মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়
“এবারের রাখীবন্ধন উৎসব আরও জমজমাট করে করতে হবে। বুঝেছিস তোরা?”
অমরদার কথায় বাকিরা মাথা নাড়ে। নামেই মিটিং। কার্যক্ষেত্রে অমরদার কথাই শেষ কথা। তবে এটাও ঠিক, আজ অবধি কোন ক্ষেত্রেই অমরদার কথায় ভরসা করে ক্লাবকে কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি। বরং তাদের ক্লাব ‘কোরক’এর অভিনব কর্মসূচীর জন্য অন্যেরা আর পাঁচটা ক্লাবের থেকে ভিন্ন চোখে দেখে। তাদের নতুন ভাবনা আর তার রূপায়ণে বারেবারে মুগ্ধ হয়।
“শুধু মাথা নাড়লে হবে? কী প্ল্যানিং করেছি মন দিয়ে শোন।”
অমরদার ‘প্ল্যানিং’ মানেই খাতা পেন লাগবে। একটু এদিক ওদিক হওয়ার উপায় নেই। তবে এপাড়ায় শানু আসার পর লেখার ব্যাপারটা একটু পাল্টেছে। ও ট্যাবে টপাটপ টাইপ করে লিখে নেয়। দরকার মত ক্লাবের মেইল আইডি বা অমরদার মেইলে পাঠিয়ে দেয়।
শানুর আসল নাম স্মরণজিৎ। শানু নামটা অমরদার দেওয়া। কিন্তু হলে কী হবে, ছেলেটাকে অমরদা যেন সহ্য করতেই পারে না। কথায়-কথায় মেজাজ দেখায়। রেগে কথা বলে। আর শানুও হয়েছে তেমন। অমরদা ওকে দূরছাই করবে। আর ও অপার বিস্ময় নিয়ে অমরদার দিকে তাকিয়ে থাকবে।
শানুকে দেখতে ভারি সুন্দর। টকটকে ফর্সা, তীক্ষ্ণ নাক, আর চোখদুটোয় যেন মায়াকাজল লাগানো। তেমন সুন্দর ব্যবহার। অমন ছেলেকে ভাল না বেসে থাকা যায় না। শুধু অমরদা যে কেন শানুর সঙ্গে অত বাজে ব্যবহার করে কেউ বুঝতে পারে না।
মাত্র মাস কয়েকের মধ্যে পলাশ, হরিৎ, শিশিরের খুব ভাল বন্ধু হয়ে গেছে শানু। একসঙ্গে আড্ডা, গল্প, খেলা সব চলে। শানুর মা নেই। বাবাও অফিসের কাজে খুব ব্যস্ত থাকেন। তবে শানু একা থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। একদিন হরিৎ বলছিল, “আচ্ছা, তোর বাড়িতে একা একা লাগে না?”
শানু খুব জোরে হেসে উঠে বলেছিল, “তোরা বাড়িতে সবাই একসঙ্গে থাকিস তো, তাই আমার একাকিত্ব দেখে তোদের মায়া হয়। তাই তো? কিন্তু বিশ্বাস কর, একদিন হয়তো অসুবিধে হতো। কষ্ট হতো। কিন্তু সেসব দিন আমি অনেক আগে পার করে এসেছি। আমি যখন এইটে পড়ি মা মারা যায়। আর আজ আমার থার্ড ইয়ার। বুঝতেই পারছিস?”
তবে ওরা দেখত শানু ওদের বাড়িতে এলে শিশুর মতো উচ্ছ্বল হয়ে ওঠে। ওদের সঙ্গে যত না কথা বলে, ওদের মায়েদের সঙ্গে গল্প করে বেশি। ওরা শানুর কষ্ট বুঝত বলেই প্রায় পালা করে শানুকে ওদের বাড়িতে নিয়ে যেত।
রাখীবন্ধন উৎসবের সকাল। প্রস্তুতি প্রায় শেষ। শুধু অমরদার বাড়ি থেকে কুঁচোফুল নিতে হবে। ওই ফুল দিয়ে সাদা কাগজের ওপর লেখা ‘শুভ রাখীবন্ধন’এ আঠার ওপর ফুলগুলো আটকে দিতে হবে। সবাই সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেছে। পলাশ এসেছে অমরদার বাড়িতে। ফুল নিতে। ভেজানো দরজার ওপাশে চাপা গলার স্বরে দাঁড়িয়ে যায় পলাশ। শানু ফুঁপিয়ে কাঁদছে না! অমরদার ঘরে শানু কী করছে? আলতো হাতে অল্প করে দরজা ফাঁক করে পলাশ।
“তুই সেই আমার আগল ভেঙে দিলি শানু! তোকে কাছে ঘেঁষতে দেব না বলে প্রথম দিন থেকে তোর সঙ্গে জেনেবুঝে খারাপ ব্যবহার করেছি।”
শানুর ফোঁপানি আরও বেড়ে যায়।
“কী করব অমরদা? আমিও যে প্রথম দিন থেকে তোমায় ভালবেসে ফেলেছি। তুমি ভালবাস না আমায়?”
“এই ভালবাসা কেউ কোনদিন ভাল চোখে দেখবে না রে। তাই নিজেকে আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম। তবে আর নয়। তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আর কষ্ট পেতে দেব না তোকে।”
“ঠিক বলছ?” শানু আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে অমরকে।
অমরের মুখ নেমে আসে শানুর মুখের ওপর।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন