micro-story-doler-diney

দোলের দিনে
মধুমিতা ভট্টাচার্য


রঙফাগুনের মৃদু সকালটি আজ ‘ওরে গৃহবাসী, গানের সুরে আবীরময়। স্থল-জল-বনতলের গালে বাসন্তী রোদের কবোষ্ণ ছোঁওয়া। উদ্বেল আপামর কিশোর-কিশোরীর হৃদয়। গৃহবাসীও আজ উতলা-বিবাগী।আম্রকুঞ্জে সুরের আবীর উড়ছে। অনুষ্ঠানান্তে রঙিনফাগে হোলিখেলা হবে। পলাশের সাজে চলবে নাচে-গানে বসন্তোৎসব।   

মনামীর ঘড়িতে এখন সকাল দশটা। হস্টেল ফাঁকা, সবাই শালবীথি ছুঁয়ে গৌড়প্রাঙ্গনের দিকে গেছে। উদাসী বাতাসে সূক্ষ্ম গেরুয়া ধুলোর ফাগ উড়ছে। মনামী-ই একমাত্র, যে এখনও ঘরে। অলসভঙ্গীতে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে রাস্তায় চলমান লোকজন দেখছে। মনখারাপ, ভীষণ মনখারাপ। খোলা জানলার আদুরী আলোতেও আঁধার লাগছে চোখে। কিন্তু মনের গহন-তলে আঁতিপাতি করে হাতড়েও মনখারাপের সঠিক হদিস খুঁজে পাচ্ছেনা মনামী।  

  একবছর আগে মনামী তার একান্ত বন্ধু মা-কে হারিয়েছে। আগে মোবাইলে দিনের মধ্যে বার-কয়েক মা-র সঙ্গে গল্প না করলে চলত-না মনামীর। এখন এই নিঝুম হস্টেলে কে তার মনখারাপের গল্প শুনবে? বাবা চেষ্টা করেন গল্প করতে, তবে সব কথা সে-ও বাবাকে বলতে পারেনা। আর আছে কুটুপিপি। কিন্তু  বিয়ে করে পিসের সঙ্গে বিদেশে উড়ে চলে গেছে পিপি কিছুদিন আগে। তাহলে কার সঙ্গে কথা বলবে মনামী?

  তখন মনের ভেতর কে যেন ফিসফিস করে ওঠে, ‘কেন, সে আছে তো, খুবসে কানের গোড়ায় বকবক করে ওর মাথা খাবি, যেমন খেতিস কদিন আগেও’। কথাটা ভেবেই মনামী জোরগলায়, যেন নিজেকে শোনাতেই বলে ওঠে, ‘মোটেও না, একটাও কথা বলবোনা। জাহান্নমে যাক ঐ পেত্নীটার সঙ্গে। ডিয়ার-পার্কেই থাকুক গিয়ে দুজনে। ভূতে ধরুক, বাঘে খাক, যা খুশি হোক। আমার কি? ওর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই আর। চিঠি আর গিফটগুলো সব মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে আসব। একটাও কথা বলবনা, কিছুতেই না, হুঁ। প্রমিস।                            

  গৌরপ্রাঙ্গন থেকে গান ভেসে আসছে। ফুলের আগুনে এখন নীলদিগন্ত মাতোয়ারা। বনে বনে রঙিন মুকুলের সম্ভার। শুধু মনামীর মনের ভার আর সময় কাটছেনা কিছুতেই। ভেবেই পাচ্ছেনা ঠিক কি কারণে ওর মনটা এত বিষাদগ্রস্ত! তবে কি…! নাঃ ধুস, কোনও সম্ভাবনাই নেই। ভুলে গেছে ওকে, একদমই ভুলে গেছে। তাতেই ভাল আছে মনামী। দিব্যি খাচ্ছে-দাচ্ছে, হাত-পা ছড়িয়ে গল্প করছে সবার সঙ্গে। তবে?

  তবে একেবারেই যে মনে পড়ছেনা তাও নয়, এটা সে-ই একমাত্র জানে। এই ক’দিনের মধ্যে যতবার ওকে মনে পড়েছে ততবারই চোখে অভিমানের বাষ্প জমেছে। নানা অজুহাতে বন্ধুদের আড্ডা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের ঘরে বালিশে মুখ গুঁজেছে। ঘুমোয়নি রাতভর। শাসন করেছে নিজেকে।

  ‘দিদিইই, আপনার গেস্ট এসেছে, ডাকছে বাইরে’। চৌকিদার এসে মনামীর দরজার কড়া নাড়ে। ধড়মড় করে উঠে বসে ভাবে ‘এখন? কে এলো?’! চট করে একটা শাড়ি জড়িয়ে নীচে নেমে আসে। সেখানে কাউকে দেখতে না পেয়ে গেটের বাইরে আসে পায়ে পায়ে। ‘লোহার রেলিঙে হেলান দিয়ে কে ওটা? ঐ পাজি-হতভাগাটা না’! ধকধকিয়ে ওঠে বুকে। রাগ হয় তুমুল। ‘দেখো, কেমন দাঁত বের করে হাসছে! ইঃ, আমি যেন ওতেই ভুলে যাব! কক্ষনো না। আরে! এদিকেই আসছে যে। ব্যাপারটা কি’?

  -‘বেরোসনি কেন? একা কী করছিস হস্টেলে বসে? দোল খেলবিনা’?

  -‘না, খেলবোনা। তোর কি? তুই খেলগে যা তোর স্পেশাল ফ্রেন্ডের সঙ্গে’। রেগে বলে মনামী।

  আর তারপর হঠাত কী যে করল ছেলেটা! আবীরের প্যাকেটের পুরোটাই উপুড় করে দিল মনামীর মাথায়, সিঁথিতে। ধীরস্বরে বলল, ‘এইতো খেললাম। ব্যস, আমার দোলখেলা শেষ। এবার কী করবি, কর’।

  হতভম্ব মনামী তাকিয়ে থাকে ছেলেটার দিকে, যাকে এতক্ষণ মনে মনে অসংখ্য গালমন্দ করেছিল।

  ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও…’ গানের রেশ ছড়িয়ে পড়ছে মনামীর মর্মের আনাচে-কানাচে। ঝুরঝুর করে গোলাপী আবীর ঝরছে মাথা থেকে কপালে, গালে, গলায়। কপট রাগের আবডালে ভালোলাগায় গলে যেতে যেতে সেই আবীরেই কাঁপাহাতে হতভাগাটার কপালে আবীর ছোঁয়ায় মনামী। সেই দুষ্টু ছেলেটার ‘মন’।

 



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “micro-story-doler-diney

  1. খুব সুন্দর গল্প হয়েছে ।পড়ার সময় মনে হচ্ছিল যেন বসন্তেই আছি ।বোলপুরের মাঠঘাট পরিবেশটাও কেন যেন মনে পড়ছিল। হস্টেল তো ওদিকেই? এরপর পুজোর গল্প শুনবো।

  2. দোলের দিনে অনু গল্পটা পড়ে বেশ লাগলো।লেখিকা মধুমিতা ভট্টাচার্য আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সুন্দর একটা গল্পটা লিখেছেন। ওনাকে আমার অভিনন্দন জানাই।

Leave a Reply to গৌতম ভাদুড়ি Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *