অনিন্দিতা গোস্বামী
সে অনেককাল আগেকার কথা। এক গাঁয়ে এক রাজা ছিল। রাজা না বলে তাকে জনপদের মোড়ল বলাই শ্রেয়। তার নাম ধরা যাক ‘ক’। যদিও বাস্তবে থুড়ি ইতিহাসে তার নাম ছিল অন্য। কিন্তু আমরা বাংলা মাধ্যমের মেয়েরা এক্স পর্যন্ত পৌঁছনোর আগে সব অংক ‘ক’ ধরেই করে থাকি। তো তার একটা ফুটফুটে মেয়ে হলো। কুল জ্যোতিষী ঠিকুজি কুষ্টি গননা করে নিদান দিলেন সর্ব গুণান্বিতা এই মেয়ে হবে জনম দুখিনি। এই কথা শুনে রাজা মশাই রেগে আগুন। একে মেয়ে তায় আবার দুখিনি! রাজার মেয়ে আবার দুখিনি হয় নাকি! ভুরু কুঁচকে তাকালেন রানির দিকে। এই মেয়ে তার ঔরস জাত তো! অপমানে রানি কক্ষত্যাগ করলে রাজামশাই তৎপর হলেন তার মান ভাঙ্গিয়ে দ্বিতীয় সন্তানের আগমন সুনিশ্চিত করতে। তবে অচিরেই সেই মেয়ে কিন্তু মন জয় করে নিল সবার। সেই মেয়ে হাঁটলে নুপুরের শব্দ হয় ঝমঝম। হাসলে কলকল করে নদী। পলক ফেলেলে রাতের আকাশে মিটমিট করে তারা। রাজামশাই মেয়ের সখী নিয়োগ করলেন একশত। এখন এই সংখ্যাটা দশও হতে পারে। কিন্তু শিল্পের শর্ত মেনে আমরা ধরবো একশই। কারণ এক্সাজারেশন ছাড়া গল্প হয় না। এ একেবারে কঠোর সত্য। সে মেয়ে ঘোরে ফেরে গান গায়। সখীদের সঙ্গে ঘাটে জল আনতে যায়। জলতলে গা ভাসিয়ে জলপিপির মতো ছুটে বেড়ায় ইতিউতি। আর মুখে গান বাঁধে আর সেই গান গুনগুন করে আনমনে।
পাশের জনপদের দলনেতার পালিত পুত্র, পদাবলির স্বার্থে আমরা তার না হয় নাম দিলাম কানু। সবটাই এবস্ট্রাকট হলে চলে না। কোথাও কিছু মিলের ধরতাই লাগে। সে ছোকরা-ও বহু গুণের অধিকারী। জ্ঞান, মেধা,শৌর্যবীর্য। এলাকার সকলের নয়নের মণি। তার কানেও পৌঁছালো কন্যার গুণের কথা। তা কানুর বন্ধু বান্ধব সব এক একটা মস্ত কবি। আর কানুর বাঁশির সুরে তো মাতোয়ারা সকলে। তাদেরও ওপর দিয়ে ছুটছে কিনা কন্যের পদ! দেহি পদপল্লব মুদারম। আরে ছোট, ছোট। তিনি কানু। তার আবার দেরি লাগে নাকি সিন্ধান্ত নিতে। তিনিই জয়দেবকে দোটানায় ফেলেছিলেন। তো দেখা হয়ে গেলো। আর দেখা মাত্র এক্কেবারে ফল ইন লভ। উথাল পাথাল ঢেউ মেঘনার জলে। ওটা মেঘনা না যমুনা এই নিয়ে কনফিউশান আছে। অনেকদিন আগের কথা তো। ব্যাস কন্যের পদরচনার গতি দ্বিগুণ। ভলকে ভলকে নিরবচ্ছিন্ন স্রোতের মতো কথা আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে কানুর বাঁশির সুর। বাপরে বাপ। পুরো এলাকা মেতে উঠলো নেশাগ্রস্তের মতো।
কিন্তু কন্যে তো প্রাসাদে বন্দী। তার দৌড় ওই খিরকি থেকে সিংহ দুয়ার। ফলে মহল্লায় মহল্লায় সেই গান গেয়ে বেড়াতে লাগলো কানুর কবি বন্ধুর দল। আর জ্যান্ত কন্যে আরাধিকার মিথ হয়ে আটকে রইলো পদের মধ্যে। সে যে একটা সত্যি মানুষ, আর এই অসংখ্য পদ যে তারই সৃষ্টি একথা কেউই আর জানলো না মহল্লার বাইরে। একদিন কানুও চলে গেলো। কন্যের গানও চলে গেলো সেই ছোট্ট রাজবাড়ির চৌহদ্দি ছেড়ে। কন্যেও অন্যত্র বিয়ে সাদি করে জ্যোতিষীর কথা মত জনমদুখিনি হয়ে জানলার শিকে গাল ঠেকিয়ে বসে রইলো চুপ করে। মরণশীল আর পচনশীলতার ধর্ম মেনে একদিন পঞ্চভূতে বিলীন হলো তা-ও।
এইখানেই গল্পটা শেষ হতে পারতো, কিন্তু হলো না। কারণ ওই সেই সাইকেল। একচাকা, দুচাকা, তিনচাকাতে না গিয়ে অদৃশ্য ঘূর্ণির পাকে দুনিয়া ঘুরলো বনবন করে। রঞ্জনরশ্মির তীক্ষ্ণ অভিঘাত তুলে আনলো কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এক বালিকার মস্তিষ্কের ছবি। যার প্রতি ছত্রে লেখা ছিল সন্ধ্যাভাষার সাংগীতিক সংকেত। কানু যার হাত ধরেছিল। সংগত করেছিল। তাই তা হয়েছিল অবিস্মরণীয়। কিন্তু মিথের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া সেই কন্যেকে উদ্ধার করেছিল যে তার নাম রঞ্জন। চলো দুনিয়ার পাঠকের মুন্ডুমাথা গুলিয়ে দিয়ে তাকেই আজ কানু বলে ডাকি। তার সঙ্গে কন্যের কোনো দিন দেখা না হলেই বা কী, কথা না হলেই বা কী। রশ্মি নিজে তো অদৃশ্যই। সত্যকে দৃশ্যমান করাই কেবলমাত্র তার কাজ। আর কিছু না।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন