিও চলো। হানিমুন বলে তো তেমন কিছু হল না। এই ফাঁকে সেটা হয় যাবে।”

অপর প্রান্তে নীলার গলা গম্ভীর, “তুমি তো অফিসে কাজ করবে। আমি ওখানে কি ভ্যারেণ্ডা ভাজব? আমি যাব না।”

“আরে এ আবার কি কথা? আমি নেই। তুমি একলা করবে কি?”

নীলার ফোনে এবার শোনা গেল তাপসবাবুর গলা,

 

ভয় নেই । আমি তো আছি।

 

ফোন নামিয়ে রেখে আপনমনে বলে তপন,

“সেটাই তো ভয়ের।”

2 thoughts on “Micro Story – Ami to Achi

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *