micro-story-madhu-chand

মধু-চাঁদ
অনামিকা মন্ডল সেনগুপ্ত


আজ কোজাগরী পূর্ণিমা। একটু আগের আধ জমা দইয়ের মতো ফ্যাকাশে চাঁদটা এখন জমাট বেঁধে আকাশের সিংহাসনে জ্বলজ্বল করছে। মেঘ আর কুয়াশা যেন শঙ্খলাগা সাপ। দুপাশ দিয়ে পেঁচিয়ে ধরেছে চাঁদটাকে। তারই ফাঁক দিয়ে রূপোর কুঁচির মতো জ্যোৎস্না ঝরে ঝরে পড়ছে নিঃস্তদ্ধ উপত্যকাটার উপরে।

আজ আবার হ্যালোইনের রাতও। তাই পাহাড়ের মাথায় আমার বিলাসবহুল হোটেলটাকে জ্যাক ও ল্যান্ঠানের দিয়ে সাজিয়েছি। কুমড়োর ভিতর থেকে হলদেটে আলোগুলো দপ দপ করে জ্বলছে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, ওর ভেতরে যেন অশরীরীরা একত্রিত হয়ে শলাপরামর্শ করছে। নির্জন পাহাড়ের চূড়ায় আলো-আঁধারির ঘোরাটোপে বন্দী হোটেলটাকে, দূর থেকে দেখলে হঠাৎই একটা শিরশিরানি অনুভূতি হয়। অবশ্য ভৌতিক হোটেল হিসাবে, আমার এই হোটেলটার সুনামও আছে। আমারই পরিকল্পনা করা নানা গা ছমছমে অনুভূতির স্বাদ নিতে সারা বছরই নবদম্পতিরা, মধুচন্দ্রিমা কাটাতে এখানে আসে। নির্জন প্রকৃতির মাঝে একান্তে সময় কাটানোর সময়, হঠাৎ হঠাৎ ভয় পাওয়া আর তারপর একে অপরকে আরো নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরা। তখন অনেকটা উথলে ওঠা দুধের মতোই উপছে পড়ে তাদের ভালোবাসা। তারই মাঝে হাসে মধুযামিনীর মধুর চাঁদ।

তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, এমনই জোৎস্না থইথই রাতে, হানিমুন সুইটের, গা ছমছমে অনুভূতির সামিল হতে হতে, দুজনে দুজনের সাথে মিশে গিয়ে মধুচন্দ্রিমার, মধুযামিনী কাটাবো। তাই আজ, তোমাকে বুকে জড়িয়ে চলেছি হোটেলের দিকে। ঐ দেখো, আজ কেমন অলৌকিক সাজে সেজে একাকী হোটেলটা, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তুমি তো এমনই চেয়েছিলে। বলো? তোমার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতেই আজ আমি হোটেলের সব কর্মচারীকে ছুটি দিয়েছি। বাতিল করেছি সব বুকিং। আজ শুধু তুমি আর আমি।

এই দেখো, আমরা চলে এসেছি। আর একটু পরেই আমরা হানিমুন সুইটে ঢুকবো। তার আগে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে নেই। সিগারেটের কটু গন্ধ, তুমি বড্ড ভালোবাসো। আমার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে, সেই গন্ধটাই পেতে চাও তুমি। তাই আজ মধুচন্দ্রিমার রাতে আমি, শেষ সিগারেটটা জ্বালিয়েই দিলাম। জানি, আজও তোমার ওই কটু গন্ধটাই ভালো লাগবে।

শেষবারের মতো ঐ দেখো রিসেপশন। যেখানে বসতাম আমি। আর তুমি! তোমার সমুদ্র নীল চোখে, উত্তাল ঢেউয়ের চাউনি হেনে, তোমার সংসারকে মধু মাখাতে চলে যেতে। আর আমি! ভালোবাসার সুনামিকে চেপে রেখে, লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার গমন পথের দিকে চেয়ে থাকতাম। আজ আর কোন বাধা নেই। এই দেখো, তোমাকে বুকে চেপে ধরেই আমি হানিমুন সুইটে ঢুকছি। প্রতিবারের মতো এবারও পুরো করিডোরটা ধোঁয়ায় ভরে গেছে। তবে এ ধোঁয়া কৃত্রিম মেশিনের ধোঁয়া নয়। আর কোনো নকল অলৌকিকে অভিজ্ঞতার সামিল তুমি হতে পারবে না। তাই তো ফায়ার অ্যালামগুলো পাগলের মতো বাজছে। কাঠের হানিমুন সুইটটা এখন পোড়া গন্ধের সাথে সাথে কালো ধোঁয়ায় ঢাকা পড়েছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে আমাদের সাধের হানিমুন সুইট। যেমন ভাবে গত রাতে জ্বলেছো তুমি। হ্যাঁ, আমি, তোমার কথা রাখলেও, তুমি আমার কথা রাখতে পারোনি। বেরিয়ে আসবো বলেও, তুমি তোমার নষ্ট সংসারের মায়া ত্যাগ করতে পারোনি। আর সেই সংসারই, সন্দেহের বশে গতরাতে পুড়িয়ে মেরেছে তোমায়। আমি তোমাকে বাঁচাতে পারিনি। তাই তো আজ শ্মশান থেকে, তোমার অস্থিকলস বুকে নিয়ে চলে এসেছি এখানে। একটু আগেই পর পর, জ্বলন্ত সিগারেট আর দেশলাই কাঠি ফেলে এসেছি, কাঠের এই সুইটের বাইরে। ধোঁয়ায় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তারই মাঝে, তোমাকে বুকে নিয়ে, মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছি আমি। চাঁদের গায়ে এখন লকলকে আগুনের শিখা। ঠিক যেন গলানো মধু। অবশেষে তুমি আর আমি মধুমাখা জ্বলন্ত চাঁদটাকে একসাথে দেখছি। খালি এতোদিন তুমি ছিলে সংসারে বন্দী, আর আজ অস্থিকলসে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *