micro-story-jijibisha

জিজীবিষা
অমিতা মজুমদার


মাঘ মাসের শেষ বিকেলের মরা রোদে বসে হাতের আন্দাজে উল বুনছিল প্রতিভাদেবী। ছোটো করে কাটা রুপালি চুলের উপরে সে আলো পড়ে চুলগুলিকে আরও রুপালি করে তুলছিল। ছোটোখাটো গড়নের প্রতিভাদেবীকে দেখে দূর থেকে আন্দাজ করা যায় না তার বয়স কত। কাছে এলে মনে হবে সত্তর পেরিয়েছে হয়তো। তা কিন্তু নয়, হাতের কর গুণে উনি বলে দিতে পারবেন যে বছর ভারত পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে তার পনেরো বছর আগে তিনি বিধবা হয়েছেন। বিয়ে শ্বশুরবাড়ি এসব তিনি বোঝেন না কেবল বৈধব্যটা বোঝেন। বাবার মতো বড়ো একজন লোকের সামনে তাকে লম্বা ঘোমটা দিয়ে আনা হয়েছিল ঝাপসা ঝাপসা কেবল সেটুকুই মনে আছে। লোকটা চলে গিয়েছিল পরের দিন আর আসেনি। তখন তার পুতুল খেলা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। তারপর একদিন কী হলো, ঠাকুমা জোর করে ঘাটে নিয়ে কাপড়কাচা সোডা দিয়ে মাথার চুল ঘসে ঘসে ধুয়ে দিল, হাতের সাদা চুড়ি একটা পাথর দিয়ে ভেঙে দিল। পরে নাপিত বউ এসে লম্বা চুল কেটে ছোটো করে দিলো। ঠাকুমা বললো এখন থেকে তুমি আমার সাথে খাবে। মা সহ বাড়ির অন্যরা যা খাবে তা তোমার খাওয়া চলবে না। আমি যেদিন যেদিন উপোস করব সেদিন নির্জলা উপোস করতে হবে তোমাকে। তুমি এখন থেকে বিধবা। বিধবা হবার নিয়ম-কানুন পালন করতে করতেই বিধবা শব্দটা মাথায় গেঁথে গেছে। তাই সেদিনটা আর ভোলা হয়নি। এখন কাঁটায় কাঁটায় নব্বই। সারা জীবনের বৈধব্যের কৃচ্ছসাধন আর কায়িক শ্রম সহ সন্তান ধারণ না করায় এখনো রীতিমতো নিজের কাজ নিজে করে খেতে পারেন। বাপের বাড়ি স্বচ্ছল পরিবার বলে অনেক বাল্যবিধবার মতো তার অবস্থা ততটা করুণ নয়, তবুও আত্মসম্মান নিয়ে আর একাকীত্ব থেকে বাঁচার জন্য দুটো কাজ করতেন তিনি। এক বাগান আর ঝরা পাতা কুড়িয়ে জড়ো করা। বাড়ির আনাচে কানাচে শুধু গাছ লাগাতেন, ফুল, ফল, সবজির বাগান করতেন। প্রতিটা গাছের গোড়া খুব যত্ন করে পরিষ্কার করতেন। কোথাও একটা ঝরাপাতা পড়ে থাকত না। বাড়ির ছোটরা হাসাহাসি করত তার এই বাতিক দেখে। কিন্তু প্রতিভাদেবী কাউকে বলতে পারত না সেই শিশুকাল থেকে তার কথা বলার সাথি এই গাছ-গাছালি। ছোট্ট বিধবা মেয়েটিকে সবার আড়ালে থাকতে হতো, বাড়ির অন্য বাচ্চারা যখন খেলা করত, স্কুলে যেত তখন প্রতিভাকে মুখ লুকিয়ে ঘরের কোণে চুপটি করে থাকতে হতো। তারপর একসময় এই গাছেদের সাথে কথা বলার খেলাটা একা একাই শিখে ফেলে। এখনতো সে গাছেদের কথাও বুঝতে পারে।

এহেন প্রতিভাদেবীর এখন নগরের এক প্রবীণ নিবাসে ঠাঁই মিলেছে। বাবার মৃত্যুর পরে ভাইদের পরিবারেও ভালোই ছিল, কিন্তু সময়ের চাকা ঘুরে ঘুরে অশীতিপর প্রতিভাদেবীর দেখভালের দায়িত্ব পড়েছে একবিংশ শতাব্দীর অত্যাধুনিক জীবনে অভ্যস্ত উত্তর প্রজন্মের উপরে। সম্পর্কের গাঁটছড়াটা যাদের কাছে খুবই পলকা।

জীবন জীবিকার দৌড়ে তাদের ছুটতে হয় লাগামহীনভাবে। গ্রাম থেকে শিকড়চ্যুত হয়েছে অনেক আগেই। প্রায় এক শতাব্দী পেছনের একজন মানুষের সাথে তারাও তাল মিলিয়ে চলতে পারে না, সে মানুষটিও তার অস্থি মজ্জায় মিশে যাওয়া সংস্কার, বিশ্বাস বিসর্জন দিয়ে নতুনের আহ্বানে ছুটতে পারে না। তাই অবশ্যম্ভাবী সংঘাত এড়াতে এই ব্যবস্থার চেয়ে আর ভালো কিছু হতো না। সবটাই বুঝতে পারে প্রতিভাদেবী। মনে মনে স্রষ্টার কাছে অনুযোগ করে এত দীর্ঘ জীবন তার কেন হলো? যার পুরোটাই শূন্যতার নামান্তর।

এখানে আসার পরে তার জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন এসেছে। সে ভালো উল বুনতে পারে, নার্সারি করতে পারে এটা জেনে এখানকার কর্তৃপক্ষ তাকে কাজ দিয়েছে। সে ফুল-ফলের গাছের চারা করে যাতে আজ আর তার চোখের দরকার পড়ে না, অভিজ্ঞতা থেকেই করতে পারে। সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়। ছোটোদের উলের পোশাক, মোজা, টুপি বানিয়ে দেয় সেগুলোও দুস্থ শিশুদের দেওয়া হয়।

প্রতিভাদেবীর আজকাল নিজেকে কেমন মানুষ মনে হতে শুরু করেছে,একটা সুপ্ত বাসনাও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। দীর্ঘ জীবন নিয়ে আফসোস হয় না। মনে হয় আরও কিছুদিন বেঁচে থাকি।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *