micro-story-banshi

বাঁশি
অপরাহ্ণ সুসমিতো


বাঁশি-১


আমার মেয়েটার নাম বাঁশি। ক্লাস টু’তে পড়ে। ওর ক্লাস শুরু হয় সকাল ৮টা থেকে। সাধারণত ও ঘুম থেকে ওঠে সকাল ৭টায়। রেডি হয়। আমি ওকে খাওয়াই, রেডি করি। বাঁশি সকালে খেতে চায় না। টালবাহানা করে। আমি জোর করে খাওয়াই। ওর মা নেই। দালালকে ৬ লাখ টাকা দিয়ে গৃহকর্মী হিসাবে সৌদি আরব গিয়েছিল। একসময় কফিনভর্তি হয়ে ওর লাশ আসে।

আমাদের ছোট্ট বাড়ির জানালা দিয়ে সরিষা ক্ষেত দেখা যায়। হলুদ সরিষা ফুল বাতাসে দোলে। ক্ষেতের পাশেই আমার স্ত্রীর কবর। বাঁশিকে স্কুলের জন্য রেডি করতে করতে ওদিকে তাকিয়ে থাকি। অভাবের ফাঁক ফোকড় দেখি, মেয়েটার মুখের দিকে আগামী স্বপ্ন বাঁধি।

মেয়ে আমার আজ মহাখুশি যে ওরই স্কুলে আমার চাকরি হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষক। পকেট থেকে যোগদানপত্র বের করে তাকিয়ে থাকি। যেন সোনার হরিণ।

নাম: মো: বেদার উদ্দিন মৃধা
পিতা: মৃত ছালু মৃধা
সাং: ডাসার
থানা: কালকিনি
জেলা: মাদারীপুর

১৫তম গ্রেড ( পিটিআই প্রশিক্ষণবিহীন) ৯৭০০-২৩,৪৯০/ স্কেলে নলিয়াকান্দি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে সংযুক্ত করা হইল।
এই আদেশ জনস্বার্থে জারী করা হইল।
যোগদানপত্রের দিকে তাকাতে তাকাতে হিসাব করি টাকার ঘ্রাণ।

মূল বেতন: ৯৭০০/ টাকা
বাড়ি ভাড়া ৫০%: ৪,৮৫০/
চিকিৎসা ভাতা : ১,৫০০/
টিফিন : ২০০/
মোট: ১৬,২৫০ টাকা
কল্যান ভাতা ও রেভিনিউ স্ট্যাম্প ব্যয় বাদে ১৬,০৫০ টাকা থাকবে। সন্তান পড়াশোনারত থাকলে ১ সন্তান মাসিক ৫০০/-টাকা। সর্বমোট ১৬,৫৫০ টাকা।

বাঁশির ডাকে বাস্তবে ফিরে আসি। আমারও রেডি হতে হবে। প্রথম স্কুলের দিন দেরি করা যাবে না। মন আরো ভালো যে বাঁশির স্কুলেই আমি পড়াব।
বাঁশির হাত ধরে যাত্রা শুরু করি। স্কুলটা দূরে না। বাঁশি আমার হাত ধরেই লাফাচ্ছে। ওকে শান্ত রাখা যাচ্ছে না। সরিষার ক্ষেতের পাশ ধরে সরু আলপথ রাস্তা। আজ মনে হচ্ছে সমস্ত গ্রাম রোদের টাঙ্গাইল সূতি পরেছে। কলাপাতাকে মনে হচ্ছে পল্লি কবি জসীম উদ্দিন।

বাঁশির মা কি টের পাচ্ছে কিছু?

ক্লাস শুরু হলো। কী অবাক কাণ্ড আমার জীবনের প্রথম ক্লাস বাঁশিদের সাথেই। ক্লাসে ঢুকেই সারিসারি ছেলেমেয়েদের মাঝে আমার মেয়েটাকে খুঁজতে থাকি। ওকে আবিষ্কার করতে বেশি সময় লাগে না। কী আনন্দ ওর চোখেমুখে..

মা হারা এই মেয়ের আনন্দে আমি কোন কথা খুঁজে পাই না। টিনের চালের গরমে আমি ঘামতে থাকি।

হাজিরা খাতা ধরে আমি ক্লাসরুমে দাঁড়িয়েই থাকি..


বাঁশি-২


ক্লাসরুমের গরমে ঘামতে থাকি। রুমের বাচ্চা ছেলেমেয়েদের চেঁচামেচিতে সম্বিত ফিরে আসে। রোলকলের খাতাটা খুলে নাম ডাকতে শুরু করি।

আমার মেয়ের ভালো নাম প্রবহমান সুসমিতো। ডাক নাম বাঁশি। হাজিরাখতায় ওর নামের কাছে এসে এক মুহূর্ত থামি। ভালো নামে না ডেকে ডাকলাম: বাঁশিইইইই

বাচ্চারা খিলখিল হেসে ওঠে। তাকিয়ে দেখি বাঁশি আমার দিকে লজ্জিত তাকিয়ে আছে। পৃথিবীর সারল্য নিবেদিত মুখ। বেচারী লজ্জিত। কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। ওর সাথের বন্ধুরা ওরা হয়ে জবাব দেয় উপস্থিত স্যার।

পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছি। আজ কি বেশি গরম?

স্কুলের জানালা দিয়ে ধান ক্ষেতের আল। গরমের রোদের কম্পমান ছায়া। মেদাকুল বাজার থেকে কি বাতাস উধাও হলো? মেদাকুল বাজারের পাশে পরপর দুটো পুরানো মঠ আছে। প্রাচীন আমলের। তার পাশেই শতবর্ষী বট গাছ। কত বাদুর যে ঝুলে থাকে।

রোলকল শেষ হলে একটু বসি। ভাবছি কিভাবে শুরু করব। এইসব বাচ্চাদের মন জয় করতে হবে। আমার বাঁশির মন জয় করতে হবে। বাইরে কিসের যেন কোলাহল শুনতে পাই। দরজার দিকে তাকাতে দেখি আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, আমাদের জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আর সানগ্লাস পরিহিত জেলা প্রশাসক মহোদয়।

তাঁরা সবাই আমার ক্লাসে ঢুকছেন।

ক্লাসের বাইরের তেঁতুল গাছে কয়েকটা কাক তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। আমি একসাথে এতজন কর্মকর্তা আমার ক্লাসে ঢুকছে দেখে নার্ভাস হয়ে গেলাম আরো। যে সাদা জামাটা পরে এসেছিলাম, কুলকুল ঘামে ভিজে চিপসে গেলাম। গলা শুকিয়ে সাহারা।

এক গ্লাস পানি খেতে পারতাম যদি এখন।

প্রধান শিক্ষক স্যার আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ওনাদের সাথে, এটাও জানাতে ভুললেন না যে আজই আমার প্রথম কর্ম দিবস। এক ঝলক বাঁশির দিকে নজর পড়ল। সে রাজ্যের সুষমা নিয়ে আমাকে দেখছে।

ডিসি স্যার আমার দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন শুরু করেন;

: নাম কি মহাশয়ের?
: স্যার মো: বেদার উদ্দিন মৃধা
: পড়াশুনা কতটুকু?

ডিসি সাহেব ভালো করেই জানেন প্রাথমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা। তোতলাতে তোতলাতে বললাম;

: স্যার গোপালগঞ্জ কলেজ থেকে বিএসসি
তিনি ভ্রুকুটি করলেন। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারছে না। তবে ভাগ্য ভালো যে তারা বেশ শান্ত হয়ে আছে। কিন্তু পাশের গাছের কাকগুলোর চেঁচামেচি থামছে না। তেঁতুল গাছের পাশ গলে স্কুলের খেলার মাঠ। একটা মোরগ মুরগীর সাথে ওসব শুরু করে দিলো। আমি এক নজর ওদিকে তাকাতেই লজ্জা পেলাম, চটজলদি চোখ সরিয়ে নিলাম। যেন আমিই ওদের ওসবে অনুমতি দিয়েছি।

ডিসি সাহেবও দেখলেন। সানগ্লাসটা খুলে সাথের গানম্যানের হাতে দিলেন যিনি স্যারের ব্রিফকেস ধরে আছেন। এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেতে পারতাম যদি।
আমাকে আবার প্রশ্ন শুরু করলেন;
: আচ্ছা মৃধা বলেন তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাবার নাম কি?

বঙ্গবন্ধুর মায়ের নাম জানি, বাবার নাম আর মনে পড়ছে না। ঘামছি।

: বলেন তো ডেপুটি কমিশনার বানান কি? ডেপুটি বানান করে কমিশনারে এসে আটকে গেলাম। জট পাকিয়ে যাচ্ছে কয়টা এম বা কয়টা এস।

তাঁর চোখে শবে বরাতের হালুয়া রুটির মতো খুশির খুশবু মনে হলো। আমাকে আবার প্রশ্ন করলেন;
: বলেন তো এ বছর গণিতে কে নোবেল প্রাইজ পেয়েছে?
: স্যার গণিতে নোবেল দেয়া হয় না
তিনি একটু হোঁচট খেলেন বলে মনে হলো। খুব দ্রুত প্রশ্ন করলেন;
: আচ্ছা শার্ল বোদলেয়ার বানান করেন তো

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্যার এবার আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করলেন;
: স্যার ও তো বিজ্ঞানের ছাত্র

জেলা প্রশাসক মহোদয় মনে হয় শিক্ষা অফিসারের কথা শুনতে পেলেন না। খানিকটা রেগে গিয়েই বললেন;
: এসব শিক্ষক নামের কলঙ্ক। আপনারা ধরে এসব পেটাতে পারেন না?

ক্লাসের সবাই চুপ হয়ে গেলো আরো। গরমের দাপুটে সন্ত্রাসে আমি একদম বোধহীন হলাম কিনা বুঝতে পারছি না। কতদিন যে আকাশে মেঘ করছে না, বৃষ্টি হচ্ছে না ঝুপুর ঝুপুর। কতদিন বৃষ্টিতে ভিজে আমি আর বাঁশি মাঠে খেলছি না। তেঁতুল গাছের কাকগুলো কোথায় গেল? চেঁচামেচি আর শুনতে পাচ্ছি না কেন?

মোরগ মুরগী দুটোকেও দেখতে পাচ্ছি না। বাঁশি কী মনে করে যেন ওর বেঞ্চ থেকে উঠে আমার কাছে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়াল। ও কি ভয় পেয়েছে?

আমি শক্ত করে বাঁশির হাত ধরে রাখলাম।
কী আশ্চর্য বাঁশির হাতও আমার মতো ঘামে টইটই।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *