নাসরীন জাহান
অন্ধ ছিলো সে।
প্রতিদিন প্রতিধ্বনি হত চারপাশে, প্রভাতের দরজা খুলে দাও,
এরপর চুপ। কেউ বলল,এইতো আমি এসেছি।
অন্ধ লোকটি বলল, কেন এমন বিভ্রান্ত করো? কেন বারবার ঘ্রাণ বদলাও?
অতঃপর স্তব্ধতা। ঝিল্লিমুখর দুপুর পেরিয়ে রাত, এরপর দিনরাত্রি একাকার।
অন্ধ লোকটি ধীরে ধীরে অনেক রকম ঘ্রাণ শিখে যেতে শুরু করল তখন, তখন, যখন তাকে অসহায় পেয়ে চারপাশে ছড়িয়ে থাকা কিছু অমানুষ তাকে তাকে মারতে মারতে চক্ষু তুলে নিল।
কেননা সে কিশোর বয়সে মা’র ধর্ষণ দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাদের ওপর। অনেক রকম গন্ধ ছিলো তাদের।
এরপর হাসপাতাল।
এরপর প্রতিধ্বনি, আমি আছি, তুমি
সুস্থ বোধ করছ? পুরো হাসপাতালে জুড়ে
রোগের গন্ধ। হাতে আলতো চাপ,
আমারও কিন্তু একটা পা নেই, কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি, বরং মুগ্ধ, তুমি তাদের ওপর ঝাঁপ দিয়েছিলে।
একজন মেয়ের কন্ঠ বুদবুদ হয়ে চারপাশে ঘুরতে থাকে।
এরপর সে গ্রামের বাড়ি চলে গেল,
লোকটির দাদী ছিল জন্মান্ধ। সে চক্ষুহীনভাবে রাজ্যির সংসার সামলাতো একদিকে,
অন্যদিকে অনেক রকম রঙ দেখতে পারত। সে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই তোর চোখের মধ্যে মনের বাতি জ্বালা।
মন যখন যা ভাববে চোখের পুঁতির মধ্যে বসাবি কাউকে বুঝতে দিবি না তুই অন্ধ, দেখবি তোর চলার দরজা খুলে গেছে,,,
প্রভাতের দরজা খুলে দাও, বলতে বলতে দাদি অনন্তের পথে চলে গেল।
এরপর আর সে অসহায় রইলো না।
দুর্মর জেদ আর প্রতিশোধস্পৃহা তাকে যত এলোমেলো করত, ততই সে নিজের দেখা অদ্ভুত সব রঙ বিক্রি করে করে উপার্জন করা শুরু করল।
তা থেকে নিজের খাবারের জন্য রেখে বাকি বিলিয়ে দিতে শুরু করল দেশের ক্ষুধার্ত মানুষের মধ্যে।
দিনশেষে গ্রামের বটগাছের ছায়ায় হেলান দিতো।
কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারতো না সেই মেয়ের গন্ধ, যে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলো।
ফের ফিসফিস, আমি এসেছি। আমাকে চিনতে পারছ না?
না। এই গন্ধ চিনি না।
দিঘির জল পেরিয়ে হুহু বাতাস মেঘের সাথে যখন ধাক্কা খাচ্ছিল, ফিসফিস বলে, যারা তোমার চোখ নিয়েছে, আমার গুন্ডা ভাইদের দিয়ে তাদের দোযখে পাঠিয়ে দিয়েছি, কারণ পুলিশ আমার কথা বিশ্বাস করেনি। এরপর থেকে ভাঙা পা নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে তোমার কাছে চলে এসেছি। তুমি প্রভাতের দরজা খুলে দাও, দেখো,প্রভুর আকাশ খুলে গেছে।
অন্ধ লোকটির সারা শরীরে শিহরণ খেলে যায়। তুমি?
কাঁপতে কাঁপতে বলে, তুমি গুন্ডাদের বোন?
তো? এদেশে তুমি পারতে প্রতিশোধ নিতে?
অন্ধ লোকটি কিচ্ছুক্ষণ চুপ হয়ে বলে আসলেই তুমি সেই? তোমার সেই গায়ের গন্ধ কই?
অতঃপর নিশ্চুপে ঝিঁঝি ডাকতে ডাকতে গলা ভেঙে ফেলে প্রায়,
মেয়েটি অন্ধ লোকটির গলা জড়িয়ে বলে, ওটা শহরের গন্ধ ছিলো।
তো, কী দাঁড়াল?
বুঝলাম না, কিচ্ছু দাঁড়ায়নি, বসেও নি। তুমি বলো, এদ্দিন পরে কী বুঝে?
আশ্চর্য! তুমি কী মনে করছ, আমি এমনি এমনিই তোমার সাথে যোগাযোগহীন থেকেছি? তুমি কেন ভাবলে না, আমি কোন বিপদে থাকতে পারি?
আমি বহুবার ফোন করেছি,
হয় বন্ধ পেয়েছি, নয় রিং বেজে গেছে,
আহ, কী বলি, আমি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম, একটা জটিল অপারেশন হয়েছিল, তুমি টেনশন করতে পার, তাই জানাইনি।
এবং তোমার বন্ধুদের কেউ এজন্য ফোন ধরেনি, তাইতো?
অবশ্যই। তারা জানে, তুমি আমাকে কত ভালোবাসো,
ওহ! আমি ভালোবাসি! যা হোক, তুমি
হঠাৎ হারিয়ে গেলে আমিও তোমাকে কোনভাবেই তোমার খোঁজ না পেয়ে দিনের পর দিন মনো ডাক্তারের চিকিৎসা নিয়েছি। নিজের সাথে নিজে কাউন্সিলিং করেছি, এর আগে বহুবার মনে হত, মরে যাই, আরে উদগ্রীব হয়ো না, আমি এখন ভালো আছি, তা নির্ঝর, তোমার শরীর এখন কেমন?
সোনা, অনেকটা ভালো বলেই তো তোমার কাছে ছুটে এসেছি, জানো, বেডে শুয়ে সারাক্ষণ তোমার লেখা কবিতা আউরাতাম, তোমার ব্যবহারের পারফিউম কিনে রাত রাত বালিশের সাথে সেই গন্ধ মিশিয়ে অনুভব করতাম, তোমাকে জড়িয়ে আছি।
সেই বালিশের নাম বুঝি অর্পিতা?
কী? অর্পিতা কেন হতে যাবে? তোমার মাথা কী আবার আগের মতো খারাপ হয়ে যাচ্ছে? নিশ্চয়ই এ তোমার লেখা কোন চরিত্রের নাম?
আরে না, অত বেশি বলছ কেন? তাহলে অর্পিতা ডিভোর্স দিয়ে লাত্থি দেয়ার পরেই আমার কাছে ছুটে এসেছ?
পিহু, স্টপ! ফের সেই কথা! নিশ্চয়ই আমার কোন বন্ধু আমার তোমার সম্পর্ক ভাঙার জন্য এসব বানিয়ে গল্প করেছে। আমার কান্না পাচ্ছে পিহু, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসলে আমি আমার এত বড় অসুখ লুকিয়ে দিন মাস চুপ থেকেছি,
তুমি দেখছি আগের মতোই
সন্দেহপ্রবন রয়ে গেছ।
হা হা, ঠিক ধরেছ, এসব কথা তোমার এক বন্ধু বলেছে।
ঠিক জানতাম পিহু, নিশ্চয়ই
ইকতিয়ার বলেছে, আমি আগেই বুঝতাম, সে তোমার প্রতি দুর্বল।
আমি অন্য একজনের সাথে জড়িয়েছি, এও নিশ্চয়ই বলেছে?
আশ্চর্য! এ কথা তুমিও বুঝে গেছ? সত্যিই হারামিটা এসবও বলেছে, কিন্তু আমি ওকে চিনি তোমাকেও চিনি তাই বিশ্বাস করার প্রশ্নই আসেনি,
তার মানে অর্পিতা ইকতিয়ারের দূর সম্পর্কের বোনের নাম?
আরে না! ওর আপন চাচাতো বোন, শালী একটা হারামী, পুরুষদের ঘন্টায় ঘন্টায় কেনা বেচা করতে পারে।
তোমাকে তো তিন মাসের জন্য কিনতে পেরেছিল। দারুণ কোয়ালিটি তোমার!
আহ! মাথা এলোমেলো লাগছে! পিহু, আসলে,, কার কথা বলছ?
আমি ইকতিয়ারের চাচাতো এবং দূর সম্পর্কের বোন অর্পিতার কথা বলছি, শোন, নির্ঝর,, আমি খুব ক্লান্ত বোধ করছি। ভাগ্যিস তুমি আমার জীবনে ফিরে এসেছিলে, তুমি চলে যাওয়ার পরে আমি কষ্টের চেয়ে অপমানবোধ নিয়ে দিনের পরে দিন মরেছি, আজ আমি সেই বোধ থেকে মুক্তি পেয়েছি,
বুঝলাম না, একী কোথায় যাচ্ছ?,
আমি তো ঠিকঠাক বলতেই পারিনি, যা
বলতে চাইছি,
নির্ঝর, থামো, আর বলতে গেলে আরও ঘোল পাকাবে, আসলে আমাকে বোকা ভেবে তৈরী হয়ে আসোনি, তাই মুশকিল হচ্ছে। আমি যাচ্ছি, আমার প্রচন্ড জরুরি কাজ আছে, এরমধ্যেই দেরি হয়ে গেছে,,,
পিহু,
পিহু,,,
এপাশের শব্দ ততক্ষণে গলির মোড়ে
ছায়া হয়ে গেছে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন