micro-story-dour

দৌড়
মৌমিতা দে সেনগুপ্ত


তিনতলা থেকে লিফ্টে সটান নেমে, বড় গেটের দিকে এগিয়ে যেতেই কী কারণে রঙ্গনের চোখ তার হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটের ব্যালকনির দিকে চলে গেল। এক নিষ্পাপ ফুলের মতো ছোট্ট মেয়ে তার বাবার চলে যাওয়ার পানে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। বড্ড মায়া হল রঙ্গনের। নীচ থেকে হাত নেড়ে পাশে দাঁড়ানো ভোলার মাকে ইশারা করল জিনিকে ঘরে নিয়ে যেতে। রোজকার মতো তুলি রঙ্গনের কিঞ্চিৎ আগেই চলে গেছে অফিসে। তুলির অফিসটা একটু দূরেই, ট্রেন থেকে নেমে, দু’বার বাস পাল্টে তবে! রঙ্গনের অফিসও যে খুব কাছে তা নয়, তবে তুলির মতো এতবার যান পরিবর্তন করবার প্রয়োজন হয় না। এক শুকনো কাশিতে পেয়েছে ছোট্ট জিনিকে। ডাক্তার তাকে ডাস্ট থেকে, পলিউশন থেকে দূরে থাকবার নির্দেশ দিয়েছেন। সর্বসময় মাস্ক ব্যবহার করতে বলেছেন ছোট্ট মেয়েটাকে। এই সময়টা জিনির প্রায় দিনই কাটে অনলাইন ক্লাসে। ইদানীং শারীরিক অসুস্থতার কারণে অনলাইন ক্লাসে সে একটু অনিয়মিত। এবার দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে কাটবে তার ভোলার মায়ের সঙ্গে, ট্যাবের সঙ্গে, কখনওবা রং-পেন্সিল আঁকার খাতার সঙ্গে। সমবয়সী বন্ধু নেই, হরেক কিসমের গল্প-বলা ঠাম্মি-দিদা নেই, সর্বোপরি ব্যস্ত বাপ-মায়ের ছোট্ট জিনির জন্যে এতটুকু সময় নেই। বাড়ীতে এসেও রঙ্গন- তুলি সময় দিতে পারে না চাতক পাখির মতো বাবা-মায়ের অপেক্ষায় বসে থাকা ছোট্ট জিনিকে। ঘুরঘুর-ঘুরঘুর করে ঘুমোতে যাবার আগে পর্যন্ত তাঁদের একটু সঙ্গ পেতে। কাজের ভারে নুব্জ তাঁরা। তবু জিনি অপেক্ষা করে প্রতিটা রাত! যদি বাবা আজ এসে রূপকথার গল্প বলে, যদি মা মাথায় বিলি কাটতে কাটতে ছদ্ম উষ্মা নিয়ে বলে,” লক্ষী মেয়েরা ঘুমোতে এত রাত করে না !” স্বপ্নালু চোখে এমন অপেক্ষা বুকে নিয়ে রাতের পর রাত কাটে জিনির। বাবা-মা কি বোঝে না ছোট্ট জিনির ছোট্ট মনটাকে!

যেতে যেতে রঙ্গন ভাবল ফেরার পথে আজ নিউমার্কেটে গিয়ে মেয়ের জন্য বেশ কিছু খেলনা নিয়ে আসবে। জিনিকে আজ খুশ করে দেবে। এ প্রয়াস নূতন কিছু নয় মিঞা- বিবির। সময় দিতে না- পারা বাবা-মায়ের আকুল মন প্রায়শই এমন প্রচেষ্টা চালায় বই কি! ক্ষণিক ভালোলাগায় হয়তো ভরে যায় ছোট্ট হৃদয়টি! কিন্তু তারপর…..?

অফিসে ঢোকার পর মেইল চেক করতে গিয়ে চোখে পড়ল দশটা ত্রিশে রঙ্গনের অনসাইট কল আছে। আর এখন দশটা চল্লিশ, ”ও মাই গড! ” পড়িমরি করে কল এ জয়েন করল রঙ্গন। অফিস আওয়ার্স জুড়ে চলল একের পর এক কল, একের পর এক মিটিং। লাঞ্চ করার সময় নেই, ফোন ধরার সময় নেই, অসুস্থ মেয়েটার খোঁজ নেওয়ারও সময় নেই। কি প্রচন্ড ব্যস্ততা! দৌড়, দৌড় ……………আর দৌড়! হোম লোন শোধ করবার দৌড়, আরও বড় ফ্ল্যাট নেবার দৌড়, স্টেটাস রিফ্লেক্ট করে এমন হাইয়েন্ড কার নেবার দৌড়, ছুটিতে বন্ধুদের তাক লাগিয়ে দিতে ইউরোপ-ইউকে যাবার দৌড়। এমনতর জেট জীবনে জিনিদের মনের খবর কে রাখে! ইঁট কনক্রিটের বদ্ধ হাজার স্কয়ার ফিটে খেলনার স্তুপের মাঝে একখানি ছোট্ট হৃদয়!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *