micro-story-mohinkakar-motigoti

মহিনকাকার মতিগতি
নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী


হঠাৎই আমরা মহিনকাকার বিয়ের কথা শুনলাম বাড়ির বড়দের মুখে। অনেকদিন ধরে মা আর বাবা যেন কী একটা নিয়ে আলোচনা করে। আমরা এসে দাঁড়ালেই সব চুপচাপ। কয়েকদিন পরেই আমার খাস গুপ্তচর গোল্লা অ্যাক্টিভ হয়ে উঠল। অবশেষে খবর ফাঁস হয়ে গেল। মহিনকাকার নাকি বিয়ে দেওয়া হবে! আমি আর গোল্লা অবাক হয়ে তাকাই আর হি হি করে হাসি। মহিনকাকা তো সন্ন্যাসী হবে, নয়তো ভবঘুরে। সারাদিন কাকা একটাই গান গায় “জীবনপুরের পথিক রে ভাই! কোনো দেশেই সাকিন নাই!” ভালো ভালো সব চাকরির পর চাকরি ছেড়ে দেয়। আইটি সেক্টরের কাজ ছেড়ে বাড়িতে সারাদিন ভ্যাবলা হয়ে বসে থাকে আর ফোঁসফোঁস করে প্রাণায়াম করে রোজ ভোরে উঠে। সে করবে বিয়ে! তাহলেই হয়েছে! বউ দুদিনে ভেগে যাবে! মা যেই শুনেছে কাকা চাকরি ছেড়েছে, অমনি কাকাকে কিছু না বলে কোন বিখ্যাত ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে গেছে।

ডাক্তারবাবুকে মহিনকাকা বলেছে যে কাকা রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতো তিব্বতের পথে পথে ঘুরে বেড়াতে চায়। বিয়ে ফিয়ে করবেই না। শুনে ডাক্তারবাবু বলেছেন, “সে তো ঠিকই আছে, কিন্তু রাহুলজী কটা বিয়ে করেছিলেন আপনার ধারণা আছে? ছোটোবেলায় বাপ মা তাঁর একটা বিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর নিজে একজন রাশিয়ান ও পরে বেশি বয়সে তাঁর নেপালী সেক্রেটারীকে বিয়ে করেছিলেন এবং দু তরফেই ছেলে ও মেয়ে আছে।” শুনে মহিনকাকা নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল, “বিয়ে করলে মতের অমিল, অশান্তি নানাদিকে ভয়, এখন এই বেশ আছি। ব্যাঙ্কের জমা টাকা ফুরিয়ে এলে আবার একটা কাজ দেখে নিয়ে করব। এখন সারাদিন ধ্যানজপ করে খুব আনন্দে আছি।”

শুনে ডাক্তার খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন। ফেরার পথে গুগল করে দেখে নিয়ে মহিনকাকা মাকে বলল, “ডাক্তার আমাকে ডিপ্রেশনের ওষুধ দিয়েছে। ও আমি খাবো না।”

এরপর মা আর বাবা কাজে নেমে পড়ল। মহিনকাকার বিয়ে দিতেই হবে। বিয়ের নামে মহিনকাকা রেগে আগুন। মা আমাদের হাতে কয়েকটা মেয়ের ছবি দিয়ে বলল, মহিনকাকার ঘরে রেখে আসতে। আমরাও অবাধ্য না হয়ে ছবিগুলো মহিনকাকার ঘরের নানা কোণে লুকিয়ে রেখে এলাম। দু’একটা বিছানাতেও রেখে দিলাম, বালিশের নীচে। মেয়েদের ছবিগুলো একটাও পছন্দ হয়নি আমাদের। তিন চারটে ছবির সবই রংচং মাখা সং। মা-ও তাই বলল। আমাদের আলোচনার মাঝখানে মহিনকাকা এসে দাঁড়ালো। একটা ছবি মায়ের সামনে টেবিলের উপরে ফেলে বলল, “এ মেয়েটা কত কিলো পাউডার মাখে একবার দেখে আসতে হয়!” শুনে মা মুখ টিপে হাসলো।

পরদিন মা-বাবা আর মহিনকাকা মেয়ে দেখতে যাবে। আমি আর গোল্লা মহিনকাকাকে সাজিয়ে দিলাম। দাড়ি কেটে ভাল শার্ট পরে মহিনকাকাকে যেন চেনাই যাচ্ছে না! এমনিতেই টকটকে গায়ের রং! গোল্লা একটা সানগ্লাস এনে কাকাকে পরিয়ে দিল। দেখে বাবাও প্রশংসা করল। আমরাও বড়দের সঙ্গে গেলাম। আমাদের জন্য চা আর মিষ্টি সাজিয়ে নিয়ে এল যে, সেই আমাদের কাকিমা হবে, এই ভেবে গোল্লা আমার গায়ে জোরসে একটা ঠ্যালা মারলো। মেয়েটা খুব কালো আর খুব করে স্নো পাউডার মেখেছে। তবে হাতের পাতা দুটো একদম ধবধবে সাদা। কাউকে বাতিল করতে আমার বড় খারাপ লাগে। মনে হল আমার মতই মনের ভাব মহিনকাকারও। বাড়ি ফিরে মা একবার বলতে গেল, “মেয়েটার হাতে মনে হয় শ্বেতী আছে” শুনে মহিনকাকা উদাস ভঙ্গিতে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

আমরা প্রমাদ গুনলাম। কাকা বিয়েটা শেষ পর্যন্ত করবে তো?

কাকা যেহেতু ওই একটা মেয়েকেই দেখতে গেছিল, তাই শেষ পর্যন্ত ওই মেয়েটিকেই পাত্রী হিসেবে নির্বাচন করা হল। বিয়ের কোনো কিছুতেই কাকা নেই। সারাদিন একমনে ঘরে বসে শুধু প্রাণায়াম করে আর মাঝে মাঝে খবরের কাগজ পড়ে। কোনোভাবে বিয়েটা মিটে গেল। কাকা মেয়েটার মুখের দিকেও তাকায়নি। বউভাতের দিন কাকাকে খুঁজেই পাওয়া গেল না, এবং ফুলশয্যার দিন কাকা বাসরঘরে ঢুকলোও না। নিজের ঘরে একা শুয়ে থাকলো।

আমাদের বাড়ির সামনে একটা পুকুর আছে। ফুলশয্যার পরদিন সকালে পুকুরঘাটে কাকিমাকে নিয়ে মা কীসব স্ত্রী আচার করিয়ে কানে কানে কীসব ফুসফুস করল। আমাদের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে চলে যেতে বলল। একটু পরেই মহিনকাকার ঘরে গিয়ে দেখলাম কাকা খাটে শুয়ে শুয়ে ঘাটের দিকে উদাস চোখে চেয়ে দেখছে। কাকিমা তখন পুকুরে নেমে একা একা স্নান করছে। মহিনকাকা আমাকে বলল,

“তোর কাকিমা তো মনে হয় সাঁতার জানে না! তুই এক্ষুণি একবার ওদিকে যা!”

এক মুহূর্তের মধ্যে হঠাৎ কোথা থেকে কী হল, কাকা দেখি বিদ্যুতের বেগে ঘাটের দিকে দৌড়ালো। তাকিয়ে দেখলাম কাকিমা তার ধবধবে সাদা হাতদুটো উপর দিকে তুলে চিৎ হয়ে দিব্যি জলের উপর ভাসছে। তারপরেই ঝুপ করে কাকা জলের মধ্যে গিয়ে পড়ল। জলের ভেতর তারপর দুজনের জলহস্তীর মতো সে কী ভীষণ দাপাদাপি আর হাসি! গোল্লা আর আমি তক্ষুণি ওদিকে ছুটে যেতে চাইলে মা আমাদের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালো।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *