মহুয়া ব্যানার্জী
দাওয়ার ওপর উবু হয়ে বসে আছে শনিচরী। কোটরগত দুটি চোখে রাজ্যের ক্ষোভ বাসা বেঁধেছে। শীর্ণ দুটি হাতের শিরাগুলো ফ্যাকাসে নীল। গায়ের ছেঁড়া কাপড়টা ঝাড়খণ্ডের এই পাথর খাদানের ভয়ঙ্কর শীতকে আটকানোর বৃথা চেষ্টায় আরও খানিকটা জীর্ণ হয়েছে। পেটের খিদে মেটানোর রাস্তা একমাস হল বন্ধ।
এই হতদরিদ্র মানুষগুলোর এই পাথর খাদানে কাজের সুবাদে বেঁচে আছে। কিন্তু হঠাৎ করেই একদল ভদ্দরলোকের ছেলেমেয়েদের দাবীতে কাজ বন্ধ। কানাঘুষো চলছে যে পাথর খাদানের কাজ নাকি বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে। শ্রমিকরা অত কিছু বোঝে না। পরিবেশ দূষণ, ভারসাম্য রক্ষা, শ্রমিক সুরক্ষা এইসব কথাগুলো কানে এলেও মাথায় ঢোকে না। তাদের মাথায় থাকে শুধু কোনমতে খেয়ে পরে বেঁচে থাকা। তাদের কোন ক্ষোভ নেই মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে। যত রাগ সেই ছেলেমেয়েদের ওপর যারা তাদের এই বাঁচার পথটুকুও বন্ধ করে দিল। জোয়ান মদ্দগুলো তবু দুরে দুরে গিয়ে কিছু না কিছু কাজ করার চেষ্টা করছ। টুকটাক কাজ পেয়েও যাচ্ছে। তাই তাদের অতটা ভাবনা নেই। তাদের পরিবারের ছেলে মেয়েরাও দুরের গ্ৰামগুলোয় গিয়ে গতর খাটিয়ে খায়। খুব যে ভালো থাকে তা নয়। কাজ পেলে তবেই। কিন্তু তবুও একটানা উপোস করে থাকতে তো হয় না।
শুধু শনিচরীর খিদে মেটার কোন উপায় নেই।
পেটের ভেতরটা খিদেতে মোচড় দিচ্ছে। হাঁটুদুটো পেটে চেপে, শুকনো মুখে বুড়ি শনিচরী মনে মনে গাল দেয়, “তুয়ারা বুঝবি নাই রে খিদার কষ্ট কি। হেই ভগমান খাদানটো চালু কর্যে দাও গ।’ কয়েক ফোঁটা চোখের জল শীর্ণ গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। সেই কবে বরের সাথে এই খাদানে কাজে আসা। দুহাতে খাটত দুজনে আর পেটভরে খেত। মাথার ওপর খাপরার ছাদ, পাথর খাদানের ফেলে দেওয়া অকাজের পাথরের মেঝে আর চারপাশে বাঁশ, মাটি কাঠকুটো দিয়ে বানানো দুকামরার ছোট বাসাটি তাদের দুজনের ভালোবাসার ঘর হয়ে উঠেছিল।
রাতে দড়ির খাটিয়া ছেড়ে মেঝেতেই ভালোবাসার ঝড় উঠত তাদের। তার বর বলত, ‘শুধু পেটের খিদা মিটল্যে হব্যে? শরীরের খিদা না মিটল্যে খাটবো কি করে?’ তারপরই শনিচরীর সুগঠিত শরীরকে বুকে টেনে নিত। সারা বস্তি তাদের দুজনের পিরিত দেখে হাসাহাসি করত। বস্তির বৌরা আবার কেউকেউ তার এত পিরিত স্বত্ত্বেও এক মাত্র সন্তানের জননী হওয়ার রহস্য জানতে আসত। শনিচরী কিছু না বলে কেবল মুখ টিপে হাসত। তার বর যে গ্ৰামের দাইবুড়ির কাছ থেকে কিসব জড়িবুটি এনে খাওয়ায় তাকে। সে কথা এদের বলা যাবে না।
তার ছেলে পাপ্পুও বড় খাটুয়া ছিল। খাদানের ম্যানেজারের সঙ্গে ভাব করে বেশ ভালোই কাজ পেত। ছেলের বিয়ের পর রোজ রাতেই তাদের ঘরের ভেতরের শব্দ শুনে শনিচরী নিজের যৌবনের দিনে ফিরে যেত।
ছেলে বৌ মিলে তাকে শোক ভুলিয়ে দিয়েছিল।
গরীবের অবশ্য শোক করার সময় থাকে না। তাই বিয়ের দুবছরের মাথায় পাপ্পুও যখন বাপের মতই মরে গেল, শনিচরী ছামিয়াকে খাদানের কাজে পাঠালো। খিদে বড় বালাই। ছামিয়াও তা জানে। তবুও কখনো কখনো মন উতলা হত। পাপ্পুর শরীরের উত্তাপ টের পেত। তেমনই এক রাতে পদস্খলন হয়েই গেল। বস্তির এক ছোকরা শ্রমিকের কাছে নিজেকে সঁপে দিল ছামিয়া। আদরে চুমুতে ঘরের পেছনের পাথুরে মাটি ভিজে যাচ্ছিল। শীৎকারের শব্দ বাতাসে ঘোর লাগাচ্ছিল।
শঙ্খলাগা দুটো শরীর এক ঝটকায় আলাদা হয়েছিল শনিচরীর চিৎকারে। হাতের দা টা চকচক করছে। চোখ দুটোতে আগুন। শাশুড়ির এ রূপ আগে কখনো দেখেনি ছামিয়া। তারপর থেকে রাতে ছামিয়ার ঘরেই থাকত শনিচরী। এভাবেই শাশুড়ির কড়া পাহারায় ছামিয়ার দিন কাটছিল। কিন্তু খাদানের কাজ বন্ধ হয়ে যেতে আজ তাদের এই অবস্থা। ছামিয়া কতবার বলেছে শনিচরীকে যে সে বস্তির অন্যান্য মেয়ে বউদের মত গ্ৰামে জন খাটতে যাবে। কিন্তু তার চোখের আড়াল হলেই যদি ছামিয়া আবার পাপ করে। সে মরে যাবে তবু বাড়ির বৌকে নষ্ট হতে দেবে না। যদি পাপ করে পেট বাধিয়ে বসে তাহলে! সে তো বুঝতে পারে যে মেয়ে বৌগুলো কি ভাবে কাজ না পেলে গতর বেচে খায়। এ পথে সে ছামিয়াকে যেতে দেবে না।
‘উফ্। মাগোওও। বড় খিদা গো।’ পেটটা মোচড় দিয়ে মুখে টকটক জল আসে শনিচরীর।
সে বুঝেছে আসলে মরে যাবো বলা যত সোজা খিদে সহ্য করে মরা অত সহজ নয়। কি একটা ভাবে সে মাথাটা ঝুঁকিয়ে। তারপর লাঠিতে ভর দিয়ে নড়বড় করতে করতে রাস্তায় নামে।
রাত নিঝুম। দাওয়ায় বসে লম্ফ জ্বেলে শনিচরী গপগপ করে খাচ্ছে। গরম ভাত, ডাল, সবজি।
এবার থেকে তারা দুজনেই রোজ খাবে পেটভরে।
ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসা শীৎকারের শব্দ কানে যেতে বুড়ির মুখে হাসি খেলে যায়। ছামিয়াকে আর কোথাও কাজ খুঁজতে যেতে হবে না আপাতত। খাদানের ম্যানেজার তার পাপ্পুর মত পুরো। শনিচরী মনে মনে বলে, ছামিয়া শরীরের খিদাটো মিট্যা।
শনিচরী এখন বোঝে যেভাবেই হোক শুধু বেঁচে থাকাটাই পূণ্য। বাকি সব পাপ।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
এক বাস্তব নিষ্ঠুর সত্যকে এত স্বল্প পরিসরে এমন নিখুঁত করে ফুটিয়ে তোলার জন্য লেখিকাকে কুর্নিশ জানাই।
Thanks
লেখা পড়ে বুঝলাম, কবি লিখেছেন গদ্য। ভালো লাগল
মূল্যবান মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ।