micro-story-mukti

মুক্তি
শাম্ব চ্যাটার্জী


একমনে খুরপি দিয়ে মাটি কোপাচ্ছিল সত্যকাম। আলো পড়ে এসেছে, দ্রুত হাত চালায় সে। এইসময়টুকু তার খুব প্রিয়। মরশুমি ফুলগুলো যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে, সে এক স্বর্গসুখের অনুভূতি! সহকর্মীরা বলে তাঁর হাতে নাকি জাদু আছে। হাতখানা উল্টেপাল্টে দেখে একবার। সত্যিই কি তাই? তাহলে সেই জাদুর ছোঁয়ায় জীবনটা… সব বীজ তো চারাগাছ হয়ে টলমলে পায়ে উঠে দাঁড়াল না! বোধকরি সৃষ্টির উৎস নিয়ে নিরুত্তাপ থাকাটাই প্রেয়বোধের অপরাধবোধের কারণ হয়ে উঠল। তাঁর ভালবাসা জবাবদিহির ধার ধারেনি, অথচ মনের মানুষ গুমরে গুমরে মরেছে। পরিচর্যায় তাঁর দিক থেকে কোনও ত্রুটি অন্তত ছিল না। সেই অনুতাপেই কি… মাথার শিরাগুলো আবার দপদপ করে ওঠে, শুরু হয় অতীতস্মৃতির প্রলয়নাচন। সেদিনও বাগানে গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত ছিল সে। পরে বাড়ীর পুকুরে… হঠাৎ পায়ে অস্বস্তি বোধ করতে সংবিৎ ফিরে এলো। সন্ধ্যের পড়ন্ত আলোয় কিছুই নজরে এলো না। সাইরেন বাজতে কাজ গুটিয়ে অফিসঘরের দিকে এগোল সত্যকাম। স্নানের সময় শুধু একটা মশা কামড়ানোর মতো অনুভূতি। জলের ধারায় সেটাও আর থাকল না।

স্নান সেরে বেশ কিছুক্ষণ প্রার্থনা করে সত্যকাম। রাতের খাওয়ার পর দেরী না করে শুয়ে পড়ল সে। ভোররাতের দিকে শুরু হল পেটব্যাথা আর অস্বস্তি। পরদিন নির্জীব হয়ে পড়ে রইল বিছানায়। অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে ভেসে আসছিল নানা কণ্ঠস্বরের হাঁকডাক। ডাক্তার রোগী দেখে বদহজমের ওষুধ আর স্যালাইন দিয়ে দায়িত্ব্ সারলেন। এখানে এটুকুই অনেক। নিউরোটক্সিন তার প্রভাব বাড়াতে…

আদালত চত্বর সরগরম। অ্যাদ্দিনে সমস্যার সুরাহা হয়েছে। বারোবচ্ছর আগের সেই দিনটা সকলের স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে আজ। নিম্ন-আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করেছিল শিক্ষকের গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকেরা। স্ত্রীকে খুনের অভিযোগের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর তকমাটা তাঁরা আত্মস্থ করতে পারেননি এক লহমার জন্যেও। খুনি শব্দটা স্বপ্নে তাড়া করে ফিরলেও, এতকাল পরে আইনজীবী দাঁড় করানোর আর্থিক সামর্থ্য ছিল না সবার প্রিয় মাস্টারমশাইয়ের। শেষমেশ হাইকোর্টের হস্তক্ষেপেই বিনাপয়সায় আইনজীবী জুটেছে—ফের খোলা হল কেস ফাইল। মৃতার ভাইয়ের সাক্ষ্য উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে অগ্রাহ্য করে আসামীকে বেকসুর খালাস করল কোর্ট। খোঁজ পড়ল তাঁর, কিন্তু বছরখানেক আগেই কালাচের দংশনে…

দমকা হাওয়ায় হলুদ হয়ে যাওয়া আইনি কাগজপত্রগুলো আকাশে উড়ছিল। দ্রুতহাতে সেগুলো কুড়নোর ব্যর্থ চেষ্টা করছিলেন এজলাশ সেরে বেরোনো কালোকোট পরা ভদ্রলোক। মুক্তির উল্লাস মাখানো অকালবৃষ্টির ফোঁটায় ঝাপসা হয়ে এলো বিচারের ছাইমাখা অক্ষরগুলো। হরফগুলো থেকে চুইয়ে পড়া কালির ধারা তাদের অব্যক্ত ভাষা দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, আসামী নিরপরাধ। বিচারক প্রকৃতি তখন ধুয়ে যাওয়া কালির স্রোতে জগতের মুখ ঢেকে পিছনে পড়ে থাকা সোঁদা গন্ধমাখা ঝাপসা কাগজে সত্যকামের স্বচ্ছতার বয়ান ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত। অনাথ সত্যকাম তাঁর অতীতকে বোঝাতে পারেনি, সে শুধু তাঁর বেড়ে ওঠাকে আরেকবারের জন্য অন্য সংজ্ঞা দিতে চেয়েছিল। সত্যের দাবানলে জঙ্গল ছারখার হয়ে গেলেও, সেই তাপেই তো বুনো বীজের শক্ত খোলা ফেটে ছাইমাটিতে নতুনের জয়ধ্বনির বার্তা বয়ে আনে।

(সব চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক)

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *