micro-story-bhimroti

ভিমরতি
সুজিত বসাক


এই প্রথম ভয় পেলেন রামতনুবাবু। তার বাহাত্তর বছরের জীবনে প্রথমবার। মানুষ মাত্রই ভয় পায়। কিন্তু সে ভয়ের অভিঘাত একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকে। অন্তত রামতনুর জীবনে তেমনটাই হয়েছে। একটু আগে তাকে যে ভয় দেখিয়ে গেল তার নাম মৃত্যু। বলে গেল, আমি আসছি। রামতনুর মনে হল, এই ভয় আসলে মৃত্যুর প্রতিনিধি। যে মৃত্যু না আসা পর্যন্ত রামতনুর কাছেই থাকবে।

“কী গো, বোবায় ধরেছে নাকি তোমায়?”

স্ত্রী সোনালীর ডাকে ধড়পড় করে উঠে বসলেন, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন তার মুখের দিকে। নির্বোধ চাউনি। সোনালীর চোখে বিস্ময়। প্রচন্ড প্রতাপশালী রামতনুর এই রূপ দেখে হতচকিত।

“শরীর খারাপ লাগছে নাকি তোমার? অনি, বউমা কেউ অফিস যায়নি এখনও। ডাকব ওদের?”

সামান্য ধাতস্থ হতেই হাতের ইশারায় সোনালীকে নিষেধ করলেন। সোনালী জলের গ্লাস এগিয়ে ধরলেন। ঢক ঢক করে বেশ খানিকটা জল খেলেন রামতনু। কন্ঠে বাক্য ফিরে এল, “না না তার দরকার নেই। অযথা ওদের টেনশন বাড়িও না। এমনিতেই বেচারাদের সারাদিন প্রাণান্তকর পরিশ্রম করতে হয়। এত দৌড়ঝাঁপের জীবন!”

অভিমানী মুখে সোনালী বললেন, “তুমি কিছুটা কমাতে পারতে। কিন্তু অনির কথা তো কানেই তুললে না। খুব জেদ তোমার। বিশ্বরূপ আর ফিরবে না। মেমসাহেব বিয়ে করে ওখানেই থেকে গেল। ছোট ছেলেকেও তাড়াতে চাও। বাড়ি আগলে বসে থাকো।”

অবাক চোখে সোনালীর দিকে তাকালেন রামতনু। থমথমে মুখ, অভিমান ঝরে পড়ছে। সোনালী কোনদিন তার মুখের ওপর কথা বলেননি। রামতনু সেটাকে সমীহ ভাবতেন। এইমুহুর্তে মনে হল, সেটা মুখোশ ছিল। এটাই মুখোশের পিছনের আসল মুখ।

“অনি তোমাকে বলেছিল এই বাড়িটা বিক্রি করে ওর অফিসের কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাট নেবে। তুমি সরাসরি না করে দিলে। এই ভাঙাচোরা বাড়িটার প্রতি তোমার যত না মায়া, তার অনেক বেশি ছিল নিজের জেদ আর কর্তৃত্ব বজায় রাখার দম্ভ। আমি সব জানি।”

“তুমি আর কী কী জানো আমার সম্পর্কে সোনালী?” বলতে চেয়েও বলতে পারলেন না রামতনু। কথাগুলো জিভের কাছাকাছি পৌঁছে আটকে রইল। সিগন্যালে আটকে থাকা ট্রেনের মতো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শান্ত গলায় বললেন, “আমি মত পাল্টে ফেলেছি… মানে এইমুহুর্তেই পাল্টে ফেললাম। তোমাদের সবকিছুই মেনে নেব। তুমি অনিকে বলে দিও, ও যেন খদ্দের দেখতে শুরু করে।”

হকচকিয়ে গেলেন সোনালী। ঠিক বিশ্বাস করতে পারলেন না যেন। হতভম্ব সোনালীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এমন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছো কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না? একটু আগেই তো এই নিয়ে কত কথা শোনালে। আমিও ভেবে দেখলাম, তোমার কথাই ঠিক। পিঠে যত বোঝা থাকবে, যেতে তত কষ্ট হবে।”

“মানে! কোথায় যেতে চাও তুমি?”

“বা রে, মরতে হবে না? আমি কি অমর বর নিয়ে জন্মেছি নাকি? এখন ওদের সুখেই আমার সুখ। বাঁধন আলগা করতে হবে এবার…”

বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না সোনালীর। হঠাৎ করে কী এমন হল, এত পরিবর্তন! এবার যে প্রশ্নটি করলেন রামতনু তাতে আরও ঘাবড়ে গেলেন সোনালী।

“সোনালী, তোমারও তো বয়স কম হল না। আচ্ছা, তোমার কি মরতে ভয় করে?”

“হঠাৎ এসব অলুক্ষণে কথা কেন? সবাইকেই তো একদিন মরতে হবে। যেটা হবেই সেটা নিয়ে অত ভয় পাওয়ার কী আছে, বলারই বা কী আছে?” ধমকে উঠলেন সোনালী।

হঠাৎ করে হো হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন রামতনু। সোনালী ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে বলে উঠলেন, “পাগল হয়ে গেলে নাকি?”

“হতে যাচ্ছিলাম। তুমি বাঁচিয়ে দিলে। আমি একটা গাধা….”

কথাটা শেষ করেই বাথরুমে চলে গেলেন রামতনু। সোনালী বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। একেই কি ভিমরতি বলে!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *