micro-story-bodhikaka

বোধিকাকা
সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়


বোধিকাকাদের বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেছে।

এখন ভোর থেকে ঢং ঠং আওয়াজের রংঢং-এ মাথা ধরে যায়। ওদের রেখে যাওয়া দাগ তুলতে আওয়াজ, ফেলে যাওয়া জং ছাড়াতে আওয়াজ, ঘর দোরের খোলনালচে পালটে ফেলার আওয়াজ এসবের মধ্যে বৃতির মনে পড়ে বোধিকাকার মায়ের এঁটো বাসন রাখার আওয়াজ, দাওয়ায় বসে শিল কাটানোর আওয়াজের কথা। গেরস্থালির আওয়াজে একটা আরাম আছে। সেটা এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না কিছুদিন। কুকুর ছিল যে একটা ওদের! নেড়ি। বারোয়ারীই জন্মেছিল। খেতে পেতে পেতে বাড়ির কুকুর হয়ে গেছিল ওদের। রাতে মাঝে মাঝে কাঁদত।

এখন তো কেউ নেই, তাও কেন মনে হয় কান্না শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। মা বলে ভুটেদের তালগাছে প্যাঁচার বাচ্চা কাঁদছে। কিন্তু পাখী আর কুকুরের কান্না এক হয় নাকি? হতে পারে?

বোধিকাকার মাও কাঁদত। বিড়ে ঠাকমা বলত বৃতিরা তাকে। বড্ড বেঁটে বলে চেয়ারের ওপর বিড়ে বেঁধে তারওপর কুশন রেখে বসত বারান্দায়। তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদত।

ঠাকমাও। কবে কোথায় আসানসোলের বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। ঠাকমার বাপের দেওয়া সব গয়না ডাকাতে নিয়ে যায় কথায় কথায় সে সব কথা তুলে কান্না।

ওদের বাড়িতে কাজের লোক টিকত না। বউও টেঁকেনি কাকার। দ্যাখ না দ্যাখ ঝগড়া হত। কাকির গলা সবাই শুনতে পেত কিন্তু বোধিকাকার গলা শোনা যেত না মোট্টে। খালি অনেক রাতে চেয়ারের বিড়েতে বসে ঠাকমা কাঁদত যখন নিঝুম রাতে তখনই শব্দ হত ওদের দরজায়। বোধিকাকা খুব নরম গলায় বলত মা, কেঁদো না। ঘরে শোবে চল। মা! কেঁদো না আর। বৃতি জানলায় পর্দার আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখত। কত স্নেহ দিয়ে বোধিকাকা মাকে ধরে ঘরে নেওয়ার চেষ্টা করছে। দেখে চোখে জল এসে যেত। অথচ এই বোধিকাকাই… বৃতি ভাবতেই চাইত না কিচ্ছু ওসব। বড় হয়ে গিয়ে ওসব ছোটখাট কথা মনে রাখলে চলে? রেখে হবেই বা কি?

সামান্য মানুষের সামান্য একটা ভুল ভেবে নিলেই বরং শান্তি পাওয়া যায়। এই যে এখন মাঝরাতে যখন বাড়িটায় আর কোনো শব্দ নেই, মিস্তিরিদের অপেক্ষায় আছে দরজা জানলা রেলিংগুলো, তখন বৃতি ভাবে কে জানে বোধিকাকা এখন কোথায় কোন ঘরে মাকে শুইয়ে দরজা আবজে দিয়ে পাহারা দেয়! কে জানে আর কোনোদিন দেখতে পাবে কিনা মানুষটাকে! কেউ শুনলে ছি ছি করবে জানে বৃতি। কারণ ঐ লোকটাই তো তার কিশোরীবেলায় তাকে হঠাৎ জাপটে ধরে চুমু খেয়েছিল। কী বিশ্রী সে স্বাদ! কড়া তামাকের গন্ধ! ভাবলেও গা ঘুলিয়ে ওঠে। খুব রেগে উঠেছিল বৃতি। না অবাক হয়নি। কিশোরী হলেও সে তো ন্যাকা নয়! এসব শরীর প্রবৃত্তি সে দিব্যি জানত। কিন্তু জানে মানেই মানবে তেমন তো না। তাছাড়া বিশবছরের বড় লোকটা হঠাৎ ফ্রক পরা একটা বাচ্চা মেয়েকে জাপটে ধরে চুমু খাবে কেন? ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিল বৃতি। বোধিকাকাও কেমন হকচকিয়ে মাথা নিচু করে চলে গেছিল ঘর থেকে। আর কখনও সে বৃতির দিকে তাকায়নি। সে সময় কাকার বয়স বোধহয় তিরিশের কোঠায়। বৃতি তখন তেরো চোদ্দর হবে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বৃতি খোঁজার চেষ্টা করে সেই ঘেন্না আর বিরক্তিটাকে। পায় না। এত দিন অবধি জারিয়ে রাখার মত অভিঘাত ঐ বিশ সেকেন্ডের গা জোয়ারিতে ছিল না। সময়ের সঙ্গে

অনেক জল গড়িয়ে গেছে। কয়েক বছর পর সে নিজেও তিরিশে পৌছবে। বোধিকাকা নামটার সঙ্গে এখন কেবল জড়িয়ে আছে একটা বিচ্ছিরি চুমুর অভিজ্ঞতা। বৃতি জানে এই বাড়িটায় নতুন লোকজন আসবে। নতুন ঘটনা, আওয়াজ, বন্ধুত্ব, রাগ, হিংসা এসবের মধ্যে বিড়েঠাকমা আর কাকির যাবতীয় স্মৃতি চাপা পড়ে যাবে। শুধু সেদিনের সেই মলেস্টেশনের ঘটনাটুকু বোধিকাকাকে ওর স্মৃতিতে আটকে রাখবে চিরকাল।

 
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *