micro-story-epith-opith

এপিঠ-ওপিঠ
শাম্ব চ্যাটার্জী


সন্তর্পণে চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে নিল ছেলেটা। সামনের পাঁচিলটা তার ছোটখাটো চেহারার পক্ষে যথেষ্ট উঁচু। পাঁচিলের গায়ে অবশ্য অসংখ্য ফাঁকফোকর রয়েছে, তবে কোনটাই মানুষ গলে যাওয়ার পক্ষে উপযুক্ত নয়। ওপারে রেলের জমিতে জিআরপি অতন্দ্র পাহারায় থাকলেও, এদিকটাতে মানুষের যাতায়াত বেশ কম। অনেকটা পথ ঘুরে এখানে আসতে হয়েছে ছেলেটাকে। পরনের জামাপ্যান্ট বলতে যা রয়েছে, সেটা লজ্জা নিবারণের পক্ষে যৎসামান্য। সেদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ তার অন্তত নেই। পুরনো হওয়ার দরুন যে সেগুলো ছিঁড়ে যায়নি, এটুকু আন্দাজ করা মোটেই শক্ত নয়। চোখের কালশিটে দাগটা তার সাক্ষী। আকাশের গতিপ্রকৃতি দেখে তৎপরতা বাড়ে ছেলেটার। সে জানে, পাঁচিল পেরনোর সঠিক সময় এটা। পরনের কাপড়ের থেকে ওর অভিজ্ঞতার ঝুলি পোক্ত বেশী। অসময়ের বৃষ্টিতে ওপারে সব ছাউনিতে আশ্রয় নেবে, আর সেই ফাঁকে তাদের চোখ এড়িয়ে আসন্ন সন্ধ্যের অন্ধকারে কাজ হাসিল করতে হবে। মনে মনে বরুণ দেবতাকে ধন্যবাদ জানালো ছেলেটা।
ঘুরপথে এখানে আসার রাস্তায় একটা আবাসন রয়েছে। খুব সাবধানে আসতে হয়, নইলে… আজ যেমন মুহূর্তের অসতর্কতায় মারধর জুটল। বস্তাটা হাতে পাকিয়ে নিয়েই আসছিল সে। বহুদিন ধরেই আবাসনের গার্ড ব্যাটা তক্কে তক্কে ছিল। ছেলেটা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেই জায়গার মাহাত্ম্য এটা। রেল-ইয়ার্ডের পাশে পরিত্যক্ত কারখানা। সরকারী ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন বলে প্রোমোটারের দলবল লকলকে জিভ হানিয়েও থাবা গাড়তে পারেনি। তবে সিকিউরিটির অভাবে পড়ে থাকা কোম্পানির মালপত্র স্থানীয় চোরেরা সুন্দর হাতসাফাই করে। আবাসনের গার্ড ব্যাটাও ওদের বখরার শরিক। উপরি আয় আরকি। ছেলেটা মাঝে মজা লোটবার জন্য পথে কুড়িয়ে পাওয়া পাহারাদারের বাঁশিটা সঠিক সময়ে ব্যবহার করেছিল। আর যায় কোথায়! পাঁচিলের ওপার থেকে জিআরপির দলবল সার্চলাইট হেনে হাঁকডাক শুরু করতে, চুরির মাল ফেলে সব একছুট্টে পগারপার। শুধু সেই গার্ডের নজরে পড়ে যায় ছেলেটা। সেই থেকে লোকটা মুখিয়ে ছিল। আজ আসার পথে স্বপ্নের ধুলো উড়িয়ে দূরে মিলিয়ে যাওয়া স্কুলবাসের দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে, ভাবনায় বুঁদ হয়ে ছিল ও। পেছন থেকে খপ করে ধরে বেদম মার দিয়েছে বদমাশটা। কোনওমতে হাতে কামড় দিয়ে দৌড়ে পালিয়েছে সে। এত ঝক্কিঝামেলা পোহানোর একটাই কারণ, তা নাহলে আজ এই ঝামেলায় পড়তে হত না তাকে। মাসকয়েক হল স্টেশন চত্বরে পা ফেলাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। রেলের নতুন নিয়মে ঝাঁ-চকচকে প্ল্যাটফর্মে তাদের মত বিসদৃশ মানুষের প্রবেশ মানা। আগে দিব্যি বস্তা সামলে প্লাস্টিক কুড়নো যেত। এখন দেখলেই হয় জিআরপির চোখরাঙানি আর মার, নয়ত পাতাখোরের তকমা দিয়ে চালান করে দেয়—তাই এই বন্দোবস্ত।
টিকটিকির মত পাঁচিলের গা বেয়ে তরতর করে উঠে পড়ে ছেলেটা। অঝোর ধারে বৃষ্টি নেমেছে এবার। এর মধ্যেই রেল লাইনে পড়ে থাকা প্লাস্টিকগুলো জড় করে এপথেই পালাতে হবে। পাঁচিলের উপর থেকে চারপাশে চকিত নজর বুলিয়ে নেয় একবার। ময়দান সাফ। এরপর নিপুণ কায়দায় লাফ দেয়। দ্রুত হাত চালাতে শুরু করে এবারে। সংখ্যার উপরে টাকার পরিমাণ বাড়ে। ওর কাঁধে ছোট্ট ছোট্ট ভাইদুটোর গুরুদায়িত্ব। মা তো সেই কবেই… আর বাবা অন্য রাজ্যে কাজের খোঁজে গিয়ে আর ফেরেনি। সব ওই পোড়ারমুখো পেটের জন্য। খিদের থেকে বড় মারণ ভাইরাস বোধহয় পৃথিবীতে আর কিছু নেই! দুটোরই প্রতিষেধক মেলা ভার।
এর মাঝে বেখেয়ালে পা গিয়ে পড়ে লাইনের ফাঁকে। রুট রিলে কেবিনের ঘরে ঠিক সেই মুহূর্তেই… বৃষ্টি আর গোধূলির মাখামাখি রুদ্রপলাশের রঙ ভিজিয়ে দিয়ে যায় রেললাইনের পাতগুলোকে।
(সব চরিত্র ও প্রেক্ষাপট কাল্পনিক)

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *