রম্যাণী গোস্বামী
– কী রে তানিয়া? সকাল থেকে মুখখানা এত গোমড়া লাগছে কেন তোর? টিফিনটাও ভালমতো করলি না।
– আর বলিস না রম্যাণিদি। স্কুলের জন্য বেরব, ঠিক ওমনি সময় টুপাই ঘ্যানঘ্যান আরম্ভ করল, মা, তুমি কোথাও যাবে না। সেই সঙ্গে ঠোঁট ফুলিয়ে কী কান্না। ব্যস, আর যাবে কোথায়? আদরের নাতির কান্না শুনে শাশুড়িও খরখরে গলায় শুরু করে দিলেন, রোজ রোজ কি ইস্কুলে না গেলেই নয় বৌমা? একটা দিনও ছুটি নেওয়া যায় না? দুধের শিশুটা সবে জ্বর থেকে উঠল। পারও বাপু তোমরা আজকালকার মেয়েরা। প্রাণ তো নয়, যেন পাষাণ দিয়ে গড়া!
– এই কথা বললেন? তাজ্জব তো! চাকরিটা কি তোর ফ্যালনা নাকি?
– তবেই ভাব? ওদিকে নিজের ছেলে যে কোন সকালে বাড়ি থেকে বেরচ্ছে, ফিরতে ফিরতে সন্ধে গড়িয়ে রাত, সে খেয়াল নেই? তখন তো বলবেন, আমার খোকা বাপু খবরের কাগজের রিপোর্টার। তার কত দায়দায়িত্ব বলে কথা। ওর কি আর কথায় কথায় আপিসে ছুটি নেওয়া সাজে?
– সেই। আমরা হলাম ফেকলুর দল। বল তানিয়া? চাকরি সংসার সব সামলেও শুনতে হয় কোথাওই নাকি নিজেদের হান্ড্রেড পারসেন্ট দিচ্ছি না। এটাই ট্রাজেডি। ছাড়।
– ইস, ছাড়ব কেন? এনাফ ইজ এনাফ। রাতে ফিরুক না সুব্রত। আজ এর একটা হেস্তনেস্ত করবই।
– বাপরে! অতক্ষণ ধরে রাগ পুষে রাখবি মনের মধ্যে!
– তবে নয় তো কি? জানিস? আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সব ছেড়ে ছুঁড়ে কোথাও চলে যেতে। এত ডিমান্ডিং সকলে। একমাত্র পারি না ওই টুপাইটার জন্য।
– তা পারিসই না যখন, তবে ছোটোখাটো ব্যাপারগুলো ইগনোর কর। এটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
– উফ্ রম্যাণিদি। তুই এবার জ্ঞান দেওয়া স্টার্ট করিস না তো। প্লিজ।
– জ্ঞান নয়। শোন না তানিয়া। আমার না, তোর কথায় ধাঁ করে একটা গল্প মনে পড়ে গেল।
– সব্বোনাশ! আমার যে এখন নাইনের ক্লাসটা ধরতে হবে। পরে শুনব তোর গল্প। কেমন?
– আরে আরে, ভয় পাস না। গল্পটা আমার লেখা নয় মোটেই। তাছাড়া জাস্ট এক মিনিটই তো লাগবে শুনতে।
– উফ্! একেই বলে কিনা মাথায় আগুন জ্বলছে! তার উপরে গল্প! আচ্ছা বল।
– সে অনেককাল আগের কথা বুঝলি? বৈশালী নগরের কাছে এক বিরাট আমবাগানে গাছতলায় গৌতম বুদ্ধ ধ্যানে বসেছেন। সামনে অগণন ভক্ত। এমন সময় কারোর উপর রাগে অগ্নিশর্মা এক ভক্ত এল তথাগতর কাছে। রেগেমেগে ওই লোকটার নামে অনেক শাপমন্যি করে শেষে সে বলল, প্রভু, আমার ইচ্ছে করছে, আজ, কাল বা পরশু যেদিনই আবার ওই বদখত লোকটার সঙ্গে দেখা হবে, আমি তার মুখে মুঠোভর্তি জ্বলন্ত অঙ্গার ছুঁড়ে মারব।
– উফ্! ঠিকই তো বলেছে। রাগ হলে এমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক।
– হুম। আর সেই ভক্তের কথা শুনে উত্তরে তথাগত কী বললেন জানিস?
– কী বললেন?
– স্মিত হেসে তিনি বললেন, কিন্তু ততক্ষণ অবধি যে সেই প্রজ্বলিত অঙ্গারপিণ্ড তোমাকে নিজের দুই করপুটে বহন করে চলতে হবে বৎস। সে-ও কি কম যন্ত্রণার? কম ক্ষতিকারক?
শোন তানিয়া, ক্ষমা যাকে করা হল, শুধু কি সে-ই সব পায় রে? যিনি ক্ষমা করলেন, তাঁর প্রাপ্তির ঝোলা কি এতটুকুও ভরে না? নে। চলি এবার। সেভেনের বাচ্চাগুলো বসে আছে।
নাইন বি’তে ঢোকার আগে ভগিনী নিবেদিতা হাইস্কুলের ভূগোলের দিদিমণি দোতলার বারান্দায় এসে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ান। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। শ্যামলা আকাশের দিকে দু’হাত মেলে দিয়ে নিজের মনের ভিতরে গচ্ছিত রাখা এতদিনের ক্ষোভ, রাগ, ডিপ্রেশনের গনগনে আঁচের ছোট বড় টুকরোগুলোকে তিনি ধীরে ধীরে সমর্পণ করেন ওই সুশীতল বাতাসে। আর সঙ্গে সঙ্গেই শুনতে পান দূরে কোথাও দারুণ সমারোহে বেজে উঠেছে মেঘমল্লার রাগ।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
বেশ লাগল। তবে নামকরণে রম্যাণী লেখার শুরুতেই রম্যাণি হয়ে গেছে,একটু চোখে লাগল।