micro-story-bismrito

বিস্মৃত
রাখী আঢ্য


ভুলে যাওয়া নীহারের একটা বদ রোগ। বয়স যত বেড়েছে রোগ তত জাঁকিয়ে বসেছে। আজ সকালে বউ কি যেন একটা আনতে বলেছিল না…। নীহার রাস্তায় বেরিয়ে কিছুটা যাওয়ার পরেই সেটা বেমালুম ভুলে গেছে। এ তো মহা বিপদ! এখন তো আর বাড়ি ফিরে বৌকে জিজ্ঞাসা করা যায় না। তাহলে অন্য আর এক বিপত্তি দেখা দেবে।

মানুষ মাত্রই কম বেশি ভুলে যেতে পারে। কিন্তু বছরখানেক হলো নীহারের ব্যাপারটা যেন মাত্রা ছাড়িয়েছে। সকালে উঠে মনে করতে পারেন না গতরাতে কি খেয়েছিলেন, বাজার-দোকানে বেরোবার সময় বউ সোনালীর কাছ থেকে জেনে নিলেও রাস্তায় গিয়ে ভুলে যান কি আনতে বলা হয়েছিল, এমনকি অফিসের কাজে ভুল করে বড়বাবুর বকুনি খাওয়াটা আজকাল যেন নিত্যঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া আত্মীয়-বন্ধুদের জন্মদিন, তাদের সাথে কাটানো যৌবনের সুখকর দিনগুলো, জীবনের নানা অধ্যায়ে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী, সবেতেই আজকাল স্মৃতির ঘর হাতড়ে নীহারবাবু শুধুই শূন্যতা খুঁজে পাচ্ছেন। সোনালীর পরামর্শেই হবে হয়তো, কিছুদিন আগে পাড়ার ডাক্তার চ্যাটার্জীকে দেখিয়েছেন, উনি কিছু ওষুধও লিখে দিয়েছিলেন হয়তো, তবে স্বাভাবিক ভাবেই সেগুলো আর নিয়মিত খাওয়া হয় না।

বাজারের ব্যাগ হাতে দত্তদের রোয়াকে বসে পড়লেন নীহার বাবু। পকেটে হাত দিয়ে দেখলেন তিনি বেশ অনেকগুলো টাকা নিয়ে বেরিয়েছেন। মানে বোধহয় অনেকগুলো জিনিস কিনতে হবে। তাহলে কি আজকে কোন বিশেষ দিন? সোনালীর জন্মদিন বা তাদের বিবাহ বার্ষিকী? নাকি বাড়িতে কেউ আসবে? এতো আচ্ছা বিপদ। পকেট থেকে ফোনটা বার করলেন। এবার বউকে ফোন করা ছাড়া কোনো গতি নেই। সোনালী নামটা ডায়াল করলেন, ও প্রান্তে রিং হয়ে গেল। কেউ ফোন ধরল না। তাহলে কি বাথরুমে গেছে? তিনি বউয়ের ফোনে মেসেজ করতে গিয়ে দেখলেন আর এক সমস্যা। ইন্টারনেট প্যাকটা কবে যেন শেষ হয়ে গেছে। এখন ফোনে শুধুই ইনকামিং-আউটগোয়িং। খানিকক্ষণ চুপ করে ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। তারপরে ভাবলেন, বেলা দশটার সময় যখন বেরিয়েছেন তাহলে নিশ্চয়ই দুপুরে খাবারের জন্যই বাজার করতে হবে। তাহলে সেইমতো জিনিস কিনে নিয়ে আনলেই হবে।

বাজারে নীহারবাবুর বাঁধা মাছওয়ালা মধু। এটা মনে রাখতে হয় না। মুখ দেখলেই চিনতে পারেন। মধুর কাছে এক কিলো কাতলা মাছের অর্ডার দিলেন। ভাবলেন এতগুলো টাকা নিয়ে বেরিয়েছেন, তার মানে বিশেষ দিন, বেশি জিনিস নিয়ে যাওয়া উচিত। মধু মাছের আঁশ ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,’বাবু কালকেও তো আপনি এক কিলো রুই নিয়ে গেছিলেন, মাছটা ভালো ছিল তো?’

নীহারবাবু অবাক হয়ে মধুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাড়াতাড়ি হঠাৎ যেন মনে পরে গেছে এমন ভাব করে বললেন, ‘ওমা দেখেছিস, বেমালুম ভুলে গেছি। আজ তাহলে থাক।’ বলেই পিছন ফিরে হনহন করে হাঁটা দিলেন।

এই ভুলে যাওয়া রোগটি তো ক্রমাগত খারাপের দিকে যেতে বসেছে। নীহারবাবু প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। দোকান বাজার পরে হবে। ভগবান জানেন ডাক্তার তাকে কি বলেছিলেন। প্রেসক্রিপশন তা কোথায় রেখেছিলেন মনে পড়ছে না। আজকেই সোনালীর সাথে আবার যেতে হবে সেই ডাক্তারের কাছে।

বাড়ি পৌঁছে বাজারের ব্যাগটা রেখেই ‘সোনালী’ বলে ডেকে উঠলেন। কোন সাড়াশব্দ নেই। এখনো কি তবে সোনালী বাথরুমে? কি মনে হতে নীহার তাদের বেডরুমে ঢুকে দেখলেন খাটের বিছানা আলু থালু হয়ে পড়ে আছে। জিনিসপত্র এদিকে ছড়ানো। ‘সোনালী…’ তার ডাকটা অনেকটা নিজের কাছে আর্তনাদের মতই শোনালো। তারপর চোখ পড়লো খাটের পেছনের দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে শুকনো মালাটা সরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘সোনালী, তোমার চলে যাওয়াটাও মনে রাখতে পারিনি! কোনটা বেশি কঠিন বলোতো? তোমাকে মনে রাখা নাকি তোমার অস্তিত্বকে ভুলে যাওয়া?’

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *