সঞ্জয় কর্মকার
ভোরের আলো ফুটতে এখনও কিছুটা দেরি আছে। তবু ছিদাম জোরে প্যাডেল করে। রায়মঙ্গল হাট ওর বাড়ি থেকে কম দূর নয়। ভ্যানরিক্স নিয়ে এই পথটুকু যেতে প্রায় আধ ঘন্টা সময় লাগে। রায়মঙ্গলের হাট থেকে ছিদাম আনাজপাতি পাইকারি দামে কেনে। তারপর সেই আনাজপাতি এ- গ্রাম সে – গ্রাম ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে আয় রোজগার যা হয় তা দিয়েই টেনেটুনে সংসারটা চালাতে হয় ওকে। হালকা শীত পড়েছে। কুয়াশার একটা পাতলা চাদর ঢেকে দিয়েছে রাস্তাটা। হেমন্তের এই কাকভোরেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে ছিদামের কপালে। গ্রামের রাস্তাটা ছেড়ে এ.বি রোডে উঠেও লোকজন তেমন দেখতে পেল না ছিদাম। তবে মাঝে মাঝে এক- আধটা গাড়ি হুশ হুশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে গা ঘেঁষে।
‘শালা, দেখে চালাতে পারিস না। এক্ষুনি তো…’ খেঁকিয়ে ওঠে ছিদাম। একটা ম্যাটাডোর ওকে প্রায় ধাক্কা মেরেই চলে যাচ্ছে ঐ!
এ.বি রোডে দ্রুত গতিতে চলতে চলতে আকস্মিক ভ্যানরিক্সটার গতি মন্থর হয়। সামনেই একটা পুলিশ গাড়ি। রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে তিন জন পুলিশ। একজন পুলিশ ভ্যানরিক্সটা থামানোর জন্য ইঙ্গিত দিচ্ছে হাত উঁচু করে। ছিদাম ভ্যানরিক্স থেকে নামতেই একজন পুলিশ বলে ওঠে, ‘পাশের গলিতেই একটা লাশ পড়ে আছে। তোর ভ্যানে তুলে থানায় নিয়ে চল।’
‘লাশ!’ পুলিশটার কথা শুনে ভয়ে কেঁপে ওঠে ছিদাম। মুখ দিয়ে আর শব্দ বেরোয় না একটাও। স্থির দাঁড়িয়ে থাকে ও। ছিদামের ভাব গতিক লক্ষ করে আর একজন পুলিশ বেশ চড়া গলায় বলে, ‘আহ্, দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে! শিগগির চল।’
ভয়ে এবার ছিদামের শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে মুহূর্তেই। তবু দেরি করা চলবে না। একজন পুলিশ গলিপথটা দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছিদামকে। ছিদাম কলের পুতুলের মত ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে ভ্যানরিক্সটা।
‘যাক্ বেশ হালকাই আছে! গুলিতে এফোড় ওফোড় হয়ে গ্যাছে একেবারে। আর হবে নাই বা কেন, শালাদের বাপ তো দশটা! যা হোক্ শোন্, কোত্থাও দাঁড়াবি না যেন! লাশটা নিয়ে সোজা চলে যাবি ভগবানপুর থানায়। আমরা গাড়ি নিয়ে এগোলাম।’ পায়ের দিকটা ধরে লাশটা ভ্যানরিক্সয় তুলে দিয়ে কথাগুলো বলে পুলিশটা।
ভগবানপুর থানার নির্জন রাস্তাটা ধরে এগোচ্ছে ছিদাম। গা-টা কেমন যেন শিরশির করছে ওর। লাশের মাথাটা ঠিক ওর সিটের পিছনেই। লাশটা ভ্যানরিক্সয় তোলার সময় টুপ টুপ করে রক্ত ঝরছিল। লাশটা একটা কালো কাপড়ে ঢাকা আছে। তবু ছিদামের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটা মুখ। বড্ড চেনা সেই মুখটা। কে মারল, কেন মারল জানে না ও। যে মরা মানুষটাকে ও বয়ে নিয়ে যাচ্ছে বেঁচে থাকতে তাকে কি কোনদিন দেখেছে ও!
এবড়োখেবড়ো রাস্তায় লাশটা মাঝে মাঝে দুলে উঠছে। হয়ত বাঁধনের দড়িটা কিছুটা আলগাও হয়ে গ্যাছে। অথচ পিছন ফিরে দেখতে সাহস পায় না ছিদাম। বড্ড ভয় করছে ওর। জীবনে এই প্রথম লাশ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ও। তাজা রক্তের একটা কূট গন্ধে গা-টা হঠাৎই গুলিয়ে ওঠে ছিদামের। লাশটাকে এখানে ফেলে চলে গেলে কেমন হয়! নাঃ, তাহলে পুলিশ ওকে ছাড়বে না! নির্ঘাত কোন কেসখামারি দিয়ে হাজতে ঢুকিয়ে দেবে।
লাশটা এখন আর একটুও দুলছে না। ভ্যান থেকে পড়ে গেল নাকি! ছিদাম ঝটিতি একবার পিছন ফিরে তাকায়। না, পড়েনি। দিব্যি আছে লাশটা। রাস্তায় লোকজন কেউ নেই। ভ্যানরিক্স থেকে ঝট করে নেমে পড়ে ছিদাম। লাশটার পাশে কিছুটা জায়গা আছে। ছিদামের শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে সেই জায়গায়। লাশটাকে কেমন যেন নিজের প্রতিরূপ মনে হচ্ছে ছিদামের। জড়িয়ে ধরে কথা বলতে ইচ্ছে করছে খুব ।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন