micro-story-nepathye

নেপথ্যে
সোমা কুশারী বন্দোপাধ্যায়


স্টেশন লাগোয়া একখানা পার্ক। বহু পুরোনো একটা জলাশয় ঘিরে হঠাৎ সৌন্দর্যায়ণ। ঝাঁকড়া গাছের আড়ালে সিমেন্টের বেঞ্চ। দু-চার ধাপ সিঁড়ির পাশে বুড়ি অশ্বথ গাছটার অবশ্য বয়সের গাছপাথর নেই! সেই কোন যুগ থেকে ভাঙা শিবমন্দির আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকমুখে পার্কটার নতুন নাম লাভার্স পয়েন্ট! শীতের ঝিম ধরা দুপুর এখানে সরগরম। কমলা কোয়া রোদ মেখে চলে লুকোচুরি খেলা। উপুড় করা আয়নায় অনর্গল ছায়ার কারিকুরি… সোহাগী লাল মুহুর্তে আবছা ছাইরঙা।

স্কুল পালানো ব্যাগ বগলে ছেলে মেয়ে, কলরব করা কলেজপড়ুয়া, আর সংসার ছেঁড়া যুগলে ভরে থাকে ঘাসজমি। লাইন লাগোয়া বস্তির কটা ছেলে সময় নেই অসময় নেই ঠিক মাঝপুকুরে ঝাঁপ কাটে। ছিটকে ওঠা জলের শব্দ মিশে যায় চটুল মোবাইলের জগঝম্পের সাথে।

পার্কের লোহার গেটটা কারা যেন খুলে নিয়ে গেছে। হাঁমুখো পাঁচিলটা বেআব্রু পার্কটাকে আরেকটু নির্লজ্জ করেছে। ঐ মুখটাতেই চিনেবাদাম নিয়ে বসে লোকটা। নুনঝালের ছোটো ছোটো পুরিয়ার সাথে কাঁচালঙ্কা, কাগজের ঠোঙায় মাপমতো বাদাম। খোলা ছাড়িয়ে টুপটাপ মুখে দিতে বেশ লাগে! দুপুরের আগেই পার্কটা যেন কীভাবে ভরে যায়। মোবাইলের স্ক্রিনে ঘন ঘন চোখ আর অন্যমনস্ক পায় চারি দেখলেই লোকটা বুঝতে পারে… কেউ আসবে! কত কিছু রোজ দেখতে হয় খিল খিল হাসি, হাপুস কান্না, ঝোপের আড়ালে অন্যকিছু, ক্রুদ্ধ শাসানি, বেহাত মালিকানার তর্জন গর্জন ক… ত… ত… কী !

আজ লোকটা কেমন আনমনা। খড়ি ওঠা গালে আগাছার মতো কাঁচা পাকা দাঁড়িতে হাত রেখে গোটা দিন জুড়ে কী যেন ভাবছে! সকাল থেকে বড় উটকো লোকের ভিড়! পুলিশের গাড়ি! হোমড়া চোমড়া কত কে! ঘন ঘন মোবাইলের ঝংকার… সাইরেন দেওয়ার গাড়ির হুঙ্কার আর আনাড়ি লোকের কাজ কাম ফেলে বেবাক বকুনি!

জাল ফেলে এইমাত্র তোলা হলো। লাল সালোয়ারে থকথকে কাদা! হলুদ কুর্তায় শ্যাওলার আস্তরণ! ফুলে ওঠা লাশটার মুখের দিকে তাকাতে পারে না লোকটা। ভয় হয়, আগে যদি কখনো দেখে থাকে!

হাত ধরাধরির ছবিগুলো বড় বিশ্বাস করতে মন চায় লোকটার! রোজ রাতে বস্তির একটেরে ঘরটুকুতে ফিরে ভাতে ভাত চাপিয়ে লোকটা চুপ করে বসে, মনে মনে পার্কের ছেলে মেয়েগুলোর ঘর গেরস্থালির ছবি আঁকে! ওদের সাত পাকে ঘুরিয়ে পেটভরে ভোজ খায়। ফুটফুটে কচি ছেলে মেয়ের বাপ মা হলে ওদের কেমন দেখাবে ভেবে হেসে খুন হয়! মাঝবয়সী যুগলকেও ভোলে না। ওদের জন্যে মনে মনে দুঃখ পায়।

লাশ নিয়ে পুলিশের গাড়িটা চলে যেতেই ভিড় পাতলা হতে থাকে। লোকটা তবু বেভুল বসে থাকে। লাল সালোয়ার হলুদ কুর্তার জন্যে দুফোঁটা জল গাল গড়িয়ে নেমে যায়!

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

1 thought on “micro-story-nepathye

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *