micro-story-lov

লোভ
অনুভা নাথ


“গোবিন্দ, বড় সাহেব তোকে ডাকছেন। জরুরি কাজ। যা এখনই…”

এই বিরাট অফিসের দামী কার্পেটের ওপর দিয়ে জোরে হাঁটা যায় না। এর ওপর দিয়ে হাঁটতে হবে ধীরে ধীরে। তবুও গোবিন্দ প্রায় দৌড়াল। হোঁচট সামলাতে সামলাতে ভাবল, বড়সাহেব ডেকেছেন, তার মানে এবার কি চাকরিটা থাকবে না আমার?

গোবিন্দ আতঙ্কিত হল। এই অফিসে কাজ ধরে দিয়েছে ওর বোনাই। তার আগে সে হাটে সবজি বিক্রি করত। বাঁধা ধরা রোজগার ছিল না তখন, যখন যেমন টাকা আসত। এই টাকায় সংসারের ঘানিতে তেল হয় না। শক্ত ঘানি আরও কঠিন হয়ে সংসারের গায়ে এঁটে বসে। এই অফিস তাকে শুধু অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দেয়নি, গ্রামে তার মাথাটাও একটু উঁচু করে দিয়েছে।

গোবিন্দ আঙুল চালিয়ে চুলটা পরিপাটি করে নিল। বড় সাহেবের ঘরের বাইরে দরজা বন্ধ। ঢাউস দরজার সামনে দুজন পিয়ন বসে। একজন এদিক ওদিক গেলেও অন্যজন থাকবে। অর্থাৎ কোনও ভাবেই যেন বিনা অনুমতিতে সে ঘরে কেউ ঢুকতে না পারে।

“তোর আইকাডটা দেখি”, পাশ থেকে অন্য পিওন বলল,” নে গোবিন্দ মুখটা ভাল করে এই কালো ক্যামেরার সামনে ধর দেনি। ক্যামেরা তোর নাম, ধাম সবকিছু টিভির ছপিতে দেখিয়ে দেবে। তবেই তুই বড়বাবুর ঘরে ঢুকতি পারবি।”

গোবিন্দ বলতে চাইল তাকে ওর বোনাই চাকরি দিয়েছে সে বড়সাহেবের সেকেটারির খাস লোক। আর রোজই তো অফিসে আসার সময় সে নিজে বড়সাহেবকে সেলাম ঠোকে। বড়সাহেব ওকে রোজই দেখেন…। তবুও তাকেও এই রকম মেশিনে পরিচয় দিতে হবে কেন? কিন্তু এসব সে বলতে পারল না। ওপরওয়ালার সামনে এগুলো বলা যায় না।

তারপরও ঝাড়া একটি ঘন্টা তাকে বড়সাহেবের ঘরের সামনে অপেক্ষা করতে হল।

শেষ পর্যন্ত সে বড়সাহেবের ঘরে ঢোকবার অনুমতি পেল। ঢাউস ঘরের এপার ওপার দেখা যায় না। বিরাট টেবিলের সামনে বড়সাহেব বসে আছেন। বয়স ষাটের একটু বেশিই, তবে তাঁর চোখ দেখলে মনে হয় যেন পৃথিবীর সমস্ত লোভ ওই দুই ইঞ্চির দুটো চোখে লেগে রয়েছে। গোবিন্দ সেই চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। খুট শব্দে সচকিত হয়ে গোবিন্দ তাকিয়ে দেখল একজন অল্পবয়সী মহিলা বড়সাহেবের বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসছে। তাঁর স্বল্প বসন দেখে গোবিন্দ নিজেই লজ্জা পেল। সেই মেয়েকে দেখে ওর মনে হল, একটা পিচ্ছিল লোভী সাপ, কুন্ডলী পাকিয়ে কারোকে চেপে ধরলে সে দমবন্ধ হয়ে মরে যাবে।

কথা বলল সেই স্বল্প বসনা, শুদ্ধ ইংরেজি মেশানো বাংলায় বলল “ঘোবিন্ড, তোমাকে এখটা কাজ করতে হবে। ভেজি আই মিন কিচু সব্জি বিক্রির পাইকারি আর খুচরো দাম বলতে হবে আমাকে। আমি একটা চার্ট করেছি। তোমাদের স্যর ভোটে দাঁড়াচ্ছেন। শিশু মহিলা দপ্তর।” আচমকা বড়সাহেব বাধা দিলেন “এলিনা, ওকে দপ্তরের বিষয়ে জানাতে কে বলেছে? তাছাড়া এখনও কিছু ঠিক হয়নি। কৃষিও হতে পারে। তুমি লিস্ট মিলিয়ে দরদাম বুঝে নাও। আর ওকে বলো এই কাজের জন্য ও টাকা পাবে, তবে মুখ বন্ধ রাখতে হবে।” বড়সাহেব কথা বলতে বলতে জিভ চাটলেন, গোবিন্দর মনে হল, যেন ওই মেয়েটির পিচ্ছিল সাপের মতো লোভী দৃষ্টিতে বড়সাহব মেয়েটিকে দেখছেন। কে কাকে গিলবে? মেয়েটি সাহেবকে নাকি সাহেব মেয়েটিকে, অথবা লোভ দুজনকেই?

গোবিন্দ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল “না সাহেব আপনি আমাদের নেতা হবেন, অথচ এই রকম আপনার অবস্থা? মাফ করবেন। আমি পারব না।”

গোবিন্দ কি এরপর সত্যিই বড়সাহেবের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল? না, গোবিন্দ ওপরের কথাটা মনে মনে বলল। ওপরওয়ালাকে এসব কথা বলা যায় না। লোভে তার চোখ দুটো চকচক করে উঠল। টাকা পাবে? গোবিন্দর প্রয়োজনগুলো টাকার আঁচ পেয়ে যেন লকলকিয়ে উঠল।

সে লিস্ট মেলাতে শুরু করল। তবে, বড়সাহেবের ঘরে আঁটা বিশাল আয়নাটার দিকে গোবিন্দ তাকাতে সাহস করল না। কারণ সে জানে সেখানে তখন আরও একটা লোভী চেহারা জন্ম নিয়েছে। সাপের মতোই,কালো আর পিচ্ছিল।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *