প্রতিমা রায়
নাসরিনের স্বপ্নগুলো কেউ পড়েনি। স্বপ্ন পড়া যায় না, দেখা যায় তাই হয়তো।
নাসরিন ছিল অক্ষর শ্রমিক। স্বপ্ন দেখত- তার মনের স্বপ্নগুলোও একদিন অক্ষর হয়ে উঠবে। দেশে বিদেশে সে অক্ষর ছড়িয়ে পড়বে। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাতো তার অক্ষরের সঙ্গে।
একদিন নাসরিনের বাড়ি বদল হলো। নতুন বাড়িতে জানলা দরজা সব আছে, সেখান দিয়ে আলো হাওয়াও আসে, শুধু অক্ষর আসে না। অক্ষরের ঢোকা বারণ নেই, তবে অবারিত দ্বারও নয়। নাসরিনের বেশ কষ্ট হলো, অক্ষর ছাড়া এ বাড়িতে তার দিন কাটবে কিভাবে? ঈশ্বরকে ডাকে নাসরিন।
ঈশ্বর আসে। বলে- এ বাড়ি তোমার নাসরিন। তুমি তোমার মতো করে সাজাও। ঠিক যেমনটি চাও। তারপর আবার সাজাও ভাঙো গড়ো। তারপরেও যদি মনে হয় তখন না হ্য় অক্ষরকে,,,।
নাসরিন ঈশ্বরের কথা শোনে। তারপর বাড়ি সাজানোতে মন দেয়। বাড়ি মানে ঘর, যেখানে মন মিশে থাকে, অন্ততঃ নাসরিন তাই ভাবে। সে মন দিয়ে ফুলের জায়গায় ফুল, ফলের জায়গায় ফল, পাতার জায়গায় পাতা বসিয়ে বাড়ি সাজায়। ঋতুরা একে একে এসে বলে- কিগো মেয়ে আমারাও থাকতে চাই তোমার সঙ্গে। আমাদের রঙ রূপ রস গন্ধ তোমাকে দিতে চাই যে, আমাদের ছাড়া তুমি কেমন করে সম্পূর্ণ হবে? নাসরিন বলে- এই আঁচল পাতলাম, তবে তোমারও এসো।
ঈশ্বর আড়ালে মুচকি হাসেন।
ঈশ্বরের বাগান ফুলে ফলে ভরে ওঠে, গাছে গাছে পাখি ডাকতে থাকে, প্রজাপতি মৌমাছিরা গুঞ্জন করে গেয়ে ওঠে। ঈশ্বর মৃদু হেসে বলে- এসো নাসরিন, আমারা দুজনে সুখ সুখ খেলা খেলি। এ সুখ ছাড়া জীবন বৃথা যে। নাসরিন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।
নাসরিন মনে মনে গুনগুন গান করে, সারাদিন বাড়ি সাজায়, স্বাচ্ছন্দ্যের গুণগান করে, ইচ্ছে হলেই সুখ সুখ খেলা করে। অক্ষর দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকে, সব দেখে। কিছু বলে না। যেচে বলা তার স্বভাব নয়।
একদিন নাসরিন বাড়ি পরিস্কার করে, দেয়ালে ঝুল ঝেড়ে, মেঝে ঝাঁট দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে। ঈশ্বর কানে কানে এসে বলে- বাড়ি সাজাও নাসরিন, বাড়ি সাজাও। এ বাড়ি তোমার আমার যে।
নাসরিন উঠে পড়ে। হাতে পায়ে ব্যথা নিয়ে মেঝেতে ঘড়া ঘড়া জল ঢালে, উঠোন নিকোয়, দিনরাত নোংরা পরিস্কার করে। তা করতে গিয়ে এবার পা স্লিপ করে মেঝেতে পড়ে যায়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঈশ্বরকে ডাকে- এবার কি হবে প্রভু?
ঈশ্বর সামনে এসে দাঁড়ায়।
তাকে দেখে চমকে ওঠে নাসরিন। এ কী! তোমার সর্বাঙ্গ এমন কালো কেন?
ঈশ্বর নীরব। কেবল ষড়মুখী সর্প হয়ে তার মাথা দুলতে থাকে। নাসরিন ভালো করে খেয়াল করে মাথাগুলোর মধ্যে নাম লেখা- কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য। এই সর্পটা বাড়িটাকে ঘিরে রয়েছে।
ভয়ে নাসরিন চোখ বন্ধ করে।
অন্ধকার এসে তাকে ঢেকে দেয়, নাসরিন আরো ভয় পায়, চিৎকার করে ডাকে- আলো কোথায়? আলো? হাতড়াতে থাকে।
দেখে- অন্ধকারের ভেতর সাদা সুতোর মতো একটা জ্যোতি ঝুলে রয়েছে। তাই আঁকড়ে ধরে চোখ খুলে আর অবাক হয়ে যায়- অক্ষর বাঁধানো দু’ মলাটের জামা গায়ে দাঁড়িয়ে!
নাসরিনের চোখ ভিজে যায়। এতদিন পর অস্ফুটে ডাকে- অ,,ক্ষ,,র!
অক্ষর হাত বাড়ায়। তার হাতে এক মশাল। সে মশাল তুলে ধরতেই, চারদিক থেকে মৃদুস্বরে আওয়াজ ওঠে- তমসো মা জ্যোতির্গময়,,,।’
ঈশ্বর আবার হাসেন।
কিন্তু এ হাসি ভারি শান্ত সমাহিত।।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
খুব সুন্দর।
ম্যাডাম, খুব ভালো লিখেছেন, আসলে, আতিশয্য,, এর তাড়নায় জীবনের কত মূল্যবান স্বপ্ন যে কোথায় হারিয়ে যায়…