micro-story-joibik

জৈবিক
কাকলি দেবনাথ


স্কাইক্র্যাপারের চোদ্দতলার ব্যালকোণি থেকে নীচের দিকে তাকালেন রুদ্র সেন। কয়েক সেকেন্ড। তারপরই দৃষ্টি চলে গেল আকাশের দিকে। নীল আকাশের বুকে সাদা পাল তোলা নৌকার মত মেঘপুঞ্জ। তন্ময় হয়ে দেখছেন রুদ্র সেন। তিনি যে কাজই করেন খুব মন দিয়ে আস্তে ধীরে করেন। অথচ সেই ব্যক্তিগত মুহূর্তটুকু, যখন সকলে আয়েসে উপভোগ করতে চায় তখনই তাঁর যত তাড়াহুড়ো। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে সংবরণ করতে পারেন না। সামনে এলেই ঝাঁপিয়ে পড়েন বন্য অশিক্ষিতের মত।
দরজার বাইরে কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। রুদ্র সেন সতর্ক হলেন। কেবিনের অ্যাটাচ টয়লেটের আয়নায় নিজেকে একবার ভাল করে দেখে এলেন। নিখুঁত সেভ করা মুখমন্ডল। নিভাঁজ পরিষ্কার শার্ট-প্যান্ট। মাথার চুল থেকে পায়ের জুতো সবকিছুতেই আভিজাত্যের চাকচিক্য। কথা বলেন মেপে। প্রতিটি শব্দে বুদ্ধিমত্তা আর আধুনিকতার ছোঁয়া।
এইসব গুণগুলিই রুদ্র সেনকে অন্য সব বিজনেসম্যানদের থেকে আলাদা করেছে। অফিসিয়াল পার্টিতে সকলে তাঁর ড্রেস সেন্স আর এটিকেটকে ঈর্ষার চোখে দেখে।
দরজার বাইরে ছেলেমেয়েগুলো একে অপরকে ঠেলাঠেলি করছে। শেষ পর্যন্ত নিশা এগিয়ে এল। অফিসের সবচেয়ে স্মার্ট আর সুন্দরী মেয়ে।
“মে আই কাম ইন স্যার?”
একবার নিজের কেবিনটায় চোখ বুলিয়ে নিলেন রুদ্র সেন।
কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললেন, “ইয়েস,কাম ইন।“
ছেলেমেয়েগুলো দল বেঁধে ঢুকল।
রুদ্র সেন মুখে কর্পোরেট হাসি ঝুলিয়ে তাদের দিকে তাকালেন। “হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?”
“স্যার, এই উইকে আমাদের কোম্পানির ফাউন্ডেশন ডে। ওই দিন আমরা সেলিব্রেট করতে চাই।“
নিশা আদুরে কন্ঠে বলল, “এবার কিন্তু আপনাকে থাকতেই হবে স্যার। আমরা খুব সিম্পল মেনু রেখেছি। বাসমতী চালের গরম ভাত … আর …”
রুদ্রসেনের চোখ দুটো দপ করে জ্বলে উঠল। অপলক দৃষ্টিতে নিশার দুই ঠোঁটে গরম ভাতের উষ্ণতা খুঁজছেন।
বসের ওই রূপ দেখে, ভয় পেয়ে গেছে ছেলেমেয়েগুলো। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছে কেবিন থেকে।


দুই


এখন গভীর রাত। অফিসের পিওনটা কেবিনের বাইরে টুলে বসে ঝিমোচ্ছে। নিজের চেয়ারে মাথা নীচু করে বসে আছেন রুদ্র সেন। কেন? কেন তিনি আজও ভুলতে পারেন না? অতীতের কত কিছুই তো বদলে ফেলেছেন তিনি। স্কুলের গন্ডী পার না করা গ্রাম্য হাভাতে ছেলেটা এখন গড়গড় করে ইংরেজীতে কথা বলে। কেতা দুরস্ত স্টাইল স্টেটমেন্টে বলিউডের নায়কদের সঙ্গে পাল্লা দেয়। এমন কি নিজের নামটাও পালটে ফেলেছেন। শুধু ওই একটা ক্ষেত্রে…
রুদ্র সেন ব্যালকোণিতে এসে দাঁড়ালেন। এত উঁচু থেকে নীচের দিকে তাকাতে ভয় হয়। তবুও তাকালেন …
“মা, কী সুন্দর গরম ভাতের গন্ধ বেরিয়েছে। দাওনা মা। খুব খিদে পেয়েছে।“
“কী বলছিস তুই শিবু! এই সবে ভাতের হাঁড়ি নামিয়েছি। বাবুরা কেউ খায়নি এখনও।“
“ওরা তো কেউ আজ বাড়িতে নেই। ওমা ,দাওনা। রোজই তো হাঁড়ি কাঁচিয়ে ঠান্ডা ভাত দাও। কতদিন গরম ভাত খাইনি। আমি চটপট খেয়ে ফেলব। কেউ টের পাবে না।“
“তাড়াতাড়ি খেয়ে নিবি কিন্তু।“
ছেলেটা হাপুস হুপুস করে গরম গরম ভাত মুখে পুরছে আর দরজার দিকে তাকাচ্ছে। হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে বুড়িটা।
“এত বড় আস্পর্ধা ! আমার নাতি নাতনীরা এখনও খায়নি আর এই হাভাতেটাকে হাঁড়ির প্রথম ভাত তুলে দিলি তুই! দাঁড়া খাওয়াচ্ছি তোর ছেলেকে আজ।“ বলেই শিবুর গলা টিপে ধরেছে বুড়ি।
ছেলেটার মা কাঁদছে, হাতে পায়ে ধরছে বুড়ির …
বুড়ি এমন জোরে গলা টিপে ধরেছে যে ছেলেটা ভাত গিলতে পারছে না। কিন্তু এত স্বাদের ভাত ফেলতেও ইচ্ছে করছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে … নিঃশ্বাস নিতে পারছে না ছেলেটা …সব অন্ধকার হয়ে আসছে …
আজও গরম ভাতের গন্ধে ফেলে আসা মুহূর্তরা ছুটে আসে। রুদ্র সেন হয়ে যায় হাভাতে শিবু।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

3 thoughts on “micro-story-joibik

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *