micro-story-miracle

মিরাক্যাল
সৌমী গুপ্ত


আকাশের মুখ থমথমে। যেন ব্ল্যাকবোর্ড মুছে ঝুলিয়ে দিয়েছে কেউ। এখুনি মাথার উপর ভেঙেই পড়বে হয়তো। ঝিল গড়িয়াহাট মোড়ে দাঁড়িয়ে ফোনটা আবার অন করার চেষ্টা করল। দপ করে জ্বলে উঠল একবার। ফোন করল। এই নিয়ে অন্তত বার কুড়ি ফোন করেছে ও। ততবারই নট রিচেবল। অস্থির হয়ে উঠল ঝিল! একটু আগে যে খবরটা টুবলু দিয়েছে তাতে গোটা আকাশটাই মাথায় ভেঙে পড়েছিল ওর। অবাক হয়ে গিয়েছিল এটা ভেবে এখনও মলাটের জন্য তেমন করেই অনুভূতিগুলো গুমরে মরে? আকাশটার দিকে তাকাল ঝিল। ছাতাও আনেনি। তাড়াহুড়োর মধ্যে বেরিয়ে এসেছে টুবলুর ফোনটা পেয়েই। সেই থেকে টুবলুর ফোন নট রিচেবল।

সত্যি যদি কিছু হয়ে যায় মলাটের ঝিল ক্ষমা করতে পারবে নিজেকে? এই যে এত বড়ো খবরটা কী নিদারুণ সত্যির মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে ঝিলকে, ফোনটা আসার মুহূর্ত খানেক আগে পর্যন্ত ঝিল নিজেও জানত না।

ব্যাগে মাত্র একশো কুড়ি টাকা রয়েছে। ট্যাক্সি ধরবে উপায় নেই। তাছাড়া জায়গাটাও তো চেনে না। এদিকে টুবলুর পাত্তা নেই।

কতগুলো স্মৃতি চোখের সামনে ভিড় করে এল। গড়িয়াহাটের এই ফুটপাত ধরেই তো কতবার একসঙ্গে হেঁটে গেছে ওরা। মলাট ওকে আগলে রাখত। এরকম মেঘ করে এলে মলাট নিজের মধ্যে লেপ্টে নিত এক ছাতার তলায়। মলাটের গাল দিয়ে আফটার সেভের গন্ধ ভেসে আসত। ঝিলের সারা শরীর শিরশির করত। খামচে ধরত মলাটের হাতের মুঠো। মলাট কেমন অন্যভাবে তাকিয়ে হাসত ঝিলের দিকে। ঝিল চোখ নামিয়ে নিত। মলাট আরও প্রশ্রয় দিয়ে মুখের কাছে মুখ নামিয়ে আনত। এত যানজট, এত কোলাহল, লোকারণ্য তার মধ্যেও ওদের একটা আলাদা পৃথিবী গড়ে তুলত। ঝিল তখন খুব ভাল ছিল। এখনকার মতো নয়। মলাট যতদিন ওর সঙ্গে ছিল ততদিন ওর মনে হত পৃথিবীটা শুধু ওদের দুজনের। তারপরের সময়টা প্রায় এক যুগের মতো মনে হয় ওর। খানিকক্ষণ আগে পর্যন্ত মলাটের কথা মনে হলে মনে হত জীবনে কোনওদিন ক্ষমা তো দূরের কথা মুখ পর্যন্ত দেখবে না ও মলাটের। সেদিনের দৃশ্যটা মনে পড়লে ঘেন্নায় শরীর ঘিনঘিন করে। কিন্তু এখন? টুবলু যা বলল তার পর মলাটের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবে ও! না কোনওদিন মলাট ওকে ক্ষমা করবে! আর সেই সুযোগটাই যদি কখনও না পায় মলাট? বুকের ভিতরটা কেমন খালি হয়ে গেল নিমেষে। নিজেকে একা লাগল ভীষন। গাটা গুলিয়ে উঠল একবার! মনে মনে বলল,”এত বড়ো শাস্তি আমাকে দিস না মলাট! আমি আর কখনও…!”

“ও ঝিলদি কখন থেকে তোমাকে ফোন করছি সুইচ অফ বলছে। এসো উঠে পড়ো!”

সম্বিৎ ফিরল ঝিলের। এক লাফে বাইকের পেছনে চেপে পড়ল ঝিল। টুবলু ছুটিয়ে দিল দূরন্ত গতিতে। ঝিল জিজ্ঞেস করল,”কোন হসপিটালে?”

টুবলু ছোট্ট করে উত্তর দিল,”আরোগ্য!”

ঝিল এবার কেঁদে ফেলল, “টুবলু মলাট কোনওদিন আমাকে ক্ষমা করতে পারবে?”

টুবলু বাঁ হাতে হেলমেটটা ঠিক করে নিল,”দেখো ঝিলদি ভালবাসায় বিশ্বাসটাই বড়ো জিনিস! সেটাই তো মলাটদাকে কোনওদিন করতে পারোনি!”

ঝিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, “আমি যে নিজের চোখে দেখেছিলাম পিউ মলাটকে জড়িয়ে ধরেছিল!”

টুবলু গলা চড়াল, “জড়িয়ে ধরলেই প্রেম! দাদা বোন হতে পারে না। এই যে সেদিন তুমি আমাকে আদর করে খাইয়ে দিলে সেটাও কি অন্যকিছু?”

ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল উড়ালসেতু জুড়ে। সাদা হয়ে যাচ্ছে চারিদিক। টুবলু বলে চলেছে একনাগাড়ে, “আর পিউটাকেও বলিহারি, হুসেনদার সঙ্গে পালাচ্ছিস পালা, মলাটদাকে সঙ্গে নেবার কী দরকার! হুসেনদার বাড়ির লোক এমনিই ভাল নয়, এলাকার মাফিয়া, পড়লি তো ধরা, তার মাশুল দিতে হচ্ছে মলাটদাকে। এমন মারল এখন বাঁচবে কিনা কে জানে!”

অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। ঝিল শুধু অপেক্ষা করে আছে একটা মিরাক্যলের।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *