micro-story-khelte-khelte

খেলতে খেলতে
সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী


অনেকদিন পর আজ আবার সপ্তাহান্তের সন্ধ্যায় মৈনাকদের বাড়িতে সবাই জড়ো হয়েছে। মৈনাকের স্ত্রী মনীষা ব্যস্ত অতিথি আপ্যায়নে। প্রাঞ্জল আর তার বউ জিনিয়া, মনামি আর ওর হাজব্যান্ড প্রতীক, আর তাদের ছেলেমেয়েরা। জিনিয়ার মেয়ে ঋষিতা আর মনামির ছেলে প্রান্তিক দুজনেরই বয়স কাছাকাছি, প্রান্তিকের সাড়ে চার বছর, ঋষিতা তার চেয়ে কয়েক মাসের ছোট। নিঃসন্তান মৈনাক আর মনীষা খুব উপভোগ করছে বাচ্চাগুলোর দুষ্টুমি।
ওদের মা-বাবারাও নিজের সন্তানদের নানা কীর্তিকলাপ বলতে বলতে হাসাহাসি করছে। সারা সপ্তাহের কাজের টেনশনের পর পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে এই আড্ডাটা ওদের সকলের কাছেই অক্সিজেনের মত। মৈনাক আর মনীষা, প্রাঞ্জল আর মনামি কলেজের বন্ধু। পরে মৈনাক-মনীষার প্রেম, তারপর বিয়ে হয়েছে, আর প্রাঞ্জল আর মনামিদের স্পাউসরাও ওদের সঙ্গে বেশ মিলেমিশে গেছে। আগে মাসে অন্তত একদিন করে মিট করত ওরা, হয় কারও বাড়িতে, নয়তো রেস্তরাঁতে। কিন্তু বিয়ের পর ছেলেমেয়ে হয়ে যাওয়া, তারপর সাংসারিক চাপে, বাধ্যবাধকতায় আজকাল আর ঘনঘন দেখাসাক্ষাৎ হয় না। আজ ফের সুযোগ হয়েছে মৈনাকদেরই উদ্যোগে।
খাওয়া দাওয়ার আয়োজন জমজমাট। এবার একটু পানীয় সহযোগে মন খুলে গল্প শুরু হবে। তার আগে বাচ্চা দুটোকে কায়দা করে পাশের ঘরে খেলতে পাঠানো হল। ওদের সামনে পানীয়র আসর না জমানোই ভাল। ওরা ওদের মত খেলা করুক বরং। প্রান্তিক আর ঋষিতা খুশি মনেই চলে গেল খেলতে।
তবে ওদের নিয়ে মজার কথাগুলো অবশ্য চলতেই থাকল। মৈনাক আর মনীষার তাতেই বেশি আগ্রহ। জিনিয়া বলল, “জানো মৈনাকদা, আমার মেয়ে কী করে? ওর একটা খুব প্রিয় বার্বিডল আছে। সেটাকে ও নিজের মেয়ে বানিয়েছে। তাকে নাওয়ায়-খাওয়ায়, পড়ায়, এসব তো আছেই, মাঝেমধ্যে ওকে নিয়ে আমাদের বাড়ির ভিতরের দোতলার সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ গিয়ে ওখানে বসে পড়ে, আর বলে, মেয়েকে নিয়ে ফ্ল্যাটে যাচ্ছি এখন, আমাকে ডেকো না। ওই সিঁড়ির ল্যান্ডিংটা নাকি ওর ফ্ল্যাট! এখানেই শেষ নয়, তারপর শুনি পুতুলটাকে বলছে, দুষ্টুমি কোরো না, তোমার বাবা আসুক, চকলেট কিনে দেবে। আমি একদিন ইচ্ছে করে ওকে জিজ্ঞেস করেছি, হ্যাঁ রে তোর মেয়ের, মানে পুতুলের বাবা কে? ঋষিতা একটু থেমে তখন বলল, বাবা তো এখনও ঠিক হয়নি, হলেই বলব! ভাবো!”
সবাই হা হা করে হেসে উঠল। তখন মনামি বলল, “আর আমার ছেলের কথা শোনো। একদিন দেখি খুব বিজ্ঞের মত গলায় আমাকে বলছে, বুঝলে এবার আমাদের এই একতলা বাড়িটা তিনতলা করতে হবে। কেন? না, একতলায় থাকবে ওর বাবা-মা মানে আমরা আর ওর দাদা-ঠাম্মা মানে আমার শ্বশুর শাশুড়ি, দোতলায় থাকবে ওরা মানে ও আর ওর বউ আর তিনতলায় থাকবে ‘ওরা’। এই ‘ওরা’ যে কারা, কিছুতেই বলে না প্রথমে, তারপর অনেক চাপাচাপি করায় প্রান্তিক আস্তে আস্তে বলে, ‘ওরা’ মানে নাকি ওদের ছেলেমেয়েরা!”
মনীষা হাসতে হাসতে বলে, “সত্যি, খুব পেকেছে দেখছি ওরা। বিয়ে দিতে হবে এবার জলদি। তোরা রেডি থাক সব।”
সমবেত হাসির রোলের মাঝেই হঠাৎ যেন আড্ডার তাল কেটে যায়। পাশের ঘর থেকে ঋষিতার কান্নার তীব্র শব্দ ভেসে এল। জিনিয়া, মনামি সবাই চমকে উঠে দাঁড়াতেই ঋষিতা ছুটতে ছুটতে এ ঘরে ঢুকল। মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে সে বলল, “দেখো মা, ও আমাকে মারছে! আমার চুল ধরে টেনেছে।”
ততক্ষণে হতভম্ব মুখ করে ছোট্ট প্রান্তিক এই ঘরে চলে এসেছে। প্রতীক প্রচণ্ড রেগে তাকে মারতে উদ্যত হতেই জিনিয়া তাকে নিরস্ত করল। তারপর নিজেই এগিয়ে গিয়ে প্রান্তিকের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে জিজ্ঞেস করল, “তুমি বন্ধুকে মারলে কেন বাবা?”
প্রান্তিক যে উত্তরটা দিল সেটা শুনে সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সে বলল, “আমরা তো হাজব্যান্ড-ওয়াইফ খেলছিলাম আন্টি!”
জিনিয়া তাও আস্তে করে জানতে চাইল, “তার মানে?”
প্রান্তিক তড়বড় করে ঋষিতার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, “ওই তো, আমরা দুজনে বিয়ে করলাম। তারপর আমি অফিস যাব আর ও রান্না করবে। সেটা খেলছিলাম। তারপর অফিস থেকে ফিরে…”
জিনিয়া বলল, “তারপর? অফিস থেকে ফিরে কী করবে?”
প্রান্তিক বলল, “কেন? অফিস থেকে ফিরে বউকে মারব তো! তাই মারছিলাম ওকে। আন্টি, খেলতে খেলতে ঋষিতা এরকম কাঁদল কেন?”
ঘরের কারও মুখে আর কোনও কথা সরল না। প্রতীক আর মনামির মুখের দিকে তো তাকানো যাচ্ছিল না। জিনিয়া আস্তে আস্তে প্রতীকের দিকে তাকিয়ে প্রান্তিকের উদ্দেশে কেটে কেটে বলল, “ঋষিতার দোষ নেই বাবা। কান্নাটা স্বাভাবিক। আর তুমিই বা কী করবে? তোমরা তো ছোট। যা দেখবে, তাই তো শিখবে… তবে শোনো বেটা, আর কখনও তোমার বন্ধু বা অন্য কোনও মেয়ের গায়েই হাত তুলো না, কেমন? ”
ঋষিতার কান্না থেমে গেছিল। কিন্তু আরেকটা কান্নার স্বর এবার সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। মনামি!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *