শফিক হাসান
জীবন যে লক্কড়ঝক্কড় ৪৯ নম্বর বাসের মতো- বিষয়টা মহিবুল আবিষ্কার করে অনেক পরে। তদ্দিনে বেজোড় সংখ্যার ৪৯ নম্বর বাসের কন্ডাকটর হিসেবে অনেক বছর কাটিয়ে দিয়েছে। জীবনটাও কি তবে বেজোড় সংখ্যার মতো- কোথাও মেলে না, খাপ খায় না!
কন্ডাক্টরি করতে গিয়ে মহিবুল নিত্যনতুন পাঠ পেয়েছে। দুই-পাঁচ টাকা ভাড়া কম দেওয়ার জন্য মানুষ কী খ্যাঁচরামিই না করে! দেখতে ভদ্রলোকের মতো, সুবেশধারী অনেকেই ‘একটু পরে দিচ্ছি’ বলে ভাড়া না দিয়েই নেমে যায় আলগোছে। এসব দেখতে দেখতে ঘেন্না ধরে গেছে। তবুও প্রতিদিন নিয়ম করে রাজপথে নামতে হয়। বাসে উঠতে হয় মহিবুলকে। এ পর্যন্ত চারজন ওস্তাদের সঙ্গে কাজ করেছে সে। নানান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে। প্রথম ওস্তাদ বাপ-মা তুলে গালমন্দ করত। নতুন অবস্থায় কাজ শিখছে বলে মুখ বুজে সয়ে যেত সব।
যখন কাজে-কর্মে পাকা হয়েছে, খিস্তিখেউড়ের তোয়াক্কা করেনি। চলে আসার পরে ওস্তাদ আক্কাস আলী সতীর্থ ড্রাইভার-কন্ডাক্টরদের সামনে পেলে মহিবুলের বাপ-মায়ের চরিত্র তুলে কুৎসিত ভাষায় গালমন্দ দিয়েছেন। সেদিকে আর কান দেয়নি মহিবুল মিয়া।
দ্বিতীয় ওস্তাদ সব দিক দিয়ে ভালো। কাজের একসপ্তাহের মাথায় পরামর্শ দিয়েছেন- ‘সারা জীবন তো খুচরা টাকা গুইনা পার করবি না। গাড়ি চালানিডাও শিইখা নে।’
এই ওস্তাদের কথামতো চেষ্টা চালাচ্ছে সে। চালক পাল্টালেও কখনো ৪৯ সংখ্যাটাকে ত্যাগ করেনি। সেঁটে রেখেছে ভোটের দিনে আঙুলের মাথায় মাখিয়ে দেওয়া কঠিন কালির মতো।
আহা, দ্বিতীয় ওস্তাদ থাকলে ড্রাইভিংটা অল্প সময়ের মধ্যেই শিখিয়ে দিত তাকে। কিন্তু হঠাৎ অ্যাকসিডেন্ট করে জেলে যেতে হল ওস্তাদকে। নেতা-সংগঠন কেউই কিছু করতে পারল না। একটা প্রাইভেট কার চাপা দেওয়ার এত বড় শাস্তি! পাঁচজন স্পট ডেড। তাদের ক্ষমতাবান আত্মীয়স্বজন ছাড়বে কেন! ফলে ওস্তাদের জায়গা হল কারাগারে। সেখানে দুইবার দেখাও করেছে মহিবুল। এমন দাপুটে ওস্তাদের চোখে পানি দেখবে- ভাবেনি সে। টলটলে জলের কাঁপন তুলে আমির হোসেন বলেছিলেন, ‘আমার পরিবারের দিকে একটু খেয়াল রাখিস রে ভাই। অগো রে আমি কিছুই দিয়া আইবার পারি নাই।’
ওস্তাদকে কথা দিয়েছিল সাধ্যমতো চেষ্টা করবে। অনাথ মহিবুল, সারাদিন যাত্রীদের সঙ্গে খেচরমেচর করে রাতে সেই গাড়িতেই ঘুমায়। তৃতীয় ওস্তাদ বলে দিয়েছেন- ‘জান থাকতে গাড়ি কখনো নাপাক করিস না। এইটা আমগো ভাতঘর। পবিত্র জায়গা।’ উল্টাপাল্টা কিছু সে করেওনি কখনো। শুধু মাঝে-মধ্যে সিনেমার এক নায়িকাকে স্বপ্ন দেখত। সারাদিনের কর্মক্লান্তির পর ঘুম এসে যায় সহজেই। যে রাতে ঘুমঘোরে নায়িকা আসে, একটা উষ্ণ আবেশ রয়ে যায় শরীর-মনে। প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙলে চোখে-মুখে চাপকলের পানির ছিটা দিয়ে, টং দোকানের পাউরুটিতে চা ভিজিয়ে খেয়ে নেমে পড়ে কাজে। যাত্রী ডেকে তুলে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়াই ওর একমাত্র লক্ষ্য।
রোজগারের কয়টা টাকাইবা সঞ্চয় করতে পারে! তবুও সাধ্যমতো দ্বিতীয় ওস্তাদের বাসায় চাল ডাল তেল নুন কিনে পৌঁছে দিয়েছে। দ্বিতীয়বার যখন ওই বাসায় যায়, ভাবি-বাচ্চা কাউকেই দেখেনি মহিবুল। বস্তির অন্য রুমের বাসিন্দাদের কাছ থেকে জেনেছে, মফিজ ড্রাইভারের সঙ্গে নতুন সংসার পেতেছে ভাবি। জেলের ঘানি টানা একজন মানুষকে এত বড় দুঃসংবাদ দেওয়া যায় না। তাই আর কখনো দেখা করতে যায়নি। তবে ওস্তাদের দুঃখে রাতের আঁধারে বাসের সিট ভিজিয়েছে। পৃথিবী যে খুব নিষ্ঠুর জায়গা, উনিশ বছরের জীবনে বুঝে গেছে সে।
চতুর্থ ওস্তাদ ইউনুস মাদবরের মুখ খারাপ। তবে বড় মানুষ তিনি। কাজ শুরুর প্রথম সপ্তাহেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, মহিবুলকে ঝানু ড্রাইভার বানিয়েই ছাড়বেন। নিজেও কন্ডাক্টর থেকে ড্রাইভার হয়েছেন; তাই জানেন এখানকার আরাম কিংবা জ্বালা। যখনই ফুরসত পান একটু, প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে রাতে ফেরার সময়, যে দিন যাত্রী কম থাকে। চালনার খুঁটিনাটি জেনে নেওয়ার সুযোগ পায় মহিবুল। কীভাবে গতি বাড়াতে-কমাতে হয়, থামাতে হয়, কীভাবে দিতে হয় অন্য গাড়িকে সাইড। ইদানীং স্টিয়ারিংয়ে বসাও শিখছে। তবে সেটা রাত বাড়লে।
সেদিন দুপুরে ওস্তাদের বাড়ি থেকে ফোনকল এল। কথা বলতে বলতে স্বর সপ্তমে উঠতে থাকে। টাকাপয়সার ব্যাপার বোধহয়। উত্তেজিত হয়ে পড়েন তিনি। কড়া বাতচিতের মাঝখানেই আদেশ করেন- ‘ওই মইবুল, আইজ তুই চালা।’
ওস্তাদের মেজাজ দেখে সংশয় প্রকাশের সাহস পায় না মহিবুল। কাঁপা কাঁপা হাতে স্টিয়ারিং ধরে। কোমরেও জোর পায় না তেমন। তারপর কী থেকে কী হয়ে যায়, টের পায় না।
পরদিন নিম্ন প্রচারসংখ্যার দৈনিকগুলো সরগরম হয়ে ওঠে। একটি কাগজের সম্পাদকীয় স্তম্ভের শিরোনাম হয়- এই নৃশংসতার শেষ কোথায়!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন