চশমা
মহুয়া ব্যানার্জী
আজ খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেছে পরিতোষের।
শরীরের ভেতর আনচান ভাব গতকাল সন্ধে থেকেই। বালিশের পাশ থেকে ডাঁটি ভাঙা চশমাটা পরে নিতেই শান্তি!
বছর আটান্নর পরিতোষ বোস বরাবরই সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী। নিজের আবাসন ছাড়াও অফিস, পার্টি সব জায়গাতেই তিনি থাকেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। আজকাল আবার সমাজসেবী হিসেবেও বেশ নামডাক হয়েছে। বাবার অবর্তমানে তাঁর তৈরি দু’টি অনাথ আশ্রম আর এন. জিওর ভার এখন পরিতোষের। সবাই বলে যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান।
এই সবই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন পরিতোষ। সেই উপভোগের মাত্রা প্রায়শই মাত্রাছাড়া হয়ে যায়। তখন উষ্ণ পাণীয় তার শিরায় রক্তের বদলে ছুটে চলে। সেসব অবশ্য খুব গোপন বন্ধুমহল ছাড়া কেউ জানে না। বাইরের নিপাট রূপটা মেয়েদের হোমে তার পনেরোই আগস্টের বক্তৃতার মতই সহজ। এ সব অনুষ্ঠানে তার সাদা পাজামা পাঞ্জাবী ভীষণ ঝকঝকে নিদাগ থাকে। জয়িতা এই নিয়ে খুব হাসাহাসি করে। জয়িতা তার স্পেশাল নারী। অকাল বিধবা জয়িতাকে শিশুকন্যা সহ তার স্বর্গত পিতৃদেব আশুতোষ বোসের হোমের মালকিন করে দিয়েছে পরিতোষ। বিনিময়ে গোপন সুখ ছাড়া আর কিছুই চাহিদা ছিল না। জয়িতা অবশ্য সব চাহিদা মিটিয়ে দেয় আবার উপরিও দেয়। উপরি বলতে ওই হোমের শিশুদের আদর করা। পরিতোষ শিশুদের ভীষণ ভালোবাসেন। কোলে বসিয়ে আদর করতে করতে এক স্বর্গীয় সুখানুভূতি হয়। তবুও শিশুরা তাকে কেন যে ভয় পায়! গতকাল অবশ্য পরিতোষ সেখানে যায়নি।
পরিতোষ গিয়েছিল কেষ্টপুরে। তার পৈতৃক ভিটেয়। প্রোমোটারকে ডেকেছিল।
আশ্চর্য মানুষ ছিল তার বাবা। সারাজীবন সততার প্রতিমূর্তি হয়ে কাটিয়ে দিল। এই এতবড় প্রপার্টি বেচে দিলে কত লাভ। কিছুতেই সে কথা বোঝাতে পারেনি।
কোলকাতায় পরিতোষের ফ্ল্যাটে মাঝে মাঝে যেত কেবল বৌমা অহনা ও নাতির টানে। শেষ কয়েক বছর তো তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল!
বন্ধ ঘরগুলো খুলে দিতেই ভ্যাপসা গন্ধটা ধীরে ধীরে উবে গেল। প্রোমোটারের আসতে কয়েকঘন্টা দেরী আছে। পরিতোষ এ ঘর ও ঘর দেখতে দেখতে বাবার পড়ার ঘরে এল। সবকিছুই পরিপাটি করে গোছানো। পড়ার টেবিলের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। বাবার চশমা! কাছে গিয়ে একটু ঝুঁকে অপলক দেখতে লাগল। ডানদিকের ডাঁটিটা বেঁকে গেছে। কাচে চিড়।
এটা রেখে দিয়েছিল বাবা! তিন বছর আগের সেই মুহূর্তে পৌঁছে গেল পরিতোষ…
– কাকু, লাগছে। ছাড়ো আমায়। নাহলে দাদুকে বলে দেব। বারো বছরের তিন্নি কাঁদো কাঁদো স্বরে পরিতোষের কবল থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। এই ঘরে সে রোজ পড়তে আসে দাদুর কাছে। আজও এসেছিল। তার মত আরও অনেক ছেলেমেয়ে আসে এখানে। তাদের বস্তিটা খুব কাছে। আজ এসে দেখে দাদু নেই। কাকু তারপর থেকে এরকম করছে তার সঙ্গে। সে ব্যথা পেয়ে জোরে কেঁদে ওঠে। দরজা ঠেলে স্তম্ভিত হয়ে যান আশুতোষ বাবু।
– বাবা, পুলিশে খবর দিও না। আমার ভুল হয়ে গেছে। বলতে বলতেই এক ধাক্কায় বাবাকে সরিয়ে পালাতে গিয়েছিল পরিতোষ। চশমাটা তখনই ছিটকে পড়ে। তিন্নি ভয়ে পালাতে গিয়ে দোতলার সিঁড়ি থেকে নিচে পড়ে। তিন্নির মৃত্যু পরিতোষকে নিশ্চিন্ত করে। আশুতোষ বাবু এই ট্রমায় শয্যাগত হয়ে পড়েন। সেই দিন পরিতোষ নিজের মনের যে অন্ধকার দিককে প্রকট হতে দেখেছে, সেই আঁধারে সম্পূর্ণ ডুবে গেল সে…
কলিং বেলের শব্দে সম্বিত ফিরল পরিতোষের। টেবিল থেকে চশমাটা খেয়াল বশত পরে নিল। দেওয়ালের আয়নায় চোখ পড়তেই চমকে গেল। চশমার ভেতর দিয়ে তার ফর্সা চেহারাটা কুচকুচে কালো এক হিংস্র শয়তানের মত দেখাচ্ছে! গায়ে কুৎসিত পোকা কিলবিল করছে। লকলকে জিভে লোভের লাল ঝরছে।
বেডরুমের বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে ভাঙচুর আর চিৎকার ভেসে আসছে। অহনা মনোবিদকে ফোন করে দ্বিতীয় অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েই ফেলল।

ভীষণ বাস্তববাদী টানটান গল্প। একটি অনুগল্পের মধ্যে এরকম বিস্তৃত প্লটকে স্হাপন করা যথেষ্ট স্কিলের দাবী রাখে। এককথায় একটি অনবদ্য অনুগল্প।