micro-story-ghuri

ঘুড়ি
মহুয়া সমাদ্দার


–“দাদা, তোদের জীবনের সঙ্গে, এই গেঁয়ো কালচারের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করা আমাদের পক্ষে আর জাস্ট পসিবল নয়। আমি চাইনা আমার একমাত্র মেয়েকে এই এঁদো গলিতে বড় করতে। তুই আর ছোড়দা বরং আমার অংশের টাকাটা দিয়ে দে আমায়। আমি একটা ফ্ল্যাট নেব কলকাতায়। ” –কথাটা অনেক দিন ধরেই বলবো বলবো করেও বলা হয়ে ওঠেনি রথীনের। অবশেষে তার স্ত্রীর পিড়াপীড়িতে বলেই ফেলল।

রথীনের কথা শুনে চিরকালের কম কথা বলা ছোড়দা ম্লান হেসেছিল একটু। আর বড়দা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিল — “কেটে যাওয়া ঘুড়ি কি সত্যিই খুব ভাল থাকে রে রথীন! সে যে বড় একা হয়ে যায়! তবুও তুই যা চাস তাই হোক। শত হলেও তুই আমাদের ছোট ভাই।”

“কেটে যাওয়া ঘুড়ি” শব্দগুলো তারপর থেকেই কেমন যেন মাথায় গেঁথে গেছে রথীনের। সেও কী তবে কাটা ঘুড়ি হয়ে যাবে? কিন্তু ওসব দার্শনিক কথায় মন খারাপ করার মতো সময় তার মোটেও নেই। এখন তার সামনে একটাই লক্ষ্য। ভাল স্কুলে পড়িয়ে একমাত্র মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলা। আর এই কারণেই সে কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনবে। তার স্ত্রী রীতা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মেয়ে। ওর বুদ্ধিতেই চলে রথীন। এতে যে তার ভালই হয় সেটাও সে বুঝে গিয়েছে এত বছরে।

দুই বছর হল রথীন তার স্ত্রী রীতা আর মেয়েকে নিয়ে কলকাতার ফ্ল্যাটে আছে। একই বাড়িতে অনেক ঘর। অনেক লোক। কিন্তু মেয়েটার জ্বর হলেও গভীর রাতে কেউ রীতার হাত ধরে বলে না — “তুই এবার বিশ্রাম নে ছোট। আমি জাগছি।” রথীন শ্বাসকষ্টে কষ্ট পেলেও দাদাদের মতো করে কেউ বলে না – “ভোরের ঠাণ্ডা লাগিয়ে তোকে বাজারে যেতে হবে না ভাই। আমি বাজারে যাচ্ছি।” বা তার অসুস্থতায় বৌদিদের মতো কেউ তার পছন্দের খাবার রান্না করে মুখের সামনে ধরে না। কিন্তু তাতে কী! শুধু কী পাচ্ছে না সেটা ভাবলে তো আর জীবন চলবে না! কী পাচ্ছে, কতটা পাচ্ছে সেটাও তো দেখা উচিৎ! ভাবা উচিৎ! ধিতাং কলকাতার নামী স্কুলে ভর্তি হয়েছে। তার অফিসও বাড়ির খুব কাছে হওয়ায় পুরো সন্ধ্যেটাই মেয়েকে নিয়ে বসতে পারে সে। যে অংক দেখে এতদিন ধিতাং ভয়ে কাঁপতো, আজকাল সেই অংকেই সে হায়েস্ট মার্কস পায়। এও কী কিছু কম পাওয়া! তবুও বুকের মধ্যে কোথায় যেন একটা মন খারাপি হাওয়া বয়ে চলে। মাঝে মাঝেই বড় একলা লাগে নিজেকে। দাদাদের কথা, তাদের সঙ্গে এত বছর একসঙ্গে ঘরকন্নার কথা, তার বা রীতার বা ধিতাং-এর জন্মদিনে তাদের পছন্দের উপহার কিনে এনে তাদের চমকে দেওয়ার স্মৃতি – আজও তার মনকে হঠাৎ হঠাৎ-ই বর্ষার মেঘের মতো ভিজিয়ে দেয়। কখনও কখনও মনে হয় সব ছেড়েছুড়ে আবারও গ্রামের বাড়িতে, দাদাদের কাছে ফিরে চলে যেতে। কিন্তু সেটা যে আর হয় না, ভাল মতোই বোঝে সে।

আজ বিশ্বকর্মা পুজো। ফ্ল্যাটের ছাদে ধিতাং-এর সঙ্গে রথীন ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। হঠাৎ ধিতাং-এর প্রিয় লাল-হলুদ ঘুড়িটা মাঝ আকাশে ভোঁকাট্টা হয়ে গেল। ধিতাং কাঁদছে।

–“বাবা, আমার ঘুড়িটা যেখান থেকে পারো এনে দাও।”

রথীন মেয়ের মাথায় হাত রাখল। — “মা রে, কেটে যাওয়া ঘুড়ি কি আর ফেরানো যায়! ও যে হারিয়ে গেছে অনেক অনেক দূরে। গোটা আকাশে ও এখন একা। ভীষণ একা। ওর আর না আছে কোনও আশ্রয়, না আছে নিজের কেউ! ! ”

অবাক ধিতাং কী বুঝল কে জানে! গোল গোল চোখে কান্না থামিয়ে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। তার লাল-হলুদ ঘুড়িটার জন্যে বাবাও কাঁদছে কেন এভাবে!


এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *